আমেরিকার মানুষ সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন কেন?

পর্ব: ৪

আমেরিকার জ্যাকসন পার্ক। এখানেই অনুষ্টিত হয়েছিল বিশ্বমেলা উপলক্ষ্যে ধর্ম মহাসভা।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: প্রথম তিনটি পর্বে বিবেকানন্দের আমেরিকা ভ্রমণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিজ্ঞজনের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ জানিয়েছি। এই পর্বে প্রথমে জানাবো আমেরিকার তৎকালীন প্রেক্ষাপট। আগেই জানিয়েছিলাম,১৯ শতাব্দীর শেষে আমেরিকার তীব্র আর্থ- সামাজিক অস্থিরতার কথা। সেই সময় আমেরিকার শাসকরা চেয়েছিলেন জাতীয়তাবাদ ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে সামনে রেখে একটা সুস্থির পরিবেশ তৈরি। তাই কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্তি ও গীর্জা সংস্কৃতিকে সামনে রেখে একটি বিশ্বমেলায় নাগরিকদের জড় করা। মনে রাখা দরকার ইংল্যান্ডে তখনও সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তিত হয়নি।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রোটেস্ট্যান্ট প্রতিবাদ রোখার পরিকল্পনা আমেরিকার বিত্তবান সমাজ গ্রহণ করে একশ বছর পর।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ছিল বিত্তবান শ্রেণীরআধিপত্য। এঁদের চেষ্টায় দেশের মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন আবার নতুন করে মাথা চাড়া দেয়। প্রতিষ্ঠিত চার্চের মধ্যে একদিকে যেমন ইভ্যান জেলিক্যান আন্দোলন দেখা দেয়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত চার্চের বাইরে মেথডিস্ট , ব্যাপটিস্ট প্রমুখ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। এই সম্প্রদায়ের যাজকরা জনতাকে তাঁদের বর্তমান অবস্থা নীরবে মেনে নেওয়ার পাঠ দিতে শুরু করেন। এই ঘটনার বেশ কিছু পরে আমেরিকার আর্থিক সংকট দেখা দেয়, সাধারণ নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে থাকে আমেরিকার বিত্তবান মানুষ শাসকদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি সামলাতে নতুন পরিকল্পনা করে।

আমেরিকার ধর্ম মহাসভার সভাপতি জন বারোজ স্বীকার করেন আমেরিকার অস্থির পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য বহু অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয।

ব্রিটেনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার বিত্তসমাজ দেশবাসীর মধ্যে একটা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাটে বাজারে ধর্মীয় বক্তৃতা আয়োজন করতে শুরু করেন। চিকাগো ধর্ম মহাসভার সাধারণ সমিতির সভাপতি জন বারোজ স্বীকার করেন যে আমেরিকার প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়লিতে ধর্ম শিক্ষার জন্ম ছোটো বড় নানা অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করতে নানা দেশের বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ১৭ দিনের বিশ্ব ধর্ম মহা সন্মেলনের আয়োজন করা হয়। এমনটাই মন্তব্য নিরঞ্জন ধরের তাঁর বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থের ৪১ পৃষ্ঠায়।

শিকাগো শহরে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিবেকানন্দ।

বিবেকানন্দ কিন্তু সরাসরি আমেরিকা যাননি। তিনি প্রথমে যান চিনে। সেখান থেকে কানাডায়। তারপর পৌঁছান শিকাগো শহরে। কিন্তু উদ্দেশ্য আমেরিকার সভায় বক্তব্য রাখা হলেও প্রধান বাধা ছিল সভায় আমন্ত্রণ ছিল না। মহাসভা শুরু হতে তখনও দেড়মাস বাকি। মাস টা ছিল জুলাই। সম্মেলন শুরু ১১ সেপ্টেম্বর। দরকার ছিল কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির প্রশংসাপত্র। যা বিবেকানন্দের ছিল না। ভারতের পক্ষে আমন্ত্রিত ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে আনাগরিকা ধর্মপাল, জৈন ধর্মের প্রতিনিধি ছিলেন বীরচাঁদ গান্ধী, ড : এন বি জৈন, ড: এল এম এ সিংভি, শিখ ধর্মের সৎগুরু জগজিৎ সিং,ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ছিলেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার , পার্সী ধর্মের জীবন জি জামশেদজি মোদী , বেদান্ত ধর্মের ড: এম লক্ষ্মী কুমারী, হিন্দু ধর্মের স্বামী বেদ ভারতী, ভূপেন্দ্র কুমার মোদী , মুসলিম ধর্মের মোহাম্মদ আলেকজান্ডার রাসেল ওয়েব, বাহাই ধর্মের রেভারেন্ড হেনরি জেসুপই। খ্রিস্টান ধর্মের পক্ষে ছিলেন সেপ্টিমাস জে হান্না, তিনি মেরি বেকার এডিলেখার বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন। লক্ষণীয় এই অনুষ্ঠানে নেটিভ আমেরিকান, স্থানীয় শিখ, আদিবাসী সম্প্রদায়ের কেউআমন্ত্রিত ছিলেন না। এই তথ্য শিকাগো হিস্ট্রি মিউজিয়ামের। (চলবে)

পরবর্তী পর্ব: আগামীকাল সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *