পর্ব:২
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: প্রথম পর্বেই বলেছিলাম হিন্দুতে ২৪ ধরণের গুরু আছেন। এই সম্পর্কে অরিন্দম চক্রবর্তী দেশ পত্রিকায় সদ্ গুরু _ অসদ্ গুরু শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন ,,,,,,, যাঁর কাছ থেকেই যত সামান্যই হোক শিখি কিছু, তাঁকেই গুরু বলে স্বীকার করার শিক্ষা আমরা পাই শ্রী মদ্ভাগব মহাপুরাণের একাদশ স্কন্ধে কৃষ্ণ _ উদ্ভব সংবাদে যা উদ্ভবগীতা নামে প্রসিদ্ধ। সেখানে দত্তাত্রেয় অবধূত রাজর্ষি যদুকে বলেছেন যে তাঁর ২৪ জন গুরু।সর্বংসহা পৃথিবীর কাছে তিনি শিখেছেন ক্ষমাগুণ । বায়ুর কাছ থেকে শিখেছেন সর্বত্র প্রবেশ করেও কোথাও আবদ্ধ না হবার নিরাসক্ত বহমানতা। আকাশগুরু তাঁকে শিখিয়েছেন দেহেন্দ্রিয়ের মেঘাচ্ছন্ন হয়েও নির্লিপ্ত নির্বিকার থাকার কৌশল। তাপাহারী সদাস্নিগ্ধ জল তাঁকে শিখিয়েছেন কেমন করে নিজে স্বচ্ছ থেকেও অন্যকে দর্শন স্পর্শন কীর্তনের দ্বারা, সিক্ত,স্নিগ্ধ ধৌত করতে হয়।স্বরুপগত নিরাকার হলেও মানুষ পশু , পক্ষী কীটের শরীরে প্রবেশ করে আত্মাসেই আকার ধারণ করেন এই তত্ত্ব শিখেছেন অগ্নি গুরুর কাছে – যে আগুন নিজে আকুতি শূণ্য হলেও কাঠপ্রভৃত ইন্ধনের আকার ধারণ করে থাকেন। ষষ্ঠ গুরু চন্দ্র কলায় কলায় বাড়েন কমেন অথচ বস্তুত অক্ষয় অপরিবর্তনীয়।,,,,,
২৪ গুরুর অন্যতম পায়রা
অষ্টম গুরু একক পায়রা দম্পতি। পায়রা শিশু ব্যাধের ফাঁদে আটকালে পায়রা দম্পতি যেচে সন্তানদের সঙ্গী হল। পরিবারের প্রতি অহেতুক আসক্তি শিক্ষা দেয় ভয়ানক পরিণতির কথা । অজগরের কাছ থেকে আহার আহরণ নিশ্চয়তা শিখলেন আর সমুদ্রের কাছে শিখলেন দূরবগাহ অপার গভীরতা। পোকা, হাতি, হরিণ, ভ্রমর, আর মাছ রায় পাঁচ গুরু তাঁকে সাবধান করে দিলেন রূপের আগুন,স্পর্শের ফাঁদ, শব্দের মোহিনীমায়া, গন্ধের যাদু আর লোভনীয় খাদ্যের বিপজ্জনক আকর্ষণ থেকে।( দেশ, সাময়িকী,, সংখ্যা ৩৮,৫৩ বর্ষ,২৬ জুলাই ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩০)।
শাস্ত্রে বলা আছে বেশ্যাও গুরু হতে পারে।
শাস্ত্রে বেশ্যাকেও গুরু বলা হয়েছে। পিঙ্গলা নামে এক বেশ্যা শুধু পুরাণে নয়, সাংখ্য সূত্রেও যুক্ত হয়েছে। কারণ যখন সারাদিন অপেক্ষা করেও পিঙ্গলা খদ্দের পেল না তখন তাঁর আত্মগ্লানি ও অনুতাপ ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।তাই দত্তাত্রেয় পিঙ্গলা বেশ্যাকে দূর থেকে গুরু রূপে প্রণাম করে মনে মনে বলেছিলেন, আশা হি পরমা দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম। যথা সং ছিদ্য কান্তাশং সুখং সুম্বাপ পিঙ্গলা।। লেখক আরও লিখেছেন, মনে রাখতে হবে যে ঔপনিষদিক প্রেক্ষাপটে এই উপদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে মন্ত্রদাতা বা দীক্ষাদাতা গুরু নন। গুরু হচ্ছেন তিনিই যিনি নিজে ব্রহ্মবিদ এবং ব্রহ্মবিদ্যার উপদেশ দিয়েছেন, যাঁর বাড়িতে যাঁর পুত্রের মত প্রতিপালিত হয়ে কেটেছে জীবনের বনিয়াদ নির্মাণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলি।
বাঙালির দুই গুরু
গুরুবাদ সর্বত্র। সঙ্গীত, শিল্প, ক্রীড়া, রাজনীতি, লেখাপড়া, ব্যায়াম, নেশ, এমনকি চুরি ডাকাতিতেও গুরু আছে। পটলডাঙার তিনমূর্তি টেনিদাকে হাড়ে হাড়ে চিনলেও তাঁকে গুরু হিসেবেই মানত। চলচ্চিত্রে বাংলায় তো গুরু বলতে উত্তমকুমারকেই বোঝায়। রবীন্দ্রনাথ পছন্দ না করলেও আমরা তাঁকে কবিগুরু বলে থাকি। ঈশ্বর থাকতে গুরুর প্রয়োজন কি? এই প্রসঙ্গে অরিন্দম চক্রবর্তী সদগুরু -অসদ গুরু নিবন্ধে লিখেছেন, তর্কের খাতিরে বলি বটে আমরা _ কি দরকার গুরুর? সোজাসুজি ভজনা করবো ঈশ্বরকে। কিন্তু চতুর্ভুজ নারায়ণ, কিংবা দশভূজা দুর্গা কিংবা পঞ্চানন শিবকে কেমন করে আনব ধ্যানে? ,,,,,,,,, আমার চাই ধ্যানের আলম্বন রূপে আমার চেনা মানুষ রূপটি। তাই আমার দরকার দ্বিনেত্র গুরুকে।( দেশ পত্রিকা,২৬ জুলাই,১৯৮৬,)।
অরিন্দম বাবু সাধারণ মানুষের মনের কথা বলেছেন বটে, তবে রাজা রামমোহনের এই সম্পর্কে বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, মূর্তিপূজা যে নিম্নস্তরের সাধনা। এবিষয়ে মতদ্বৈধ নেই। রামমোহন শ্রীভাগবতের দশম স্কন্ধের চুরাশি অধ্যায়ের ব্যসদেবের ভগবদ বাক্য উদ্ধৃত করে বলেছেন কিং স্বল্প তপসাং নৃণা মর্চ্চায়াং দেব চক্ষুষাৎ। দর্শন স্পর্শন প্রশ্ন।প্রহ্ব পাদার্চ্চনাদিকৎ।। ভগবান শ্রীধর স্বামীর ব্যাখ্যা- তীর্থা স্নানাদিতে তপস্যাবুদ্ধি যাহাদের , আর প্রতিমাতে দেবতাজ্ঞান যাহাদের , এমতরূপ ব্যক্তি সকলের যোগেশ্বরদের দর্শন স্পর্শন নমষ্কার আর পাদার্চ্চন অসম্ভাবনীয় হয়। রামমোহন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে ব্যক্তি শরীরকেআত্মা মনে করে আর স্ত্রীপুত্রাদিতে আত্মভাব অর্থাৎ আমার বোধ আর মৃত্তিকানির্মিত বস্তুতে দেবতাজ্ঞান হয় আর জলেতে তীর্থবোধ হয় , আর এসকল জ্ঞান তত্ত্বজ্ঞানীতে না হয়, সে ব্যক্তি বড় গরু , অর্থাৎ অতি মূঢ় হয়। ( চলবে)
শেষ পর্ব আগামীকাল ২৬ জুলাই