
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : অনেক রহস্য দানা বেঁধে আছে পুরীর মন্দির গৃহে। রত্নভাণ্ডার নাকি পাহারা দিচ্ছে বিশাল নাগ সাপ। গভীর রাতে কান পাতলে নাকি গর্ভগৃহ থেকে ভেসে আসে নাগরা জের ফোঁস ফোঁস শব্দ । ভেসে আসে দেবদাসীদের নূপুরের ছুমছুম্ আওয়াজ।২০১৮সাল থেকেই পুরীর মন্দিরের গর্ভগৃহের রত্ন ভান্ডারের আসল চাবি নিখোঁজ ছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০১৮ সালে ওড়িশা হাইকোর্ট পুরীর রত্ন ভাণ্ডার সম্পর্কে সঠিক তথ্সংগ্রহের জন্য আর্কিওলজিক্যালসার্ভে অব ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেয়। এই সরকারি সংস্থা মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ১৬ জনের একটি কমিটি তৈরি করে। কমিটির অন্যতম সদস্য রামচন্দ্র দাস প্রথমে জানান রত্ন ভান্ডারের চাবি নিখোঁজ। সেই সময় ওড়িশা বিজেপি দলের মুখপাত্র পীতাম্বর আচার্য চাবি নিখোঁজের দায় চাপান তদানীন্তন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের বিরূদ্ধে।২০১৮ র ৪ ঠা এপ্রিল সরকারি ট্রেজারি অফিসে মেলে ডুপ্লিকেট চাবি ।

তদানীন্তন জেলা প্রশাসক অরবিন্দ আগরওয়াল বলেছিলেন, ট্রেজারি অফিসে একটি আলমারিতে রাখা ছিল চাবি। মন্দির কমিটির হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই চাবি । কিন্তু এই একটি চাবি দিয়ে কি পাঁচটি রত্ন ভান্ডারের দরজা খোলা যায়? এই প্রশ্নটাও দেখা দেয সেই সময় । নাকি বাকি চারটিই চাবিও নিখোঁজ? চাপে পড়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক মন্দিরের দায়িত্বে থাকা আই এ এস অফিসার পি কে জানাকে বরখাস্ত করেন। এর আগে শেষবার রত্ন ভাণ্ডারের তালার চাবি খোলা হয়। অবশ্য ১৯ শতকেও চারবার রত্ন ভাণ্ডারের তালা খোলা হয়। সময়টা ছিল ১৯২৮,১৯৫৬,১৯৭৮ ও ১৯৮৪। জরিপ করা হয় মন্দিরের সম্পদ। কিন্তু সেই জরিপের কাগজ কোথায়? পুরীর রাজা গজপতি দিব্য সিংহ এই বিতর্কে নিশ্চুপ। কিন্তু কলিঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শ্রুতি প্রতিহারী বলেন, রত্নসম্পদ মূল্য নির্ধারণের জন্য গুজরাট থেকে সেরা জহুরী নিয়ে ভাণ্ডারের জরিপ হয়। টানা ১৭: দিন ধরে এক বস্ত্র ( কটকের গামছা ) পরিধান করে শাস্ত্রমতে ১০ জন জরিপ করেন।

প্রাক্তন বিচারপতি বিশ্বনাথ রথ।
উৎকল দীপিকা সংবাদপত্রের তথ্য ১৯০৫ সালেও একবার জরিপ হয়। তথ্য বলছে মন্দিরের বার্ষিক আয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সম্পত্তির পরিমাণ আনুমানিক ২৫০ কোটি টাকার। এসব হিসেব ২০১৮ সালের। গত চার দশকের রত্নভাণ্ডারের সম্পদের কোনো হিসেব কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ দেখায়নি। এবার বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি।১৯৮৫ সালের ১৪ জুনের পর ২০২৪ । রত্ন ভাণ্ডারের তালা খোলার সিদ্ধান্ত হল সেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েই। কিন্তু সেই চাবি দিয়ে তালা খোলা যায়নি। ফলে আসল চাবি নিখোঁজের তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা হল। শেষপর্যন্ত তালা ভাঙা হল। রত্নভাণ্ডারে প্রবেশ করলেন পরিদর্শনকারীরা। সাবধানতা হিসেবে কয়েকজন সর্প বিশারদও ছিলেন। কিন্তু সাপের নাগরাজের দেখা মেলে নি। হ্যাঁ। ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু বাদুড় ছিল। তারা বহিরাগত মানুষের উপস্থিতি পছন্দ না করায় উড়ে গেল। আমরা আগেই জেনেছি , রত্নভাণ্ডার গর্ভগৃহে দুটি। বাহির ভান্ডার। ভিতর ভাণ্ডার। ভিতর ভাণ্ডারের চাঁদের অবস্থা খারাপ। জল চুঁইয়ে পড়ছে। দ্রুত মেরামতি দরকার । এমনটাই বলেছেন মন্দিরের মুখ্য প্রশাসক অরিন্দম পাঢ়ি। তালা ভেঙে বাহির ভাণ্ডারের দুটি কুঠরি থেকে গয়নাগাঁটির সিন্দুক সিল করে রাখা হয়েছে কড়া নিরাপত্তায়।
উৎসবের শেষে ডিজিটাল ম্যাপিং, ভিডিওগ্রাফি শুরু হবে। এবার রত্নভাণ্ডার খোলার শুভ সময় নির্ধারণ হয় জ্যোতিষীর বিধান মত রবিবার দুপুর ১ টা ২৮ মিনিট।পরিদর্শনকারী দলের নেতা প্রাক্তন বিচারপতি বিশ্বনাথ রথ যখন সঙ্গীদের নিয়ে গর্ভগৃহের রত্নভাণ্ডার থেকে বেরিয়েএলেন তখন দিন গড়িয়ে সন্ধে। মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দিরে চলছে উল্টোরথের প্রস্তুতি। সেগুন কাঠের চার ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া ১৫ টি লাল হলুদ রঙের সিন্দুক শ্রী মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যান সেবকরা। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার সিন্দুকগুলি কিন্তু বেশিদিন আগের রং করা মনে হল না। সাধারণের কৌতূহল সিন্দুকে কি আছে? আপাতত কিন্তু সিন্দুক খোলা হচ্ছে না। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আপাতত বেশ কয়েকদিন রাজ্যের উপ মুখ্যমন্ত্রী , আইনমন্ত্রী ও সংস্কৃতি মন্ত্রী পুরীতেই থাকছেন।
এবার দেখা যাক মন্দিরের গর্ভগৃহে রত্ন ভাণ্ডারের অবস্থান সম্পর্কে। গর্ভগৃহের পূর্বদিকে কলাঘাট দ্বার। এখানেই নৃত্যগীত করতেন দেবদাসীরা। ভিতর ভাণ্ডারের দরজা খুলতেই দেখা মেলে অষ্টসখী ও প্রধান রক্ষক মহাদেবের মূর্তি।বলা হয় ১৯০৫ সালে এই রত্নভাণ্ডারে ঢুকতে গিয়ে তিন পান্ডা নিখোঁজ হয়ে যান।১৯২৬ সালে একই কারণে দুই পান্ডা রক্তবমি করে মারা যান। প্রামাণ্য নথি কিন্তু নেই।পাঁচটি কক্ষের প্রথম কক্ষে নাকি আছে নানা মূল্যবান ধাটু ও কষ্টিপাথরের জগন্নাথ মূর্তি ও ব্যবহারযোগ্য সম্পত্তি।দ্বিতীয়টিতে আছে ঘড়া ঘড়া সোনা ও রুপোর মোহর ও অলঙ্কার। তৃতীয় কক্ষে আছে সোনার ঝালর, মনিমুক্তাখচিত। বাসনপত্র। বাকি দুটি কক্ষে রাশি রাশি মণিমুক্তা হীরে জহরত ও বৈদুর্য মণি। মোট সিন্দুকের সংখ্যা ২২। রবিবার ১৪ মে নথিভুক্ত হয়েছে ১৫ টি সিন্দুক।

