পুরীর মন্দিরের রত্ন ভান্ডার কি পাহারা দিচ্ছে নাগরাজ?

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : উড়িষ্যায় ঘটেছে পালাবদল। স্থানীয় দল কে পরাজিত করে সর্বভারতীয় দল বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে। রাম মন্দিরের প্রভাব খোদ অযোধ্যায় ম্যাজিক দেখাতে না পারলেও পূর্ব পরিকল্পনা মত উড়িষ্যা জয়ে বিজেপি সফল হয়েছে। পুরীর রথযাত্রা ঘিরে যে উন্মাদনা কাজ করে এবার তারচেয়ে বেশি উন্মাদনা সৃষ্টি হচ্ছে মন্দির কমিটির নতুন সিদ্ধান্তে। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত অর্থাৎ মন্দিরের গর্ভগৃহের নিচে তালা দেওয়া রত্ন ভান্ডার উন্মোচিত করা হবে ইন্ধনদাতা নতুন বিজেপির রাজ্য সরকার। গত ৭ জুলাই এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে রত্ন ভান্ডারের যে দ্বিতীয় চাবি মন্দির কমিটি হাতে পাবে ৯ জুলাই। তারপর সিদ্ধান্ত হবে মন্দিরের গর্ভগৃহের রত্নভান্ডারের তালা কবে খোলা হবে? বহু পুরানো তালা। চাবি দিয়ে খোলা নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে তালা ভাঙ্গা হবে। কিন্তু যিনি গর্ভগৃহের মালিক খোদ জগন্নাথদেব কি অনুমতি দিয়েছেন? হয়ত দিয়েছেন? কোনো দয়িতাপতি হয়ত স্বপ্নে অনুমতি পেয়েছেন। এক বিজেপি নেতার কথায় স্বয়ং জগন্নাথ নাকি মোদীজীর ভক্ত, তখন দেবতা অনুমতি দিতেই পারেন।পুরীর মন্দিরে বিগ্রহ দর্শন করার সুযোগ থাকলেও মন্দিরের রত্ন ভান্ডার আজও সকলের নজরের আড়ালে। যত আড়াল তত রহস্য। যত রহস্য, তত কাহিনী। যত কাহিনী তত মিথ। তার ভান্ডারে রাশি রাশি সোনাদানা ,ঠাসাঠাসি। মন্দিরের সেবায়েতদের বক্তব্য , মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে পাঁচটি গুপ্তকক্ষ। সেই সব কক্ষে আছে সিন্দুক ভর্তি হীরে, জহরত, মণি মানিক্য, সোনা রুপোর তাল। রয়েছে ঘড়া ঘড়া সোনা রুপোর মোহর।কিন্তু সেই রত্ন ভান্ডার ছোঁয়া তো দূরের কথা, চোখে দেখার অনুমতি নেই। সেই ভান্ডার পাহারায় যুগ যুগ থেকে স্বয়ং নাগরাজ। কান পাতলে শোনা যায় নাগরাজের হিস্ হিস্ শব্দ। শোনা যায় , ১৯০৫ সালে এই গর্ভগৃহে কৌতূহল নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন তিন পান্ডা। তাঁদের নাকি কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। ১৯২৬ সালে একই ঘটনায় রক্ত বমি হয়ে মারা যান এক প্রধান পূজারী। যাঁরা দৈতাপতি নামে পরিচিত। সেবাইতদের ধারণা, এই রহস্যময় মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রথম কক্ষে আছে, নানা মূল্যবান ধাতু ও কষ্ঠি পাথরের দেবমূর্তি আর জগন্নাথের ব্যবহার্য সম্পত্তি। দ্বিতীয় কক্ষে আছে, ঘড়া ঘড়া মোহর ও সোনারুপোর অলঙ্কার। তৃতীয় কক্ষে জমা আছে সোনার ঝালর, মণি মুক্তো খচিত সোনা ও রুপোর বাসনপত্র। চতুর্থ ও পঞ্চম কক্ষে আছে হীরে জহরত ও বৈদুর্যমণি সহমোট ২২ টি সিন্দুক।

মোট কত টাকার সম্পত্তি? রয়েছে মতভেদ। কেউ বলেন ৫০০ কোটি । কেউ বলেন ১০০০ কোটি। এতো ধন সম্পদের উৎস কি? অনুমান মূলত ৯০০ বছর আগে থেকে পুরীর রাজাদের সম্পদ ও ভক্তদের দানসামগ্রী জমা রয়েছে এই পাঁচ কক্ষে। তবে ১৯২৮ ,১৯৫৬,১৯৭৮ ও ১৯৮৪ সালে মোট চারবার দ্বাদশ শতাব্দীর এই মন্দিরের সম্পদ জরিপ হয়েছিল। সেই জরিপের কাগজ কোথায়? নেই কোনো উত্তর। কলিঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শ্রুতি প্রতিহারী বলেছেন, রত্নভান্ডারের সম্পদের মূল্য নির্ধারণের জন্য গুজরাট থেকে সেরা জহুরী আনা হয় ১৯৭৮ সালে।১৭ দিন ধরে ১০ জন জরিপকারী শুধু মাত্র কটকি গামছা পড়ে রত্ন ভান্ডারে প্রবেশ করেন। উড়িষ্যার প্রথম সংবাদপত্র উৎকল দীপিকা প্রকাশিত হয়েছিল ৪ আগস্ট ১৮৬৬ সালে। সেই পত্রিকায় কয়েকবছর আগে দাবি করা হয়েছে, ১৯০৫ সালে একবার জরিপ হয়। কিন্তু তাঁর প্রমাণপত্র নেই। সেই জরিপ দলে ছিলেন বর্তমান রত্ন ভান্ডারের সাব কমিটির সদস্য সেবায়েত রামচন্দ্র দৈতাপতির বাবা নরসিংহ দৈতাপতি।

১০০ বছর আগে পর্যন্ত রামনবমীতে মন্দিরের প্রধান দেবতা জগন্নাথকে রঘুনাথ বেশে সজ্জিত করা হতো। এখন কোনো অজ্ঞাত কারণে সে প্রথা বন্ধ। ফলে আরেকটি কক্ষ এখন তালাবন্দী। সেই কক্ষের নাম রঘুনাথ ভান্ডার। সেই ভান্ডারে কি আছে অজ্ঞাত। এবারের তালা খোলা হবে সম্ভবত সেই রঘুনাথ ভাণ্ডারের। তবে কবে তালা খোলা হবে ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বিশ্বনাথ রথের নেতৃত্বে ১৬ জনের কমিটি চাইছে রথযাত্রা উপলক্ষে মন্দিরের বাইরে জগন্নাথ যে কদিন থাকবেন তার মধ্যেই রত্নভান্ডারের তালা খুলে জরিপ করা হবে। উল্লেখ করা যেতে পারেগত বছর স্থানীয় বিজেপি নেতা সমীর মোহান্তী একটি জনস্বার্থ মামলা করে রত্নভাণ্ডারের রহস্য উন্মোচনের দাবি করেন। সেই সূত্রেই আদালতের নির্দেশে এক কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আদেশ জারি হয়। এই পর্যন্ত বিষয়টি ঠিক আছে।


কিন্তু রত্নভাণ্ডার থেকে কি কি মিলতে পারে? সত্যিই কি সেখানে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে নাগ সাপ।তারা খায় কি? তারা কি এত বছর ধরে বন্দী? নাকি সেই গর্ভগৃহের রত্নভান্ডারে কোনো গোপন পথ আছে সেখান দিয়ে তারা পালা করে এসে পাহারা দিয়ে যায়? সুকুমার রায়ের কথা মত তারা কি দুধভাত খায়? কাউকে কাটে না? অবশ্য কাটার সুযোগ তো নেই। প্রায় দেড়শ বছর তো কেউ পা রাখেনি সেখানে। তালাবন্ধ গর্ভগৃহের নিচে সেই রত্ন ভাণ্ডারে অক্সিজেন থাকার কথা নয়। তবে সেই পাহারাদার সাপেরা বেঁচে আছে কি করে? কত আয়ু তাদের? নাকি পুরোহিতদের মত বংশানুক্রমে তারা পাহারা দিচ্ছে? তবে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এবার দেখার বিশ্বাসে রত্ন ভাণ্ডার মিললেও নাগের দেখা মিলবে কি না।


