গণেশ চতুর্থীতে মাতল দেশ,কিন্তু গণেশ কি শুভ দেবতা?

পর্ব: ৫ ও শেষাংশ

হেরম্ব গণেশ।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : অনেক জায়গায় দশহাত বিশিষ্ট গণেশ লক্ষ্য করবেন। এই মূর্তি যাঁরা আরাধনা করেন তাঁরা মহাগণপতি। দশটি বাহু। গাত্রবর্ণ লাল।অর্থাৎ দশদিকের রক্ষাকর্তা। হরিদ্রাগণপতিদের মূর্তির গাত্রবর্ণ হলুদ। পরণে হলুদ বস্ত্র। এই গণেশের উপাসকরা হাতে কবচের মত একটি হাতির দাঁতের স্মারক পরেন। নবনীত শব্দের অর্থ মাখন। অর্থাৎ নম্র দেবতা। আসলে বৈষ্ণব তন্ত্রের প্রভাব আছে এই গণেশের। যেমন আমাদের কালী আরাধনা। শাক্ততন্ত্রের দেবী হলেও কালীঘাটে বৈষ্ণব মতে পুজো। তাই কালী পুজোর রাতে এখানে কালী পুজো হয় না। হয় লক্ষ্মী পুজো। বৈষ্ণব মতে কালো গাত্রবর্ণের দেবী হয়ে যান শ্যাম বর্ণের। নাম হয়ে যায় শ্যামা। এবার বলি সন্তান গণপতিদের কথা। এই সম্প্রদায়ের গণেশ উপাসকেরা বাৎসল্য রসে গণেশের আরাধনা করেন। এঁদের কাছে গণেশ পুত্রসম । ঠিক যেভাবে বাঙালি দুর্গাকে উমারূপে কন্যাকে বরণ করেন।

গণেশের পাঁচ স্ত্রী সহ বিগ্রহের মন্দির আছে ইন্দোর শহরে।

কেউ বলেন গণেশ অবিবাহিত। কেউ বলেন গণেশের এক স্ত্রী পুষ্টি। কেউ বলেন, দুই স্ত্রী তুষ্টি ও পুষ্টি। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে যে গণেশ মন্দির আছে সেখানে গণেশের সঙ্গে পূজিত হন তাঁর পাঁচ স্ত্রী। পুষ্টি, তুষ্টি, রিদ্ধি, সিদ্ধি ও শ্রী। গণেশের কিছু মূর্তিতে হাতে দেখা যায় ডালিম ফল। ডালিম লাল রং। লাল কামের প্রতীক। রজ:গুণ। অনেক ক্ষেত্রে হাতে থাকে মোদক। মোদক কথাটি মারাঠি। কোঙ্কানি ও গুজরাটি ভাষার মিশ্রণে মোদক শব্দের উৎপত্তি। মালায়লাম ভাষায় কোজাকাথা। কর্ণাটকে কাদুবু। তামিলে মোদাকাম। তেলেগুতে কুদমু। চালের গুঁড়ো, নারকেল কোরা আর খেজুর গুড় দিয়ে মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থীতে ২১ টি মোদক নিবেদন করা হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে দলিত প্রধান এলাকার মানুষ বৌদ্ধ বা জৈন অথবা নিজস্ব লৌকিক ধর্মে আস্থা রাখত। হিন্দু ধর্মের প্রাবল্যে সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের অত্যাচারে মুসলিম ধর্মে বা হিন্দু ধর্মে আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হয় দলিত সম্প্রদায়ের। অবিদ্যোৎ মোঘুর আমলে জোর করেও কিছু বৌদ্ধদের মুসলিম বানানো হয়।সংখ্যায় বেশি নয় । মুসলিমরা ভারত শাসন করেছে প্রায় ৭০০ বছর তেমন হলে ভারতে তো হিন্দু থাকার কথাই নয়। এসব হিন্দু রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্য বাদীদের অপপ্রচার।