মোট সম্পত্তির মূল্য কত? কেউ বলছেন ৫০০ কোটি। কেউ বলছেন হাজার কোটি।প্রশ্ন ওঠে দ্বাদশ শতাব্দীতে পুরীররাজার কাছে ধনসম্পদ ছিল? ১৯৭৮ সালের জরিপ অনুযায়ী রয়েছে ২১১ কোটি টাকার সোনার অলঙ্কার,১৯৭ কোটি টাকার রুপোর সামগ্রী।২০১৮ সালে যখন জরিপের কথা ওঠে তখন মাস্ক পড়া দুজন ছিলেন অক্সিজেন সিলিন্ডার সহ। অক্সিজেনের অভাব হতে পারে ঘরেএমন সন্দেহ থাকলে কক্ষে সাপ থাকার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? আসলে সূর্যের গমনপথকে বলে নাগ। বৈদিক যুগের সৌর উপাসকরা পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের বিষ্ণুর উপাসক হন। যেহেতু সূর্যের গমনপথকে নাগ বলা হয় সেই কারণে মিথ ছড়িয়ে দেওয়া হয় ভাণ্ডার পাহারা দিচ্ছে সাপ।১৯৮৪ সালে অনেকে বলেছিলেন, তাঁরা গর্ভগৃহের ভেতর থেকেসাপের ফোঁসফোঁস শব্দ শুনেছেন। আসলে মিথ হয়ে ওঠে রজুতে সর্প ভ্রম। যা অলীক বিশ্বাস থেকে হ্যালুসিনেশন হয়। তবে হলফ করে বলা যায় ভারতে বহু মন্দিরেযে সম্পদ আছে তার থেকে অনেক কম সম্পদ পুরীর মন্দিরে মিলবে।ইঙ্গিত একটি কারণ মন্দিরের গোপন কক্ষের রহস্যময় কারণে আসল চাবি হারিয়ে যাওয়া। যা নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। কোনো রাঘব বোয়াল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে জগন্নাথদেবের সম্পত্তির অনেকটা গায়েব হয়নি তো?
এখন পর্যন্ত কেরলের পদ্মনাভ মন্দিরের ধন ভাণ্ডার আছে ১৪১৬ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকার। অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি মন্দিরের ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সোনা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে জমা আছে ব্যাংকে।। কেরলের গুরুভায়ুরমন্দিরে শুধু সোনাই জমা আছে ৬০০ কেজি। মহারাষ্ট্রের শিরডি সাঁই বাবার মন্দিরে প্রতিবছর প্রণামী জমা পড়ে ৩৬০ কোটি টাকা। গর্ভগৃহে জমা আছে একটন সোনা। পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দির কর্তৃপক্ষ হিসেব দেননা। তবে অনুমান সেখানে আছে ৭৫০ কোটি টাকার সোনা। মন্দিরের চূড়াও নিরেট সোনার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল কয়েকবছর আগে জানিয়েছিল সবচেয়ে বেশি সোনা জমা আছে আমেরিকায়। পরিমাণ ৮ হাজার ১৩৩.৫ টন। ভারতে নিষ্ক্রিয় এমন সোনা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জমা আছে এক লাখ কোটি ডলারের সোনা। রহস্য জমে উঠেছে। পুরীর মন্দিরের গর্ভগৃহের রত্নভাণ্ডারে কত সম্পদ আছে তাই নিয়ে কৌতুহল ক্রমশ বাড়ছে। তবে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে রবিবার ১৪ জুলাই যা হল এক কথায় পর্বতের মূষিক প্রসব।