২০১৮ সালে পান্ডাদের মধ্যে এক শরিক ঝগড়া মারাত্মক আকার নেয়। সেই সময় জনৈক হেমন্ত পণ্ডা নামে এক পুরীর নাগরিক আর টি আই করে রত্ন ভান্ডারের আসল তথ্য জানতে চান।কিন্তু মন্দির সাব কমিটির তৎকালীন আধিকারিক এস কে চট্টোপাধ্যায় তথ্য জানাতে অস্বীকার করায় ওড়িশার আদালত তাঁকে জরিমানা করে। অথচ ১৯৫৫ সালের আইন অনুযায়ী তিনবছর অন্তর রত্নভাণ্ডার জরিপ করার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের জরিপের পর মন্দির কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রত্ন ভান্ডারে আছে ২১১ কোটি টাকার সোনার অলঙ্কার,১৯৭ কোটি টাকার রুপোর সামগ্রী। সোনার সামগ্রী আছে ৩৬৭ টি। যার ওজন ৪৩৬৭ ভরি। ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ আদালত পুরীর পান্ডাদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতেই ওড়িশা উচ্চ আদালতকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সময়টা ছিল তখন রথযাত্রার। ফলে বিষয়টি জনস্বার্থে পিছিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ওড়িশার উচ্চ আদালতের নির্দেশে রত্নভাণ্ডার জরিপের জন্য ১৬ জনের প্রতিনিধি দল তৈরি হয়। এরমধ্যেই সরকারি প্রতিনিধি রাজার প্রতিনিধি, মন্দির কমিটির প্রতিনিধি, দৈতাপতিদের প্রতিনিধি তো আছেনই এছাড়াও দলে ছিলেন দুজন সর্প বিশারদ।তবে রত্ন ভাণ্ডার পাহারা দিচ্ছে নাগরাজ এমন কষ্ট কল্পনায় আদালত বিশ্বাস রাখেনি। কিন্তু সংস্কারের অভাবে মন্দিরের এই সব কক্ষ কতটা সুরক্ষিত আছে সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।সেক্ষেত্রে ওই ঘর দীর্ঘ বছর ধরে তালাবন্ধ থাকায় সরীসৃপদের যে স্বর্গরাজ্য নয় ,সেকথা কে বলতে পারে? বিশেষ করে যে ঘরগুলোতে কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই। সঙ্গে ছিল অক্সিজেন মাস্ক। যুক্তি বলে, যদি ঘরগুলোতে অক্সিজেন না থাকে তাহলে সাপের অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নও নেই। আবেগ প্রবণতা যেসব জগন্নাথ ভক্তরা সংযমের সঙ্গে লালন করেন তাঁদের যুক্তি, সূর্যের গমন পথকে বলে নাগ।সুতরাং জগন্নাথের সম্পদ রক্ষা করছে নাগ সেতো কভু মিছে নয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালের প্রতিনিধিদের একাংশ বলেছিলেন,তাঁরা সাপের হিস্ হিস্ শব্দ শুনেছেন। কিন্তু চোখে দেখার দাবি করেননি।যুক্তিবাদীদের বক্তব্য , এই শোনার বিষয়টি আসলে বিশ্বাসের প্রতিফলনে হ্যালুসিনেশনের শিকার ।


পুরীর রত্ন ভাণ্ডার নিয়ে যে গ্যাস বেলুন ওড়ানো হয়েছিল,২০১৮ সালের জরিপের ফলে দেখা যাচ্ছে ,দেশের অন্যান্য মন্দিরের সম্পদের কাছে পুরীর মন্দিরের সম্পদ নস্যি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেবতা কেরলের পদ্মনাভ মন্দির।২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী সেই মন্দিরের ধন ভাণ্ডার ২২ মিলিয়ন ডলারের। ভারতীয় টাকার অঙ্কে ১৪,১৬,৬৯,০০,০০,০০০ টাকা।মন্দিরের একটি কক্ষের হিসেব।আছে আরও পাঁচটি কক্ষ। জম্মু কাশ্মীরের বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে আছে ১.২ টন সোনার।২০১৮ পর্যন্ত আরও জমা হয়েছে ১৯৩ কেজি সোনা। অমৃতসর মন্দিরে আছে কমপক্ষে ৭৫০ কেজি সোনা।তবে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।জগন্নাথ সেবাইত ও ভক্তরা ভাবতে ভালোবাসেন জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডারে ছিল আরও সম্পদ । কিন্তু বারে বারে বহিরাগতদের আক্রমণে সম্পদ লুঠ হয়েছে।কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। ১৩৪০ সালে পুরীর মন্দির প্রথম আক্রমণ করেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্। সেবাইতরা তিন বিগ্রহকে লুকিয়ে রাখতে পারলেও রত্নভান্ডার রক্ষা করতে পারেননি। এরপর ১৩৬০ সালে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলক ওড়িশায় হত্যা ও লুঠ চালান। এরপর ১৫০৯ সালে বাংলার নবাব হুসেন শাহ পুরী লুঠ করেন।তখন পুরীর রাজা ছিলেন রাজা প্রতাপ রুদ্র দেব। কালাপাহাড় লুঠ করেন ১৫৬৮ সালে। সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় লুঠ। এখানেই শেষ নয়।১৫৯২,১৬০১,১৬১১,১৬১৭,১৬২১, ১৬৪১সালে লুঠ হয়েছে পুরীর মন্দির।১৭ তম আক্রমণ ও লুঠ করেন ওড়িশায় নবাব তাকি খান।সেবার পুরীর তিন বিগ্রহ লুকিয়ে রাখা হয় হায়দ্রাবাদে। প্রতিবার রথযাত্রা বারে বারে বন্ধ থাকে.। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা১৬১১ সালে আকবরের সুবেদার রাজস্থানের হিন্দু সুবেদার আগরওয়াল টোডরমল পুত্র কল্যাণমল পুরীর মন্দির আক্রমণ করে রত্নভান্ডার লুঠ করেন।সুতরাং বারে বারে লুঠ না হলে হয়ত পুরীর রত্নভাণ্ডার হতো দেশের সেরা।জগন্নাথ হতেন সবচেয়ে ধনী দেবতা। এখন একটি মাত্র গুপ্তকক্ খুলে দেখা বাকি। রবিকবি তো কবেই বলে গেছেন, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *