উল্টোরথে ফিরে পুরীর মন্দিরে ঢুকতে পারছেন না কেন জগন্নাথদেব?


সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: উল্টোরথে পুরীর মন্দিরে ফিরেও মন্দিরে ঢুকতে পারছেন না প্রভু জগন্নাথ। ঢুকতে দিচ্ছেন না স্ত্রী লক্ষ্ণী। চলছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান নীলাদ্রি বিজে । মূলত ওড়িশায় পুরীতে উল্টোরথ অনুষ্ঠানের পর জগন্নাথ মূল মন্দিরে ফিরে এসে সোনার বেশ পড়েন তিনদিন ধরে। বিগ্রহ সজ্জিত হয় এক কুইন্টাল সোনায়। সঙ্গে পালিত হয় স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর মানভঞ্জন । দেবীর অভিমান তাঁকে রেখে ভাই বোনকে নিয়ে তিনি কেন গেছেন মাসির বাড়ি? তাই পথ আগলে লক্ষ্মীদেবী । মানভঞ্জন চলবে তিনদিন।জগন্নাথ ক্ষীরমোহন মিষ্টি খাইয়ে দেবীর মানভঞ্জন করেন। যেমন শ্রীকৃষ্ণ রাধার মানভঞ্জন করেন। জগন্নাথ যেসব মিষ্টি খাইয়ে দেবীকে তুষ্ট করেন , তার অন্যতম ছানার তৈরি মিষ্টি রসগোলা। হিন্দিভাষীদের উচ্চারণে বাংলায় পরিচিতি হয় রসগোল্লা।এতো পুরাণ কাহিনী।আসলেওড়িয়াবাসীদের দাবি, বহুযুগ আগে থেকে ওড়িশায় রসগোলার প্রচলন। এহেন রসগোল্লা খেয়েই লক্ষ্মীদেবী তুষ্ট হবেন তিনদিন বাদে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিনদিন পথেই রাত কাটাবেন রথে বসে। দুয়ারে রসগোল্লা নিয়ে।

মন্দিরের পথ আগলে অভিমানী স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী

বাঙালির দ্বিতীয় ঘর বাড়ি পুরী হলেও ওড়িশাবাসীদের ঐতিহ্য রসগোল্লার এই দাবি মেনে নিতে রাজি হয়নি বাঙালি। তাই রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে পশ্চিমবাংলা চেন্নাই এর জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেটরস রেজিস্ট্রির কাছে দাবি জানিয়ে বসে।সেই আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৬;র জুলাই মাসে কলকাতায় আসেন জি আই আধিকারিকদের একটি দল। তাঁরা এসেছিলেন বাংলার দাবির প্রমাণ সংগ্রহ খুঁজতে।বাংলার বুদ্ধিজীবী ,ঐতিহাসিক গবেষকরা দেখা করেন জি আই প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন কলকাতা ইতিহাস গবেষক হরিপদ ভৌমিক। তিনি জি আই প্রতিনিধি দলকে বোঝান খাঁটি দুধের রসগোল্লা বাংলার অবদান। গৌড় বাংলায় রসগোল্লা তৈরি হতো পোট শ্যাওলার ওপর।কাঠের আগুনের নরম আঁচে লালচে গুড়ের ওপরের অংশ ধীরে ধীরে সাদা হয়ে চিনিতে পরিণত হতো। বলা হতো কাশের চিনি। অর্থাৎ চকচকে চিনি। সেই চিনিকে সাহেবরা বলত স্নো বল। জি আই প্রতিনিধিদের আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করেন তিনি। রসগোল্লার প্রতি বাঙালির কতটা আবেগী বা আগ্রাসী সংযোগ সেকথা প্রমাণ হয় শিব্রামের লেখায়। তিনি লিখেছিলেন রসগোল্লার জন্য বাঙালি গোল্লায় যেতেও রাজি।

