পর্ব: ১৯
করোনা সময়কাল। হঠাৎ একদিন সকালে ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধু কুণাল ঘোষের ফোন। কুশল বিনিময়ের পর কুণাল জানালো বাড়িতে যখন বন্দী।, তখন একটা গবেষণামূলক লেখা লিখুন। আমি ই বুকে প্রকাশ করব। বিষয়টি সেই নির্বাচন করে দিল। বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাস। শুনেই চমকে উঠেছিলাম। কাকে দিচ্ছ রাজার পার্ট। আমি সামান্য এক ক্ষুদ্র সাংবাদিক। এই বিশাল ব্যাপ্তির কাজে হাত দেওয়া মানে সাপের গর্তে হাত ঢোকানো। তবু অনড় কুণাল। ওঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার হাজার যোজন দূরের সস্পর্ক। কিন্তু কলকাতায় যখন কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব ছিল না তখন কলকাতা দূরদর্শনে বেসরকারি প্রযোজনায় সংবাদ ম্যাগাজিন তৈরির দুঃসাহস তো দেখিয়েছিলাম কুণালের মত তৎপর সাংবাদিককে পাশে পেয়েছিলাম বলে। বাংলার টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যদি পত্তন করতে পারি সাফল্যের সঙ্গে, তবে এই কাজটাও পারব ।। সবচেয়ে বড় কথা,, এই লেখায় আমার কৃতিত্ব নেই। আমার কাজ তো তথ্য সংগ্রহ করে মালা গাঁথা। করোনা প্রবাহে শুরু করেছিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম বাংলার ঐতিহাসিকদের বহুলাংশই উচ্চবর্ণের মানুষ। ফলে ভূমিপূত্র বাঙ্গালির ইতিহাস, সংস্কৃতি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই আমার তথ্য খোঁজার কাজটা হলো গোয়েন্দার সূত্র খোঁজার মত।
সেই খুঁজে পাওয়া তথ্য যদি বাঙালির কোনো কাজে লাগে সেই আশায় পর্ব অনুযায়ী পরিবেশন করতে চলেছি। শুধু প্রশংসা নয়,সমালোচনাও চাই। তবে তো নিজের ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধন করত পারবো। বিষয়টি যেহেতু কুণাল ঘোষের অনুপ্রেরণায় তাই লেখাটি তাঁকেই উৎসর্গ করছি।
সেন বংশের পরাজয়।
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কারণ ছাড়া কার্য হয় না। বাংলায় বাহুবলে বখতিয়ার খিলজি সেন বংশের পতন ঘটান, একথা সত্যি। কিন্তু সেনবংশের পতনের আরও কিছু যে কারণ ছিল আগেই বলেছি। এখন জানাবো,সেন রাজত্বে দুর্নীতিও ছিল পতনের এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রাবন্ধিক দুর্গাপ্রসাদ মজুমদার লিখেছেন, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষার্ধে বাংলার সেনবংশের রাজা, রাজপুরুষ, রাজকর্মচারী, আধিকারিকেরা দুর্নীতি, অনাচার, ব্যভিচার ও কুসংস্কারের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ঐশ্বর্য্যবিলাস, শৃঙ্গারবিষ্টতা, কামবিলাস, কামবাসনা ইত্যাদির মধ্যেই তারা রাজকর্ম ও রাজধর্ম পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। লক্ষ্মণ সেনের পিতা বল্লালসেন বণিকজাতকে অস্পৃশ্যের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন অত্যন্ত অন্যায়ভাবে। দূর্গাপ্রসাদ লিখেছেন, শেখ_শুভোদয়ার একটি গল্পে দেখা যায় যে, লক্ষণসেনের এক তথ্য বলছে, লক্ষণসেনের এক শ্যালক রাণী বল্লভার এক ভ্রাতা কুমার দত্ত এক বণিকবধূর উপরে পাশবিক অত্যাচার করতে উদ্যত হয়েছিল। বণিকবধূ মাধবী অবশ্য লক্ষ্মণসেনের প্রখ্যাত সভাপণ্ডিত গোবর্ধন আচার্যের দুঃসাহসী হস্তক্ষেপে সুবিচার পেয়েছিলেন।,,,,,,,,, আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত বণিকজাতই যখন তাদের গৃহবধূর মর্যাদা রক্ষার জন্য লক্ষ্মণসেনের এক সভাপণ্ডিতের সক্রিয় সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হযেছিল, তখন দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্নবর্ণ ও নিম্নজাত তাদের ধনসম্পত্তি ও নারীর মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে কি অসহায় অবস্থায় পড়েছিল সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়।
এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক ড: অজিত কুমারদাসগুপ্ত ভারতইতিহাসের বর্ণপ্রথা’ (পাণ্ডুলিপি, কলকাতা) গ্রন্থে লিখেছেন, “বিবেচ্য যুগে সমাজে নারীর স্থান কিরূপ ছিল সে বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে এই প্রসঙ্গে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে গৌড়রমণীদের মৃদু শান্ত, সুভাষিণী এবং সুন্দরী বলা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ চিত্র, কিন্ত বাস্তবে তার সঙ্গে সঙ্গতি ছিল না। পবনদূত কাব্য থেকে মনে হয় যে, লক্ষ্মণসেনের রাজধানীতে পর্দাপ্রথা বিশেষ ছিল না । কিন্তু বাৎসায়নই অন্যত্র বলেছেন যে,রাজঅন্তঃপুরে মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন। মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল না এমন নয়।
পবনদূতে মেয়েদের প্রেমপত্র রচনার কথা আছে।আইনের চোখে মেয়েদের নিজস্ব স্বাধীনতা বিশেষ ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে নারীর পাতিব্রতের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। জিমূতবাহন,পুত্রের অবর্তমানে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর বৈধ অধিকারের কথা বলেছেন। অবশ্য এই সম্পত্তি মেয়েরা হস্তান্তরিত করতে পারতেন না । সাধারণভাবে এক পত্নী গ্রহণই নিয়ম ছিল। তবে উচ্চ কোটির পরিবারের এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে বহু বিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। অনুরূপ ভাবে সবর্ণ বিবাহই ছিল । কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ একবারে নিজস্ব ছিল না। সমতটরাজ লোকনাথের মাতামহ কেশবের পিতা ব্রাহ্মণ ছিলেন,কিন্তু মা বোধ হয় ছিলেন শুদ্রকন্যা।,,,,,,,” (পৃষ্ঠা ৮৮/৮৯)
লক্ষ্মণ সেনের আমলে প্রথম ব্রাহ্মণ্যবাদী বৃহধর্ম পুরাণে বর্ণভেদের নিষ্ঠুর প্রথার সূত্রপাত।
মূলত বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড: রমণীমোহন দেবনাথ অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও একটি গ্রন্থ লেখেন ‘বঙ্গদেশে ধর্মীয় সমাজ ইতিহাস ও বিবর্তন ‘ (নবযুগ প্রকাশনী)। তিনি লিখেছেন,প্রাক_পাল আমলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একদিকে যেমন বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় আগমন শুরু হয়, তেমন বর্ণভেদ প্রথা চরম আকার নিতে শুরু করে। পাল আমলে যা বৃদ্ধি পায়। এরপর বল্লালসেনের আমলেই রচিত হয়, বৃহধর্মপুরাণ ।সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ মেলে বাঙালি হিন্দুর জাতি বিন্যাস।ফলে দেশীয় জনগন উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বিভাজন বিদেশি শক্তির বাংলা প্রবেশ সহজ করেছে।প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের লেখক শওকত আলী লিখেছেন, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজনে’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ।সেখানে তিনি বলেছেন,বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের অত্যাচার, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রতি অত্যাচার,সামন্ত প্রভুদের স্বেচ্ছাচারী নীতি,লক্ষ্মণসেনের যোগ্য উত্তরসূরির অভাব,মুসলিম সুফি সাধকদের প্রতি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আকর্ষণ ছিল সেন সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। সামন্তপ্রভুরা সাধারণ প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের জন্য অমানুষিক অত্যাচার করত।
লক্ষণ সেন তাঁর রাজত্বের সময় থেকেই কোনও যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াননি। ফলে তাঁর সৈন্যবাহিনী বিলাসে ব্যসনে ও নিম্নবর্ণের নারী ধর্ষণে নিমগ্ন হয়ে পড়ে।তাই বখতিয়ার খিলজির সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ পেরে ওঠেনি। প্রতিরোধের শুরুতেই তারা আত্মসমর্পণ করে খিলজির সেনাদের কাছে। অনেকে বলেন,লক্ষ্মণসেন শৈব ধর্ম ছেড়ে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়া অহিংস পথে চলার শপথ নেন।ফলে শত্রু বিজয়ের জন্য সেনা বাহিনীকে সংগঠিত না করে যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞ যে কাজে আসেনি বখতিয়ারের বঙ্গবিজয় সেকথাই প্রমাণ করে। অবশ্য কিছু কিছু ঐতিহাসিকেরা বলেছেন,বখতিয়ার বাংলা দখল করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেতে চাননি। উদ্দেশ্য ছিল লুঠ। সেটাই তিনি করেছেন। বণিকের ছদ্মবেশে লক্ষ্মণসেনের রাজধানী আক্রমণ করেন।তিনি কিন্তু বাংলায় থাকেননি।লুঠ করে ফিরে গেছেন।(চলবে)
বাংলার বৌদ্ধধর্মের পতনের অন্যতম কারণ লক্ষ্মণ সেনের বৌদ্ধ হত্যা।
পরবর্তী পর্ব , আগামী রবিবার ১৩ জুলাই