পর্ব ৭
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লোকসভা নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে। সি এ এ অনেকগুলি ইস্যুর মধ্যে একটি। বিষয়টি মাঝে মধ্যে আলোচনায় আসছে।বাংলার অভিভাবক মিডিয়াগুলি এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। হবেই বা কেন? মাত্র একজন তো আত্মহত্যা করেছে। ঠিকই মাত্র একজনই আত্মহত্যা করেছে। খোদ কলকাতার নেতাজি নগরে মামার বাড়িতে যুবক দেবাশিস সেনগুপ্ত হতাশায় ভুগছিলেন। কি সেই হতাশা? পরিবারের দাবি , মা বাবার নাগরিকত্বের কোনো নথি নেই। মৃতের বাড়ির লোকেদের অভিযোগ সি এ এ এবং এন আর সি নিয়ে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। তার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছিল। হ্যাঁ। অভিষেক ব্যানার্জি মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়ে এসেছিলেন। পাশাপশি একটি পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল গঠন করেছেন। সেই কমিটিতে বেআছেন নাদিমুল হক, ডা: শশী পাঁজা, কুণাল ঘোষ সায়নি ঘোষ ও অরূপ চক্রবর্তী ( কাউন্সিল)। আশ্চর্যের বিষয় , এই কমিটিতে একজন উদ্বাস্তু বিশেষণে ভূষিত কেউ নেই। মমতাবালা ঠাকুরকে অন্তত রাখা গেল না? সবচেয়ে বেশি সি এ এ লাগু হওয়ায় যদি বিপদে কেউ থাকেন তাঁরা নিঃসন্দেহে মতুয়ারা। অথচ সি এ এ বিতর্কে কলকাতার ঘোষ, পাঁজা চক্রবর্তী ও একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবাঙালি নেতা। মূল নিবাসী সম্পর্কে উদাসীনতা আজকে শুধু নয়, স্বাধীনতার আগেও ছিল। প্রমাণ হিসেবে বাকচর্চা প্রকাশনার মুহাম্মদ হেলালউদ্দিনের লেখা বিপ্লবী জাতি বাগদী গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২২ উল্লেখ করছি।
লেখক লিখেছেন সুভাষচন্দ্র বসুর মত মানুষের ঘৃণ্য মন্তব্য বীরেন্দ্র শাসমল সম্পর্কে ভাবতেও বিস্ময় বোধ হয়, অথচ তিনি হননি। সুভাষচন্দ্র তখন নেতাজি হননি। নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা অখণ্ড বাংলার অবিসংবাদী নেতা এবং কলকাত কর্পোরেশনে তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ। অন্যদিকে বীরেন্দ্র শাসমল দক্ষ প্রশাসক , স্বাধীনতা সংগ্রাম করে দেশপ্রাণ খেতাবও পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মেদিনীপুরের কেয়েট। এই এই বীরেন্দ্র শাসমল কীভাবে কলকাতা কর্পোরেশনের চীফ একজিকিউটিভ অফিসার হতে পারেন? বিস্মিত সুভাষ বসুর এটাই প্রশ্ন। শাসমলজীর স্বপ্ন ভেঙে গেল। এই যদি হয় নেতাজীর হাল তবে পিঁয়াজিদের হাল কেমন হবে! লেখক আরও স্পষ্ট করে লিখেছেন ১৯৯১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে শুঁড়ি, জেলে, কৈবর্ত, ডোম দের সংখ্যা কমেছে। তার কারণ তারা জাতি পরিচয় গোপন করে অন্য জাতি পরিচয় দিচ্ছেন নিশ্চয়ই।১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রথম শপথ নিয়ে বলেছিলেন, আমরা সেইসব ভাইবোনদের কথা ভাবছি, যাদের একটা রাজনৈতিক সীমারেখার মধ্যে আমাদের থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে এবং যারা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারছেন না। তবে যাই ঘটুক না কেন তারা আমাদেরই একজন এবং ভবিষ্যতে আমাদেরই একজন হয়ে থাকবেন। ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন , সবকিছুতেই আমরা তাদের সমান ভাগীদার হয়ে থাকব। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছিলেন আমরা সেই সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষকে পুনর্বাসিত করার জন্য অধীর ও উদ্বিগ্ন, দেশভাগের জন্য যাদের যারপরনাই ভোগান্তি হয়েছে এবং এখনও অমানুষিক কষ্ট ও দারিদ্রের মধ্যে কাল কাটিয়ে চলেছেন।