রসগোল্লা খাইয়ে জগন্নাথের স্ত্রীর মানভঞ্জন।

কিন্তু ওড়িশাও বসে থাকার পাত্র নয়। রসগোল্লার আসল দাবিদার যে ওড়িশা সেই দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন পুরীর মন্দিরের মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াই মহাপাত্র। তাঁর বক্তব্য , পুরীর মন্দিরে ১৩ শতকে প্রথম রসগোল্লা তৈরি হয়। ওড়িশা সরকারও তখন তাঁদের দাবির সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনটি কমিটিও গড়ে। যে সংস্থার কাছে দু পক্ষ দাবি জানান তাদের পরিচয়টাও জানা দরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তির অন্তর্গত এই কি আই তকমা ভৌগলিক উৎসবের স্বীকৃতি। বিশ্ব স্বীকৃত এই চুক্তির অন্যতম সাক্ষরকারী দেশ ভারত। শুধু মর্যাদা নয় রপ্তানি সংক্রান্ত ব্যাবসায়ী গুরুত্বও আছে। তদানীন্তন ওড়িশার নবীন পট্টনায়েকের সরকার দাবি করেন, ভুবনেশ্বরের কাছে পাহাল গ্রামে রসগোল্লার জন্ম।ওড়িশার জগন্নাথ বিশেষজ্ঞ সুরেন্দ্রনাথ দাস ও কটকের কাছে সালেপুরের বিমলানন্দ করের দোকানের বর্তমান কর্তা প্রশান্ত কুমার করের দাবি , রসগোল্লার পূর্বনাম ছিল ক্ষীরমোহনা। যদিও জলের গুণে ও চিনির মানগত তারতম্যে সেই মিষ্টির রং ছিল খানিকটা ঘোলাটে।

ওড়িয়া ভাষায় অনূদিত ১৫ শ শতাব্দীর রামায়ণে রসগোল্লার উল্লেখ আছে দাবি ওড়িশার

ওড়িশা সরকারের তৎকালীন বিজ্ঞান ও কারিগরি দফতরের মন্ত্রী প্রদীপ পানিগ্রাহী ওড়িশার কেদারনাথ গবেষণা কেন্দ্রের সাহায্য নেন।জানানো হয় ১৮৯৩ সালের ওড়িয়া সাহিত্যে রসগোল্লার উল্লেখ আছে।সেক্ষেত্রে বাংলা ১৮৯৬ সালের আগে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছে না। সেই সময় ওড়িশার স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ সংগঠনের সভাপতি পঞ্চানন দাস আইনি লড়াইয়ের জন্য কলকাতার আইনবিদদের সাহায্য নেন। আইনবিদরা জানিয়েছিলেন , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ১৯২৪ সালের একটি বই থেকেও প্রমাণিত , যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে রসগোল্লার আবিষ্কর্তা ওড়িশা। ওড়িশা সরকার ১৫০ পাতার রিপোর্টে জানায় , দন্ডী রামায়ণ ও ১৫ শতাব্দীর বাল্মীকি রামায়ণের ওড়িশা অনুবাদে রসগোল্লার উল্লেখ আছে।

বাংলার রসগোল্লার আবিষ্কারক কে তাই নিয়েও বিতর্ক থাকলেও মান্যতা পেয়েছেন নবীনচন্দ্র দাস

শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলার ভাগ্যে শিকে ছেড়ে। জি আই ট্যাগ পায় বাংলা।স্বাভাবিক ভাবেই একবছর পূর্তিতে কলকাতার ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী চলে এমন এক বাংলা টিভি চ্যানেলে রসগোল্লা নিয়ে একটি টক শো হয়।বক্তাদের ভেতর ছিলেন ইতিহাসবিদ হরি পদ ভৌমিক, পুরাণবিদ,অধ্যাপক নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি প্রমুখ।সেখানে সঞ্চালক বোঝাতে চাইলেন, ক্ষীর মোহন মানে তো ক্ষীরের মিষ্টি।বাংলার রসগোল্লার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় কি করে? যদিও উত্তরটা বক্তাদের জানা থাকলেও তাঁরা উচ্চবাচ্য করেননি।কেননা তাঁরাই বাংলার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ভুবনেশ্বরের কাছে পহেলাগ্রামে রসগোল্লার বাজার

কিন্তু সত্যি তথ্যটা হচ্ছে, ওড়িয়া ভাষায় ক্ষীর মানে দুধ।হিন্দিতে ক্ষীর মানে পায়েস। ওড়িয়া ভাষায় দুধ বলতে বোঝায় মায়ের বুকের দুধ। বিস্তারিত বলতে গেলে বলতে হয়, ক্ষীর মোহন মিষ্টি দুধের তৈরি। ভোগ দেওয়া হয় জগন্নাথ তথা দেবতা মোহনকে। ছানা গোলাকার আকার দেওয়ায় গোলা। রসে চোবানো হয় রস। ওড়িশায় ভুবনেশ্বরে কটক রোডে পাহালা গ্রামে রসগোল্লার দোকান আছে সারিসারি।সেই মিষ্টির স্থায়িত্ব বজায় রাখতে ঠাণ্ডা রসগোল্লা বিক্রীত হয়। রসগোল্লার প্রথম দাবিদারদের লড়াইয়ে ম্যাচের প্রথমার্ধে বাংলা এক গোলে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ দুবছর পর ২০১৯ সালে গোল শোধ করে দেয় ওড়িশা। ওড়িশাও রসগোল্লার ট্যাগ আদায় করে নিয়েছে। ওড়িশার সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অসিত মোহান্তী বি বি সি কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,১৯ শতকের শুরু থেকে নানা জীবিকার কাজে ওড়িশার মানুষ বাংলা তথা কলকাতায় যায়। অনেকেই রান্নার কাজ করতেন। তাঁরাই রসগোল্লার নির্মাণ কৌশল বাংলার ময়রাদের শেখান।

মনে রাখা দরকার, সেই যুগে হিন্দু মন্দিরে দুধ কেটে ছানার মিষ্টি মন্দিরে দেবতার ভোগ দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। এখানেই উসকে দেয় মনে একটি প্রশ্ন। তাহলে কি পুরীর মন্দিরের বিগ্রহ কি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু নয়? এটি বৌদ্ধ মন্দির। একথা তো স্বয়ং বিবেকানন্দও বলেছেন তাঁর বাণী ও রচনা গ্রন্থে। আলোচ্য বিষয় যখন রসগোল্লা তখন ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। তবে বাঙালি বুদ্ধিজীবী গবেষকদের রসগোল্লার আবিষ্কর্তা বাংলার চেয়ে যেন লক্ষ্য ছিল, কে সি দাস মিষ্টি নির্মাণকারী সংস্থাকে রসগোল্লার প্রথম আবিষ্কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কে সি দাস নবীন চন্দ্র দাস পরিবারের ধীমান দাসের দাবি রসগোল্লার আবিষ্কর্তা তাঁদের পূর্বপুরুষ।

সেটাই যদি সত্য হয়,তবে কেন রানাঘাটের ফুলিয়া বয়রা ঘাটের হারাধন ময়রার পরিবার ১৮৪৬ সালে প্রথম তাঁরাই আবিষ্কর্তা?অন্যদিকে কলকাতার বেনিয়াটোলার দিনু ময়রার পূর্বপুরুষ ব্রজ ময়রা ১৮৬৬ তে রসগোল্লা আবিষ্কার করেন।আবার বাংলাদেশের বরিশালের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা বলেন পটুয়াখালির পর্তুগিজদের কাছ থেকে ছানা তৈরির কাজ শিখে প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেন সেখানকার ময়রারা। সেখান থেকে শিল্পটি কলকাতায় গেছে।

তবে ইতিহাস যদি নিরপেক্ষ ভাবে মানতে হয়,তাহলে বলা উচিত মূল রসগোল্লার জন্ম ওড়িশায়।বাংলায় যা উন্নত হয়ে স্পজ রসগোল্লা হয়েছে। শনিবার ছিল জগন্নাথের লক্ষ্মীদেবীকে রসগোল্লা খাইয়ে মান ভাঙানোর দিন।সেই নীলাদ্রি বিজে উৎসব কলকাতার জগন্নাথ মন্দিরেও পালিত হয়। এই প্রসঙ্গে রসগোল্লার ইতিহাস চর্চা হলো বলতেই পারো যায়। সবশেষে মিষ্টিমুখ হোক লেখকের ভাষায়। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়, ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়। শেষপর্যন্ত কিন্তু রসগোল্লার জি আই ট্যাগ ওড়িশাও ছিনিয়ে নিয়েছে।( চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *