আমেরিকার মানুষ সিস্টার এন্ড ব্রাদার্স সম্বোধনে সম্মোহিত হয়েছিলেন কেন?
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ১৩১ বছর কেটে গেছে। স্বামী বিবিদিষানন্দ আমেরিকায় পৌঁছে এক বিশ্ব ধর্মসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। শুরুতেই বলেছিলেন মাই সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স। এরপর পাঁচমিনিট ধরে চলেছিল হাততালি। দিনটি ছিল ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। অনেকে নিশ্চয়ই আমার একটা ছোট্ট ভুল ধরাতে চাইবেন। ঠিক আমেরিকায় গিয়ে সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিবিদিষানন্দকে কোথায় পেলাম? কে তিনি?
বরাহনগরের মঠের খরচ চালাতেন রামকৃষ্ণের গৃহী সন্ন্যাসী বলরাম বসু ও সুরেন মিত্র।
হ্যাঁ। রামকৃষ্ণ অনুরাগীরা জানেন যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ। একই দেহে রামকৃষ্ণ । তেমনই যিনি বিবিদিষানন্দ, তিনিই বিবেকানন্দ। হাজারও বিবেকানন্দ ভক্তদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি এই তথ্যটি অনেকেই জানেন না। আসলে রাষ্ট্র যা জানাবে তাই আমরা জানবো। অথচ একটু চোখ কান মস্তিষ্ক সচল রাখলে পর্দার পেছনে যে সত্য চাপা আছে সামনের বেরিয়ে আসতেই পারে। সরাসরি চলুন নিরঞ্জন ধরের বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থের গৃহী বিবেকানন্দ শীর্ষক অধ্যায়ে চোখ রাখি। নিরঞ্জন ধর লিখেছেন,,,,,,,,,, রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আশ্রয়হীন ও সম্পদশূন্য ভক্তদের জন্য বরাহনগরে যে মঠ স্থাপিত হয়েছিল তার প্রায় সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন তাঁর দুই অবস্থাপন্ন গৃহী ভক্ত; বলরাম বসু ও সুরেন মিত্র। উপরন্তু ছিল মুষ্টিভিক্ষা যা গৃহী জীবনে নিন্দনীয় হলেও সন্ন্যাসী জীবনের পক্ষে গৌরববর্ধক। বরাহনগরের মঠের অধিবাসীরাও তাই অচিরে স্থির করেছিলেন যে গৃহত্যাগের পর পরের প্রদত্ত অন্ন আর খাবেন না ও মুষ্টিভিক্ষায় তাঁদের ভরণপোষণ চলবে।( পৃষ্ঠা ১৫) নিরঞ্জন ধর এই তথ্য জানিয়েছেন মহেন্দ্র দত্ত লিখিত সারদানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী গ্রন্থের ১৮ পৃষ্ঠা থেকে ।
ভক্ত বাবুরামের আঁটপুরের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ আট গুরু ভাইকে নিয়ে বিরজা হোম করে সন্ন্যাস নেন। বাবুরামের নতুন সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী প্রেমানন্দ।নরেন্দ্রনাথ নাম নেন বিবিদাষানন্দ। ডানদিকে সেই হোমকুন্ড। আজও পূজিত হয়।
ফিরে যাই নামকরণ সম্পর্কে । তারপর ধীরে ধীরে নিবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে ফিরে আসব।চলুন। ১৮৮৬ সাল। ডিসেম্বর মাস। নরেন্দ্রনাথের গুরুভাই বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের নিমন্ত্রণ করলেন তাঁদের আঁটপুরের বাড়িতে ছুটি কাটাতে। ছুটি শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণে যে সেদিন ছিল ২৪ ডিসেম্বর। খ্রিস্টমাস ইভ। সেসময়ে খ্রিস্টান ধর্মের এই অনুষ্টানে একটা ছুটির আমেজ গড়ে ওঠে। ফলে দলবল নিয়ে নরেন্দ্রনাথ আঁটপুরে পৌঁছে যান বড়দিনের কয়েকদিন আগেই। ২৪ ডিসেম্বর। সন্ধ্যা ।নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর গুরুভাইরা সিদ্ধান্ত নেন বিরজা হোম করে সন্ন্যাস নেবেন সেদিন । অর্থাৎ একটা জিনিষ পরিষ্কার রামকৃষ্ণদেব জীবিত থাকাকালীন কাউকেই সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা দেননি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন শিক্ষাগুরু। দীক্ষাগুরু নন।
