ক্যান্ডিড থিয়েটারের প্রযোজনায় জীবনানন্দের উপন্যাস অবলম্বনে নাটক মাল্যবান

দিগদর্শন ওয়েব ডেস্ক: জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস অবলম্বনে ও ক্যানডিড থিয়েটারের প্রযোজনায়, সম্প্রতি থিয়ে অ্যাপেক্স এ মঞ্চস্থ হল অন্তরঙ্গ নাট্য ‘মাল্যবান’। প্রথাগত সাহিত্যিক কাঠামোর মধ্যে নিজেকে বাঁধতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তার রচনাগুলি প্রায়ই আত্মজৈবনিক উপাদান এবং দাম্পত্য ও দাম্পত্য বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপোড়েনে, প্রেমে-অপ্রেমে, দাম্পত্যক্লান্ত নরনারীর অতৃপ্ত জীবনের যন্ত্রণায় বিধুর। অসফল প্রেম, অতৃপ্ত দাম্পত্য, দারিদ্র তার লেখাগুলোকে পৌনঃপুণিকতায় ক্লান্ত করে সাধারণের কাছে। ১৯৩২ সালের ১৪ এপ্রিলের দিনলিপিতে তিনি নিজেই লিখছেন, ‘আমার গল্প এবং লেখাগুলো প্লটবিহীন এই অভিযোগ প্রসঙ্গে : জীবনটাই তো প্লটবিহীন, কেবল চক্রান্তকারীরাই ষড়যন্ত্র (প্লট) করে।’ তাই ১৯৪৮ সালে লেখা তার ‘মাল্যবান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। সমকালে প্রত্যাখ্যাত হলেও পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দ দাশের গদ্যসাহিত্য নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর। ক্যানডিড থিয়েটার তাদের নবতম প্রযোজনার আধার হিসেবে বেছে নিয়েছে এই উপন্যাসটিকে। মাল্যবান নাটকটির নির্দেশনা ও নাট্যরূপ দিয়েছেন সুদীপ্ত ভূঁইয়া

এর আগেও জীবনানন্দের কাহিনীকে আশ্রয় করে নাট্য প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতা শহরে। জীবনানন্দ কখনো কখনো চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন বাংলার রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু ক্যান্ডিড থিয়েটার তাদের প্রযোজনাটি গড়ে তুলেছে অন্তরঙ্গ পরিসরে, যা এর আগে কখনো হয়নি। এ প্রসঙ্গে নাটকটির পরিচালক সুদীপ্ত ভূঁইয়া জানান, ‘জীবনানন্দ দাশের লেখাগুলির স্বকীয়তাই হলো তার অন্তরঙ্গতা। যেখানে ঘটনার থেকেও অনুভূতি অনেক বেশি প্রাধান্য পায়’। মাল্যবান উপন্যাসের কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা না পাওয়া, দাম্পত্য জীবনে নিদারুণভাবে অসফল একজন মানুষ মাল্যবান এবং তার বিপরীতমুখী স্বভাবের স্ত্রী উৎপলা। সামাজিক জীবনে মাল্যবানের প্রতিষ্ঠা হীনতা, শান্ত স্বভাব তার স্ত্রী উৎপলার কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। একসঙ্গে ঘর-সংসার করলেও মাল্যবান উৎপলার দাম্পত্য জীবনে সুখের ছোঁয়া নেই। আছে শুধু না পাওয়ার বেদনা, হতাশা। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা কোনভাবে যেন টিকে আছে। তাদের মধ্যেকার যোজন যোজন দূরত্ব সুস্পষ্ট হলেও, কোথাও গিয়ে আবার একসঙ্গে থাকার তাগিদও রয়েছে তাদের। এত তিক্ততার মধ্যেও মাল্যবান কোনভাবে পার করছে তার জীবন। কিন্তু এ নাট্য শুধু হতাশার কথাই বলেনা বরং আশাবাদের কথাই শোনায় শেষ পর্যন্ত। মাল্যবানের প্রত্যাশা, সংসারে সুখ হয়তো আসবে একটা সময়। আসলে আমরা তো এভাবেই বেঁচে থাকি কোন খড়কুটোকে আশ্রয় করে। আমাদের চারপাশেও মাল্যবান উৎপলার মতো অনেক দম্পতি রয়েছেন যারা নিত্যকার দাম্পত্য জীবনে হতাশাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন। এ নাট্য তাই দর্শককে নিজের মুখোমুখিও দাঁড় করায়। তাই মাল্যবান সহজেই ব্যক্তিগত স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয় আন্তর্জাতিকতায়। মাল্যবানের হতাশা আসলে সমাজ রাজনীতির সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের বোঝাপড়ার গল্প। এই মাল্যবান উপন্যাসে উঠে আসে জীবনানন্দ দাশ এর ব্যক্তিসত্তাও। এই প্রযোজনাটিতে অভিনেতারাও তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিগুলিকে আশ্রয় করে নাট্যের মূল বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। এই সময়েও মানুষ বড় একা হয়ে যাচ্ছে। তাই মাল্যবান নাট্য প্রযোজনাটি খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অন্তরঙ্গ পরিসরে দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যেকার শারীরিক নৈকট্যের কারণে অনুভূতিগুলো সহজেই পৌঁছে যায় দর্শকদের কাছে। মাল্যবান চরিত্রে দেবাশিস দত্ত’র, অভিনয় অনবদ্য। উৎপলার ভূমিকায় মৌমিতা ভূঁইয়ার অভিনয়ও উল্লেখের দাবি রাখে। শ্রীরঙ্গ চরিত্রে সুদীপ্ত ভূঁইয়া যথাযথ। এছাড়াও অভিনয়ে ছিলেন মোনালিসা সাধুখাঁ, অনন্যা মণ্ডল ও পার্বতী পাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *