
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ৮মে ,রবীন্দ্রনাথের ১৬৩ তম জন্মদিন পালিত হবে। বাঙালি মননে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ঈশ্বরের আসনে প্রতিষ্ঠিত। এমন কোনো বাঙালি পরিবার বিশ্বে মেলা দুষ্কর, যেখানে বাড়িতে একটা রবীন্দ্র প্রতিকৃতি বা মূর্তি থাকবে না। বাঙালি মননে রবি কবি এতটাই জুড়ে আছেন যার অন্যতম প্রমাণ কলকাতা মেট্রো স্টেশনের নামকরণে বোঝা যায়। দু দুটি মেট্রো স্টেশন রবীন্দ্রনাথের নামে। রবীন্দ্র সদন, রবীন্দ্র সরোবর। এহেন রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিচয়ে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। বেশিরভাগ বাঙালি জানেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পদবী ছিল কুশারি। অনেকে আবার ইতিহাস ঘেঁটে একটি ভুল তথ্য পরিবেশন করেন। তাঁরা বলেন রবীন্দ্রনাথের মূল পদবী ছিল মুখোপাধ্যায়। সত্যিই কি তাই? কিছু মানুষের ধারনা, ফুলিয়ার মুখোপাধ্যায় পরিবার রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ। ফুলিয়ার মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ জমিদার শুকদেবের বোন রত্নমালাকে বিয়ে করেন, সেই সময় ফুলিয়ার নবলা অঞ্চলে মুখোপাধ্যায় পরিবার ছিল বর্ধিষ্ণু স্বনামধন্য জমিদার বংশ।

প্রশ্ন উঠতেই পারে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ শুকদেবের বোন রত্নমালাকে বিয়ে করেন ফুলিয়ার জমিদার মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় এই তথ্য হয়তো সঠিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ হয় কী করে?
আমি চেষ্টা করছি,সঠিক তথ্যটি তুলে ধরার। সেক্ষেত্রে আমার তথ্যটি সঠিক কিনা প্রমাণের দায়িত্ব নিক রবীন্দ্র গবেষকরা।তথ্য বলছে, আনুমানিক ৮ম/১০ শতকে শান্ডিল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণ ক্ষিতীশ কনৌজ থেকে বঙ্গে আসেন গৌড়রাজ আদিসুরের পুত্র কামনায় পুট্রেষ্টি যজ্ঞে পৌরহিত্য করতে। যদিও একটি বিতর্ক আছে রাজাকে নিয়ে।অনেকে বলেন, গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণসেনের স্ত্রী পুত্র কামনায় যজ্ঞ করতে চান। কিন্তু দ্রাবিড়ধারার বঙ্গের ব্রাহ্মণরা বেদ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। তাই প্রয়োজন হয় উত্তর ভারতীয় বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। যজ্ঞের জন্য এই ব্রাহ্মণ ছাড়া আরও চার ব্রাহ্মণ এসেছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উত্তর ভারতীয় উপাধ্যায়গোষ্ঠী।কিন্তু বাংলা থেকে কনৌজ ফিরে যাওয়ার পর সেখানে এঁরা ব্রাত্য হলেন। কারণ মেলেচ্ছভূমি বঙ্গে যাওয়া। এখানে যেমন বিবেকানন্দ বিলেত যাওয়ায় কালাপানি পার করার পাপে দক্ষিণেশ্বর থেকে মথুরাবাবুর পুত্র তাঁকে তাড়িয়ে দেন। সেই একই ঘটনা। বঙ্গ ভূমি ছিল অনার্য ভূমি। তাই উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতের আর্য সংস্কৃতির মানুষের কাছে বঙ্গ ছিল পাপস্থান। মেলেচ্ছ ভূমি।

এবার আবার আসল কথায় ফিরে আসি। ক্ষিতীশ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাকি চার ব্রাহ্মণদের (পরবর্তী কালে যাঁরা চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ও ঘোষাল) নিয়ে বঙ্গে ফিরে আসতে বাধ্য হন। গৌড়রাজ এঁদের বসতির ব্যবস্থা করেন বাংলার পাঁচ স্থানে। ক্ষিতীশকে বসতি দেওয়া হয় বীরভূমের বন্দিঘাট গ্রামে। পেশা পৌরহিত্য। ক্ষিতীশ পুত্র ভট্টনারায়ণ উপাধ্যায় থেকে পরিচিত হন বন্দোপাধ্যায় হিসেবে। ভট্টনারায়ণ মুক্তিবিচার, প্রয়োগ রত্ন, বেণীসংহার গ্রন্থ প্রণেতা ছিলেন। আবার শাখান্তর হয়ে ভট্টনারায়ণ পুত্র দীননাথ বর্ধমানের কুশ গ্রামে বসতি করেন। গাঁঈ পদবী বদলে হয় কুশারী।
আবার ১৬শ শতকে এই বংশের একটি শাখা সুন্দরবন অঞ্চলে যশোরে ( এখন জেলা বাগেরহাট,থানা রূপসা) পিঠাভোগ গ্রামে বসতি করেন। সেই শাখার পুরুষের নাম জগন্নাথ। তিনি বিয়ে করেন পিরালি ব্রাহ্মণ যশোরের চেঙ্গশুটিয়া পরগনার দক্ষিণডিহি (এখন খুলনার ফুলতলা থানা) গ্রামের শুকদেব রায়চৌধুরীর কন্যাকে। ব্রাহ্মণ সমাজের ব্রাত্য পরিবারে বিয়ের অপরাধে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষও সমাজচ্যুত হলেন। স্বজনচ্যুত হয়ে জগন্নাথ যশোরের মনিরামপুর থানার উত্তরপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। জগন্নাথের উত্তরপুরুষ রামানন্দ মনিরামপুরের বারপাড়ায় বসতি করেন। তাঁর পুত্র মহেশ্বর কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে বসতি গড়ে তোলেন। এঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র পঞ্চানন ১৬৯০ সালে গোবিন্দপুরে শেঠ বসাকদের গৃহে পৌরহিত্য করে ঠাকুর মশাই নামে পরিচিত হন।পঞ্চানন পুত্র জয়রাম জরিপের কাজ করে সম্পদ বানান। যাকে বলা হতো আমিনগিরি। ধর্মসায়রে অর্থাৎ গড়ের মাঠে বাড়ি করেন। বিয়ে করেন সেই দক্ষিণডিহির রায়চৌধুরী বংশের কন্যা গঙ্গামণিকে। ব্রাত্য ব্রাহ্মণ হওয়ায় সেযুগে বিয়ের পাত্রী বা পাত্র পাওয়া ছিল রায়চৌধুরী ও কুশারী বংশের পক্ষে ছিল মুস্কিল।
জয়রামের পুত্র নীলমণি চট্টগ্রাম ও ওড়িশার নিমকমহলে সেরেস্তাদারি করে প্রচুর বিত্ত সঞ্চয় করেন। সেজ ভাই দর্পনারায়নের সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণে ঠিকাদারি করেন। ১৭৬৫ সালে মনোমালিন্য হয় ভাইয়ের সঙ্গে। দুজনে তখন পরিবারসহ থাকতেন পথুরিয়াঘাটায়। নীলমণি চলে যান জোড়াসাঁকোতে। ১৭৮৪তে চিৎপুরের ধনী ব্যাবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের দেওয়া এক কাঠা জমিতে গোলপাতার বাড়ি করেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় ১৭৯১খৃষ্টাব্দে। নীলমণি পুত্র রামলোচন আমিনগিরি করে জমিদারি কেনেন। তাঁর ছিল না কোনো পুত্র। ছোট ভাই রামমণি ও তাঁর স্ত্রী দক্ষিণডিহির রামচন্দ্র কন্যা মেনকাদেবীর ছোট ছেলে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দত্তক নেন। দ্বারকানাথ তাঁর পূর্বপুরুষ জগন্নাথের ছিলেন অষ্টম অধস্তন। জগন্নাথ ছিলেন বংশের ১৪শ প্রজন্ম । সুতরাং মুখোপাধ্যায় নয়, রবীন্দ্রনাথের বংশের বঙ্গে আগমনের পর উপাধ্যায় পদবী বদলে হয় বন্দোপাধ্যায়। এরপর কুশারী। সবশেষে ঠাকুর। একই কথা খাটে সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে। আদি পদবী বিহারের দেও। পরে জমিদারি পদবী রায়চৌধুরী। সুকুমার রায়চৌধুরী ছেঁটে শুধু রায় করে নেন। দেও পদবী বাংলায় বদলে হয় দেব। আগাম রাবীন্দ্রিক মুহুর্তে রইলো দিগদর্শনের পক্ষ থেকে গ্রাহক ও পাঠকদের শুভেচ্ছা।