রামকৃষ্ণদেব লেখাপড়া করার জন্য তিরস্কার করেন ভক্ত শশীঠাকুর ওরফে রামকৃষ্ণানন্দকে।
মনে রাখা দরকার স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ এমনকি নরেন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই রামকৃষ্ণদেবের প্রতি আকর্ষিত হয়ে এসেছেন প্রত্যেকেরই অল্প বয়স। স্কুল কলেজের ছাত্র। লেখাপড়া ছেড়ে তাঁরা এসেছিলেন। মারাত্মক এক তথ্য মিলেছে শ্রী ম লিখিত নবযুগের মহাপুরুষ গ্রন্থে। সেখানে ১৩৫ পৃষ্ঠায় লেখা ১৮৮৩ বা ৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাবুরাম ( স্বামী প্রেমানন্দ) প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। একথা শুনে ঠাকুর বলিলেন ভালই হল। বন্ধন ছিন্ন হল। পাশ তো নয়। বন্ধন। রামকৃষ্ণ নিজে নিরক্ষর ছিলেন। তিনি চাইতেন না অধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক ভক্তরা। ধর্ম বিষয়ক কর্তব্যে অবহেলা হয়। সরাসরি তিনি রামকৃষ্ণানন্দ যিনি শশী ঠাকুর নামে পরিচিত তাঁকে জিজ্ঞাসার করেছিলেন তুই কি করছিলি? আসলে শশী ঠাকুর পড়াশুনায় এত গভীর মনোযোগে ছিলেন পিছনে থেকে রামকৃষ্ণের তিনবার ডাক শুনতে পাননি। তাই পড়াশুনায় এত মগ্ন দেখে ঠাকুর বললেন অপরা বিদ্যা লাভের জন্য যদি তুই ধর্ম বিষয়ক কর্তব্যেঅবহেলা করিস, তোর ভক্তিলাভ হইবে না।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি শ্রী ম নামে রামকৃষ্ণ কথামৃত লিখেছেন, তিনি বলেছিলেন, শিক্ষায় ভক্তি কমে।
মাস্টারমশাই শ্রী এম শিক্ষিত মানুষ হয়েও কেন গুরু চন্ডালি ভাষা প্রয়োগ করে লেখেন কারণ জানা নেই। মাস্টারমশাই নিজে তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করে লেখেন, ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান। নানান খানার নাম অজ্ঞান। ঈশ্বরকে জানার পর দরকার হয় অন্য সব জানা যায়। ঈশ্বরের জ্ঞান ছেড়ে অন্য সব জানা দুঃখ ও অশান্তির কারণ। কেন মিছিমিছি বই পড়ে খেটে মরব। যা জানার সব তো তিনিই জানাবেন। আর তাকে জন্তের গেলে অধ্যয়ন নয়, চাই সাধন।
শিকাগো ধর্মসভায় বিবেকানন্দ।
তাহলে বলতে হয় রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপন করে শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিবেকানন্দ অনুগামী সন্ন্যাসীরা রামকৃষ্ণদেবের আদর্শ বিরোধিতা করছেন? জবাব তাঁরাই দেবেন। শিক্ষা প্রসঙ্গে পরেঅন্য কোনো আলোচনায় আসব। এখন সরাসরি চলে যাই আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বর বিবেকানন্দের ভাষণ প্রসঙ্গে। তিনি সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স বলা মাত্র হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। কারণ কি? ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা বলেন আমেরিকার পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় মানুষকে সম্মান জানাতে লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান বলার রীতি। সবাই সেই শুনেই অভ্যস্ত। বিবেকানন্দ যখন আমার বোন ও ভাইয়েরা বলেন তখন সম্পর্ক দাঁড়ায় পারিবারিক। এই পারিবারিক সংকটে থাকা শিক্ষিত মার্কিন জনগণ এই পারিবারিক সম্বোধনে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। কেউ তত আগে এমন করে আপন করে নেননি। নিঃসন্দেহে যুক্তিপূর্ণ কথা। শিক্ষিত মার্কিন জনগণের এত আবাগের কারণ নিয়ে অবশ্য চর্চা কেউ করেননি। মুশকিল হচ্ছে যুক্তিবাদ বিজ্ঞানের সূত্র মেনে ঘটনার কার্যকারণ খতিয়ে দেখে। এটাই না পসন্দ অধ্যাত্ববাদীদের।
এমন একটা প্রচার আছে রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর দেশকে জানতে চিনতে পদব্রজে বিবেকানন্দ ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। একটু খতিয়ে দেখা যাক। উৎস মানুষ সংকলন থেকে প্রকাশিত নিরঞ্জন ধর লিখিত বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে লেখক লিখেছেন,,,,,, আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, বরাহনগর তথা আলমবাজার মঠের ব্যয়ভার সিংহভাগ বহন করতেন বলরাম বসু ও সুরেন মিত্র। কিন্তু ১৮৯০ সালে মাত্র মাসখানেকের ব্যবধানে ( ১৩ এপ্রিল ও ২৫ মে) দু-জনেরই মৃত্যু বরণ করেন যার ফলে মঠে এক ঘোর আর্থিক সংকট ঘনিয়ে ওঠে। এখান থেকে, ওখান থেকে কিছু থেকে দেওয়া সম্ভব হলেও অর্থাগমের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করা সম্ভব হলো না। দলনেতা হিসেবে বিবেকানন্দ বারাণসীতে গৃহীভক্ত প্রমোদাদাস মিত্রের কাছে সাহায্য ভিক্ষ করে জোর পত্র লিখলেন। উত্তরে তিনি কেবল উপদেশ দিয়ে কাজ সারলেন , টাকার থলির মুখ খুললেন না। মঠের ব্যয় সংকুলান তখন একেবারে অসাধ্য হয়ে পড়ায় তার অধিবাসীদের পর্যটক সেজে বেরিয়ে পড়তে হলো। লেখক এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন গম্ভীরানন্দ লিখিত যুগনায়ক বিবেকানন্দ প্রথম খণ্ড থেকে। পৃষ্ঠা ২৬১।
বিবেকানন্দের ভারত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আশ্রম চালোনোর খরচ শুধু নয় বাড়িতে মা ভুবনেশ্বরী দেবী ও দুই ভাইয়ের ভরণপোষণের খরচ সংগ্রহও বিবেকানন্দের দ্বায়িত্বে ছিল। এই দ্বিতীয়বারের ভারত ভ্রমণের তালিকায় ছিল আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যময় রাজ্য রাজস্থানের আলোয়ার, জয়পুর, আজমীর, খেতরি, এবং গুজরাটের আহমেদাবাদ, কাথিয়াওয়াড় জুনাগড়,পোরবন্দর , দ্বারকা, বরোদা, খান্দোয়া, বোম্বাই, পুণা, বেলগাঁও, ব্যাঙ্গালোর, কোচিন, মালাবার, ত্রিবাঙ্কুর, মাদুরাই, রামনাদরামেশ্বরম ও কন্যাকুমারী। সবকটি রাজ্যই কিন্তু দেশীয় রাজাদের অন্তর্গত। প্রত্যেক রাজাই হিন্দু ও হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
প্রথমবার আলমোড়া থেকে বোন যোগেন্দ্রবালার আত্মহত্যার খবর পেয়ে কলকাতা ফিরে আসেন বিবেকানন্দ।
আর একটা বিষয় কলকাতার কিছু রাজস্থানী ভক্ত ছিলেন যাঁরা রামকৃষ্ণদেব জীবিত থাকাকালীন দানধ্যান করতেন , কিন্তু এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দান গ্রহণ করলেও রামকৃষ্ণদেব এঁদের তেমন পছন্দ করতেন না। ফলে রামকৃষ্ণদেব বেঁচে থাকতেই ক্রমশ তাঁর প্রতি আকর্ষণ হারাতে থাকেন। এর আগেও একবার ভারতভ্রমণে বিবেকানন্দ বেরিয়েছিলেন কিন্তু বিবাহিতা ছোট বোন যোগেন্দ্রবালার আত্মহত্যার খবর পেয়ে আলমোড়া থেকে ফিরে এসেছিলেন। আগামী পর্বে বিবেকানন্দের ভারত ভ্রমণ , আমেরিকা যাওয়ার আসল কারণ ও কিভাবে তিনি আমেরিকা গেলেন , কি ভাষণ দিলেন , কেন তাঁর বক্তব্যের শুরুতে আমার ভগ্নী ও ভ্রাতারা শুনে হাততালি দিয়েছিলেন তার সঠিক যুক্তিযুক্ত তথ্য জানাবো। ( চলছে)
শেষাংশ আগামীকাল রাত ১০টায়।