পুরাণে নাগ জনগোষ্ঠীর দেবতাও বলা হয়েছে।

ভারতীয় জ্যোতিষ্ট শাস্ত্রে বুধ গ্রহের একটি গুরুত্ব আছে। বুধের সঙ্গে গণেশের এক যোগসূত্র স্থাপন করার চেষ্টা হয়েছে। প্রভাব মিশরীয় প্রথার। গণেশকে সূর্যের প্রতীক বলা হয়। বুধ সূর্যের নিকটতম গ্রহ। আকারে ছোট। গণেশকে বলা হয়েছে খর্বকায়। মিশরের এক পৌরাণিক প্রাণী ইয়ালি। একটি সিংহের শরীর, হাতির মাথা ও পায়ের অংশ সাপের লেজাকৃতি। গণেশকেও গলায় পরানো হয়েছে সাপ। বলা হয় নাগপোবীত। অর্থাৎ হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গণেশ অচ্ছুৎ।আদিবাসী সাপের পূজারী নাগ সম্প্রদায়ের উপাস্য গণেশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাধারণ সমাজে প্রভাব বিস্তারে অনিচ্ছাসত্বেও শিব ও গণেশকে মেনে নিতে বাধ্য হয় আর্য সমাজ ও বিষ্ণুর উপাসক ব্রাহ্মণ্যবাদী দল। ঐতিহাসিক সুভাষ কাক লিখেছেন, প্রাচীন মিশর ও ভারতের উৎসব পুরাণে বহু সাদৃশ্য মেলার কারণ ১৯০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর ক্রমাগত ভূমিকম্পে ভারতীয় প্লেট পশ্চিমদিকে সরে যায়। তিনি এও অনুমান করেন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বুদ্ধদেবকে জনবিচ্ছিন করতে তাঁকে রাক্ষস বানিয়ে গণেশকে দিয়ে বধ কাহিনী প্রচার করা হয়।

বৌদ্ধ সহজযানপন্থীরাও নিজেদের মত গণেশ বুদ্ধদেবের উপাসনা করেন।

বুদ্ধ ও গণেশ সম্পর্কের বড় প্রমাণ গুজরাটের সুরাট। সেখানে তাইওয়ানের এক বুদ্ধ মূর্তির অনুকরণে গণেশের মূর্তি স্থাপন করেছেনএক মন্দিরে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু পুরাণকারেরা বেশ কয়েকজন অসুর সম্প্রদায়ের নেতাকে বধ করেছেন গণেশ এমন গল্প জুড়ে দেওয়া হয়। মৎসরাসুর বধ করে গণেশ পূজিত হন বক্রতুন্ড নামে। অর্থাৎ কুণ্ডলীবদ্ধ শুঁড়। এমন আরও কয়েকটি নামে ভূষিত হন গণেশ।

দেবতাদের যৌনতা নিয়ে ডা: অতুলে সুরের একটি বই আছে। সেখানে হিন্দু দেবতাদের যৌন কেচ্ছার কথা উল্লেখ আছে। আমরা বরং দেখব গণেশ পুজোয় তুলসি পাতা কেন নিষিদ্ধ ? পুরাণ বলছে, তুলসী ছিলেন রাধার সহচরী। কৃষ্ণের সঙ্গে একটু ইয়ে করতে গিয়ে রাধার কাছে ধরা পড়ে যান। রাধার অভিশাপে মর্ত্যলোকে রাজা ধর্মধ্বজের স্ত্রী মাধবীর গর্ভে জন্মান। ব্রহ্মার উপাসনা করে বিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে পেতে চান। কিন্তু ব্রহ্মার সম্মতিতে রাজা ধর্মধ্বজ কন্যার বিয়ে নির্ধারিত হয় সুদামার সঙ্গে। সুদামা পরজন্মে রাজা শঙ্খচূড় হয়ে ব্জন্মান। তুলসীর সঙ্গে বিয়ে হয় অসুর রাজা শঙ্খচুড়ের সঙ্গে। বিষ্ণুর নজর ছিল তুলসীর প্রতি। ছদ্মবেশে এসের তুলসীকে ভোগ করলেন বিষ্ণু। সেই নিয়ে তুলসী চাইলেন স্বীকৃতি। সেকি আর সম্ভব? এরপর গণেশের প্রেমে পড়েন তুলসী। কিন্তু বাপের বন্ধু বিষ্ণুর শয্যাসঙ্গিনীর সঙ্গে প্রেমটা চাপের হবে ভেবে সরে আসেন গণেশ। তুলসী গণেশকে তিরষ্কার করেন। সেই থেকেই নাকি গণেশ পুজোয় তুলসী পাতা নিষিদ্ধ।

কোনো কোনো পুরাণ বলছে , গণেশের মাতৃ পরিচয় নেই। শিব নিজেই সৃষ্টি করেছেন পুত্রকে।

বাঙালি গনেশের বোন হিসেবে জানেন লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে। ভাই কার্তিক।সবাই নাকি দুর্গার পুত্রকন্যা। প্রথমত এক পুরাণে পার্বতীর পুত্র কন্যা। তাহলে দুর্গার সৃষ্টি তো অনেক পরে। রূপকথাতেও ন্যূনতম যুক্তি থাকে। পুরাণে তাও নেই। উল্টে অমরকোষ নামে প্রাচীন অভিধানে বলা হয়েছে গণেশের আর একনাম দ্বৈমাতুর । অর্থাৎ যাঁর দুই মা। পদ্মপুরাণে বলছে, হরপার্বতী হাতির রূপ ধরে বনে বিহার করছিলেন। তাঁদের মিলনে গজমুন্ড গণেশের জন্ম। লিঙ্গপুরাণ বলছে গণেশের কোনো মা নেই। অসুরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেবতারা শিবক অনুরোধ জানালে শিব নিজেই গণেশের সৃষ্টি করেন। বরাহপুরাণ বলছে শিবের ঘাম থেকে গণেশের জন্ম। দেবী পুরাণেও তাই বলা হয়েছে। সবচেয়ে বিষ্ফোরক তথ্য তন্ত্রে।সেখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে গণেশের স্ত্রী বলা হয়েছে। গণেশের জন্ম কিভাবে সেটাই পুরাণগুলিতে সর্বসম্মত তথ্য নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে মানতে হবে ভাদ্র বিকাশের শুক্লাচতুর্থীতে জন্ম? আবার কোথাও বলা হয়েছে মাঘ মাসের চতুর্থীতে গণেশের জন্ম।

কোনো পুরাণে লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে গণেশের স্ত্রী বলা হয়েছে।

বাঙালি দুর্গাপুজোয় গণেশকে স্থান দিলেও কোনও মন্দির বানানোর প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি। যে কটা মন্দির আছে সব অবাঙালিদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। তবে বাঙালি ব্যবসায়ী হালখাতা পুজোয় গণেশের পুজো করেন লক্ষ্মীর সঙ্গে। কেননা ধর্মীয় ব্যাখ্যায় গণেশের পঞ্চম স্ত্রী শ্রী। শ্রী তো লক্ষ্মী। আবার দুর্গাপুজোয় গণেশ লক্ষ্মী পূজিত হন দুই ভাইবোন হিসেবে। অন্যদিকে সমুদ্রের মন্থনে লক্ষ্মীর উদয়। এর পর দুর্গার সৃষ্টি ।তাহলে দুর্গার কন্যা লক্ষ্মী হন কি করে? শিবের স্ত্রী পার্বতী।এর অনেক পরে অসুর মহিষাসুর বধের জন্য দুর্গার সৃষ্টি। দুর্গার সঙ্গে শিবের স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক কোথাও লেখা নেই। তাহলে দুর্গার সন্তান লক্ষ্মী বা গণেশ হন কি করে? আসলে সব ঘেঁটে ঘ। মেনে নেওয়াই ভক্তের লক্ষ্মণ। এখানেও মেরুদন্ড খুঁজতে হবে।

( শেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *