পর্ব: ২
ঈশ্বরবাদী বিবেকানন্দের ভাই নিরীশ্বরবাদী কমিউনিস্ট নেতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। এঁকে চিঠি লিখেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন।
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: হাথরস আর গণ নিগ্রহ কাণ্ডের খবরে হারিয়ে গেল ২০২৪ এর বিবেকানন্দ প্রয়াণ দিবস। আমি একবার প্রবল বিবেকানন্দ অনুরাগী এক ভক্তকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনি কি সত্যিই বিবেকানন্দের আদর্শে আস্থাশীল? জবাব দেন তিনি একশবার। জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাঁর সম্পর্কে কি কিছু জানেন,? এবার ঝাঁঝালো কণ্ঠে তিনি জবাব দেন যতটুকু সম্ভব হয়েছে ততটা জানি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম বিবেকানন্দের মা বাবার নাম জানেন? চোখে তাঁর বোবা দৃষ্টি। জিজ্ঞাসা করেছি আমি বিবেকানন্দ কয় ভাই? আবার নীরবতা। অধিকাংশ বিবেকানন্দ ভক্তরা জানেনই না তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন কমিউনিস্ট নেতা। বিবেকানন্দ জানতেন সেটা । কিন্তু কোনোদিন বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ফিরে যাই বিবেকানন্দের আমেরিকা পরিভ্রমণের কথায়।
বিবেকানন্দের মাদ্রাজি শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমল বিবেকানন্দের বিদেশ যাত্রার চাঁদা তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হন। চাঁদা সংগ্রহ হয় মাত্র ৫০০ টাকা। প্রয়োজন ছিল ৫ হাজার টাকা।
বিবেকানন্দ যখন প্রথমবার ধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে যান বয়স মাত্র ৩১।১১ সেপ্টেম্বর অভ্যর্থনার উত্তর আর শেষ দিন ২৭ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণ বাদ দিলে সাধারণ অধিবেশনে বিবেকানন্দ মোট ৫ টি বক্তৃতা করার সুযোগ পান। বিষয় ছিল ভ্রাতৃভাব , হিন্দু ধর্ম, ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারী ও হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্ক। আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো রাজ্যের রাজা বা দেওয়ান পরামর্শ দিলেও খরচ দিতে কার্পণ্য করেন। বিদেশে সীমাবদ্ধ আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে বিবেকানন্দ যেতে রাজি ছিলেন না। এই সম্পর্কে নিরঞ্জন ধর তাঁর উৎস মানুষ সংগঠনের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে চিকাগোধর্মসভায় শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন ,,,,,,,,,, স্বামীজী বিশেষ উৎসাহিত বোধ করেছিলেন যখন আলাসিঙ্গা পেরুমলের নেতৃত্বে মাদ্রাজের ভক্তবৃন্দ একটা চাঁদা কমিটি গঠন করে বাড়ি বাড়ি ঘুরতাঁর বিদেশ যাত্রার জন্য অর্থ সংগ্রহে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু মাদ্রাজী ভক্তদের পক্ষে পাঁচশত টাকার বেশি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই যাত্রা বাবদ যাতায়াত ব্যয় বাদে স্বামীজীর আনুমানিক ন্যুনতম ব্যয় হাজার তিনেক ধরা হয়েছিল। তিনি তখন হতাশ হয়ে আলাসিঙ্গাকে সংগৃহীত অর্থ গরীবদুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বললেন।( পৃষ্ঠা ৪৩)
বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র বসু বিবেকানন্দের শিষ্য হন। তিনিও মেয়ের বিয়ের জন্য খেতরির মহারাজা অজিত সিংয়ের কাছ থেকে গুরুভাইয়ের আবদারে ২ হাজার টাকা দান নেন।
মনে রাখা দরকার বাঙালির ছেলে বাংলা থেকে সাহায্যের আশা করেননি। এমনকি তিনি ছিলেন দত্ত। সোনার বেনে। বাংলায় তখন স্বর্ণবণিকদের স্বচ্ছল সংগঠন ছিল। নাম সুবর্ণ বণিক সমাজ। তাঁরা প্রথমে আর্থিক সাহায্যের কথা চিন্তা করলেও অজানা কারণে পিছিয়ে যান। অন্যদিকে মহীশূরের রাজা আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও স্বামীজী ভরসা রাখতে পারছিলেন না। তাছাড়া দক্ষিণী রাজারা রাজপুত না হওয়ায় বিবেকানন্দ উত্তর ভারতের রাজাদের কাছেও ভরসা পাচ্ছিলেন না। এই সময়েই খেতরির মহারাজা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসেন। ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার সাধারণ মানুষের সমর্থনে ও অর্থ সাহায্যে নয়, স্বামীজী বিদেশ যান সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠীর বদান্যতায়। বিবেকানন্দকে সাহায্য করায় অনেকের দৃষ্টিতে মহারাজা পড়েন। সতীশ চন্দ্র সামন্ত মহারাজের কাছে চিঠি লিখে বলেন আমি বিবেকানন্দের শিষ্য। সে হিসেবে আমরা গুরুভাই। আমার মেয়ের বিয়ের খরচ বাবদ যদি ২ হাজার টাকা দেন। সেই সময়ে টাকার অংকটা কম ছিল না। শিকাগো যাত্রার সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি বিবেকানন্দ একটি চিঠিতে মহারাজকে লেখেন আপনাকে না জানিয়ে আমি কিছুই করতে পারি না। কেননা আপনি পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু।( উদ্বোধন, সেপ্টেম্বর,১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪২২। ( চলবে)
পর্ব: ৩ আগামীকাল