বিজ্ঞাপন
২৬ সেপ্টেম্বর ।১৯৪৭। মহাত্মা গান্ধীএক প্রার্থনাসভায় বলেন, যে সমস্ত শিখ, ও হিন্দুরা পাকিস্থানে আছেন,তারা যদি সেখানে না থাকতে চান , তাহলে যেকোন সময়ে,যে কোনো ভাবে ভারতে চলে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রথম কাজ হল তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্য র ব্যবস্থা করা। প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল১৫ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে বলেন , পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষেরা আমাদের রক্ত মাংসের সমান, যারা স্বাধীনতার জন্য আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন। তারা একটা সীমারেখার ওপারে পড়েছেন বলে হঠাৎই বিদেশি বলে গণ্য হতে পারেন না। এদেশের উপর তাঁদেরও অধিকার আছে। পূর্ববঙ্গ থেকে যখন কাতারে কাতারে লোক ভারতে অর্থাৎ পশ্চিমবাংলায় চলে আসতে শুরু করেভিটে মাটি ছেড়ে,নেহেরুজী তাঁর মন্ত্রিসভার দুজন মন্ত্রী চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও একে চন্দ কে পাঠান পূর্ববঙ্গে যাতে ওপারের বাঙালিরা না আসেন। ভারতের পক্ষে অতিরিক্ত চাপ নেওয়া সম্ভব নয়। নেহেরুজীর কথায় বিশ্বাস করে অনেকে থেকে যান। কার্যত যারা এপারে এলেন অনেকে বিনা চিকিৎসায় খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে মারা গেলেন। মাথার ওপর মেলে না ত্রিপলের ছাদ। তাদের অনেকে পরে এসেছেন। এখনও আসছেন।
সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন নিম্নবর্ণের মানুষজন। নিম্নবর্ণের মানুষের অস্তিত্বকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা ছাড়া ব্রাত্য করেই রাখা হয়। কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতারা সিএ এ নিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তার মূল কথা হল বাংলাদেশে মুসলমানদের অত্যাচারে খুন হচ্ছে হিন্দু বাঙালি। যাঁদের অধিকাংশ নিম্নবর্ণের মানুষ। কিন্তু উচ্চ বর্ণের যে মানুষেরা পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ ত্যাগ করে পালিয়ে আসেন এপারে, তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে গেলেন।পেলেন না নমঃ শূদ্র, পৌণ্ড্র, মালো,কৈবর্ত, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, বাগদি সম্প্রদায়ের হিন্দু রা ও মতুয়া ধর্মের মানুষরা যাঁরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অসহায়দের কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব দিতে চাইছে, কিন্তু বিরোধী শক্তি রাজনৈতিক অভিসন্ধি করে তাঁদের ভুল বুঝিয়ে ভয় দেখিয়ে নাগরিকত্বেরঅধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে। তাঁদের বক্তব্য , সারা বিশ্বে এই আইন রয়েছে এবং এই আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। চিন ইন্দোনেশিয়া, আরবের মতো দেশগুলিতে যে কোনও ধর্মের নাগরিকদের নাগরিকত্ব আইনের অধিকার ভোগ করার সুযোগ আছে। তাহলে আফগানিস্থান, বাংলাদেশ, পাকিস্থান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের নাগরিকত্বের সশোধনী আইনে মাধ্যমে নাগরিক অধিকার দিলে অসুবিধে কোথায়? একনজরে এই বক্তব্য শুনলে মনে হতে পারে , নিম্ন বর্ণের হিন্দু বাঙালিদের প্রতি কেন্দ্রের শাসক দলের মানবিকতা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে কথার মাঝে যে ফাঁকটুকু আছে সেটা সহজেই বোঝা যায়। কি সেই কথার জাগলারি? ( চলবে)