*
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : প্রায় নিঃশব্দে নীরবে পালিত হচ্ছে কবি নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মদিন। বাঙালি তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে বরণ করেছে। ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি চর্চায় থেকেছে। কিন্তু যতটা নজরুলের সম্মান প্রাপ্য ছিল তা কি তিনি পেয়েছেন? প্রশ্নটা থেকেই যায়। নজরুল একটি আরবি ইসলামিক শব্দ। যা মুসলিম সমাজে পুরুষ সন্তানের নাম হিসেবে ব্যবহার হয়।শব্দের আরবি অর্থ নিদর্শন। নজরুল তাঁর নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছেন জীবনের কর্মধারায়। জন্ম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪ মে ১৮৯৯ সালে। বাংলা তারিখ ১১ই ১৩০৬ সন। পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম। নজরুল ছিলেন পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান। চার পুত্রের মৃত্যুর পর জন্ম বলে তাঁর ডাকনাম হয় দুখু মিয়া। ডাকনাম তাঁর আরও ছিল। কেউ ডাকতেন ক্ষ্যাপা।কেউ নুরু। কেউবা নজর আলী। স্কুল জীবনে মেধাবী নজরুলের মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি ছিল। জীবনের প্রথম কবিতা লেখেন স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক ভোলানাথ কর্মকারের বিদায় উপলক্ষ্যে। দিনটি ছিল ১৩ জুলাই ১৯১৬ সাল। কবিতাটি নিজেই পাঠ করেন। নাম করুণ গাঁথা। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় লেখেন স্থানীয় এক ঘটনার প্রেক্ষিতে কবিতা ক্ষমা। এই কবিতাটি অনেক পরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমেদ মুক্তি নাম দিয়ে ছাপেন একটি ত্রৈমাসিক মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় ১৯২১ সালে।
নজরুলের প্রথম প্রেমিকা নার্গিস ছিলেন নজরুলের বাঁশির সুরে মুগ্ধ।
নজরুলের জীবনে প্রথমপ্রেমও এসেছিল স্বাভাবিক ভাবেই। আকবর নামে এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের কুমিল্লায় গিয়েছিলেন নজরুল। খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন। ছেলেবেলায় লেটোর দলে নামও লিখিয়েছিলেন। সেখানে বাঁশি বাজাতেন। আকবরের দিদির বাড়িতে ছিল রাত্রিবাস। সেখানে বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে জোৎস্না রাতে বাঁশি বাজিয়েছিলেন নজরুল। সেই বাঁশির সুরে মজলেন আকবরের ভাগ্নি নার্গিস। নজরুলও মুগ্ধ হলেন নার্গিসের রূপে।
সম্পর্ক আরও বাড়ল। কবি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আকবরের কাছে। তিনি নিকা করতে চান নার্গিসকে। সবাই রাজি। বিয়ের দিন ধার্য হয় ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ়। কিন্তু আকবরের এক শর্তে বেঁকে বসেন নজরুল। শর্ত ছিল, ঘরজামাই থাকতে হবে। বিনিময়ে পাবেন মোটা টাকা। আসলে আকবরের ছিল প্রকাশনার ব্যবসা। তার ফন্দি ছিল, নজরুলকে হাতের মুঠোয় রেখে বিভিন্ন রচনা নজরুলকে দিয়ে করিয়ে নিজের ব্যবসা বাড়ানো। নজরুল তখন বোঝেননি আকবরের চাল। বিয়ে হয় ১৯২১ সালের ১৮ জুন। ফুলসজ্জার রাতেই সেই শর্ত শুনে নজরুল বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যান কুমিল্লার বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। বিয়েতে বরযাত্রী ছিলেন বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর মা বিরজাসুন্দরী দেবী। নজরুলের বিয়ে নিয়ে পরের বছর অর্থাৎ ১৩২৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় বিরজাসুন্দরীদেবীর নৌকা পথে নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়।সেই লেখায় তিনি এই বিফল বিয়ে প্রসঙ্গে লেখেন। এই ঘটনার তিনবছর পর নজরুলের বিয়ে হয় কুমিল্লার আশালতা সেনগুপ্তের সঙ্গে। বন্ধু বীরেন্দ্রকুমারের খুড়তুতো বোন । আশালতা সম্পর্কে বিরজাসুন্দরীর দেওরের কন্যা। নজরুল বীরজাসুন্দরীকে মা বলে ডাকতেন। নজরুল ছিল তাঁর স্নেহের পাত্র। মজার কথা, বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় কিন্তু করিয়েছিলেন সেই আলি আকবর। তবু মুসলিম নজরুলের সঙ্গে আশালতার বিয়ে বিরজা সুন্দরী মেনে নেননি। তাই বাড়ি ছেড়ে আশালতা মা গিরিবালাদেবীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। আশালতা কবির প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর কবিতা শুনে। ১৯২৪ সালে ২৪ এপ্রিল বিয়ে হয় বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজী লেনে। নজরুল কিন্তু আশালতাকে মুসলিম হতে বলেননি। এই বিয়ের খরচ বহন করার দায় নেন শিশির ভাদুড়ি। তিনি তাঁর এক রাতের অভিনয় থেকে অর্জিত অর্থ নজরুলের হাতে তুলে দেন। আবার এমনও ঘটলো, মুসলিম হয়ে হিন্দু মেয়ে বিয়ের অপরাধে প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর লেখা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। অনেকে বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি নাকি বাংলার ঐতিহ্য। কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপন করাই ছিল।শুনলে লজ্জা লাগে, নজরুল প্রথম যখন কলকাতা এলেন, উঠেছিলেন এক মেসে। সেই রাত্রে মেসের হিন্দু বোর্ডার আর রান্নার ঠাকুর যখন জানলেন, নতুন অতিথি এসেছেন মুসলিম। সকলেই আপত্তি জানালেন। মেস মালিক বাধ্য হয়ে পরেরদিন সকালে মেস ছাড়তে বলেন। বন্ধুবর কমিউনিস্ট পার্টির মুজাফফর আহমেদ তাঁকে নিয়ে আসেন মির্জাপুর স্ট্রিট অধুনা সূর্য সেন স্ট্রিটের এক মেসে।
স্ত্রী ও দুই পুত্রসহ নজরুল।
এরপর কেটে গেছে ১৬ টি বছর। ১৯৩৬ সালে সেই প্রথম বিয়ে ইসলামিক নিয়মে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।১৯২৭ সালে নার্গিস এক চিঠি লেখেন নজরুলকে। নজরুল সে চিঠির উত্তর দেন কবিতায়। একটি চিঠিও লেখেন ।1কল্যানীয়াসু,তোমার পত্র পেয়েছি, সেদিন নববর্ষার নবঘন সিক্ত প্রভাতে। মেঘমেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনেরো বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো ………… তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা, কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমিই এই আগুনের পরশমনি না দিলে i অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না, আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।,,,,,,,,,তুমি আমায় জানবার যথেষ্ট সুযোগ পাওনি, তাই একথা লিখেছ,,,, যাক তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী। কাজেই তোমার উমেদার অনেক মিলবে। তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।,,,,,আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ, তাই তাকে পেতে চাইনে। জানি নে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হবো । অধিকতর বেদনা পাবো, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি। ,,,,,,,,, যেখানেই থাকো, বিশ্বাস করো,আমার অক্ষয় আশীর্বাদী কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও এই প্রার্থনা। আমার যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো,আমি তত মন্দ নই এই আমার শেষ কৈফিয়ত। ইতি নিত্য শুভার্থী নজরুল ইসলাম। পুন: আমার চক্রবাক নামক কবিতা পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটুক্তি ছিলো। ইতি জেন্টেলম্যান।
নজরুলের চার প্রেমিকা।
আশালতাকে বিয়ে করে কবি তাঁর নাম দেন প্রমীলা। আহলে হাদিস মতে বিয়ে করায় প্রমীলাকে মুসলিম হতে হয়নি। যতদূর সম্ভব মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্য’র অনার্য চরিত্র’ প্রমীলার মুক্তি চেতনায় কবি নজরুল প্রভাবিত ছিলেন। প্রমীলার মা গিরিবালাদেবী সংস্কার মুক্ত ছিলেন, তাই মেয়ের বিয়েতে তিনি দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেন। দরিদ্র জামাই নজরুলকে প্রায় ২২ বছর আগলে রাখেন গিরিবালাদেবী। একটা সময় এমন গেছে দারিদ্রের কারণে টালাপার্কের বাড়িতে ঘরের কাঁসার বাসন বন্ধক দিয়ে চাল কিনতে হয়েছে। প্রতি পদে মুসলিম হওয়ার কারণে অপমানিত হতে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া এক ভরি ওজনের সোনার পদক বারবার বন্ধক দিতে হয়েছে। কবি যখন অসুস্থ তখন তাঁর মলমূত্র সাফ করার দায়িত্বও সামলেছেন মহীয়সী শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবী। সে ইতিহাস উপেক্ষিত । কবিতার প্রেমেই প্রমীলা দেবীর আকর্ষণ নজরুলের প্রতি। মুজাফফর আহমেদ তাঁর জীবনীতে লিখেছেন, কবি নতুন গানের সুর করে প্রথম শোনাতেন স্ত্রীকে। পরে সুর ভুলে গেলে প্রমীলা দেবী শুধরে দিতেন। ১৯৬২ সালে পক্ষাঘাতে মারা যান প্রমীলা। অসুস্থ শরীর নিয়েও নজরুলের জন্য নিজের হাতে রান্না করতেন প্রমীলা। নজরুলের এক ভয়াবহ দারিদ্রের সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি, সেই গ্লানি নিয়েই প্রমিলাদেবী চোখ বোজেন।
শেষ জীবনে নজরুল
সময়টা ১৯৪২। জুলাই মাস । ৯ তারিখ। বেতার কেন্দ্রে ডাক পান নজরুল ছোটদের গল্প শোনাতে। হঠাৎ সেখানে জিভে আড়ষ্টতা। বন্ধু সাহিত্যিক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় চাকরি করতেন বেতারে। তিনি নজরুলকে বাড়ি মিতে এলেন। একদিকে দারিদ্র্য,পাওনাদারের জ্বালা।অন্যদিকে রোগের চিকিৎসার টাকার অভাব। পুত্র কাজী সব্যসাচীকে দিয়ে অর্থ সাহায্যের চিঠি পাঠান বন্ধু সাহিত্যিক জুলফিকার হায়দারকে। ফজলুল হক, সুরাবর্দি প্রমুখ বাংলার নেতাদের কাছে সাহায্য চাইলেন। নেতাদের বললেন। কোনো সাহায্য মিলল না।শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শুনে পাঁচশো টাকা পাঠালেন। বিধান রায়কে বলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। মধুপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দুমাস রাখলেন । ফিরে এলেন নজরুল অনেকটাই সুস্থ হয়ে। কিছু মারোয়ারি ও কাবলিওলার কাছে নজরুলের ততদিনে ধার হয়ে গেছে চিকিৎসা খরচ বাবদ ৭ হাজার টাকা। যে ফজলুল হকের কাছে নজরুল অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন,একদিন সেই হক সাহেব নজরুলের সাহায্য প্রার্থী হয়েছিলেন। ঘটনাটা ছিল, একসময় মুসলিম লীগের সমর্থকরা ফজলুল হকের সমর্থকদের রাস্তায় বেরোতে দিতেন না।নজরুলের সাহায্য চান ফজলুল। পথে নামেন বুক চিতিয়ে নজরুল। মুসলিম লীগের ছেলেরা শান্ত হলো। সেই সময় ভাষণ দিয়ে ফজলুল হক বলেছিলেন, কাজীর এই ঋণ শোধ করতেই হবে। নজরুলের মুসলিম লীগ অসন্তোষ দমনে কোয়ালিশনের সরকার তৈরিতে সুবিধে হয়। অথচ নজরুল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে বলছেন,_ সেই হক সাহেবের কাছে যখন টাকা চাইলাম, তিনি বললেন ,কিসের টাকা? ফিরে এলাম। আর যাইনি। শুধু ভরসা ছিল আপনাকে। কোয়ালিশন সরকারে আমি অন্তর থেকে শুধু আপনাকেই শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি আর কাউকে না। আমি জানি , আমরাই এই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবো। বাঙালি আপনাকে আর সুভাষকে মনে রাখবে। আমি জানি, হিন্দু _মুসলিম ইকুইয়িটি ফান্ড থেকে ঋণ মুক্তির টাকা পাবো আপনার কথা মিথ্যে হবে না। পাঁচশ পেয়েছি । বাকি পাঁচশ দ্রুত মধুপুরে নিয়ে আসবেন। কোর্টের ডিগ্রির টাকা দিতে হবে। তিন চারমাস দিতে পারিনি।তারা হয়ত বডি ওয়ারেন্ট বের করবে।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নজরুল শ্রদ্ধা।
এরপর সময় যত এগিয়েছে ,নজরুলের অসুস্থতা তত বেড়েছে। দ্রুত অসুস্থতার কারণ নিঃসন্দেহে দারিদ্র্য,চিকিৎসার অভাব। একবার নজরুল যখন চেতনা লুপ্ত হয়ে পড়েন, খবর পেয়ে সাহায্য কমিটি লুম্বিনী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। বিধান রায় দেখে বললেন, রোগমুক্তির সম্ভবনা নেই। তবে স্বাস্থ্য ভালো। তাই মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। ১৯৫২। সবাই আবার নড়ে চড়ে বসলেন। স্ত্রী সহ নজরুলকে পাঠানো হলো লন্ডন। সেখানকার ডাক্তাররা বলেন,দেরি হয়ে গেছে । আরও আগে এলে রোগীকে সুস্থ করা যেত । বলতে গেলে বাঙালি সমাজের অবহেলায় কবির চিকিৎসা রুদ্ধ হয়েছিল।
নজরুল কতটা ধর্মীয় সংস্কারের উর্ধ্বে ছিলেন তার প্রমাণ তিনি তাঁর চার সন্তানের নাম রাখেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ। জীবনে নজরুল আবার প্রেমে পড়েছিলেন। কন্যার নাম ফজিলাতুন্নেসা। মেয়েটি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নজরুল গিয়েছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সভায়। সেখানেই এই কন্যার প্রেমে পড়েন বিদ্রোহী কবি। বন্ধু অধ্যাপক মোতাহার হোসেন মারফত ফজিলার কাছে প্রেমপত্র পাঠান।কিন্তু সে প্রেম ছিল একতরফা। ফজিলা প্রত্যাখ্যান করেন সেই প্রেম। মনের দুঃখে কলকাতায় ফিরে নজরুলের বিরহের অনেক কবিতা গানের উপাদান হন ফজিলা। সময়টা ছিল ১৯২৮। এরপর নজরুল প্রেমে পড়েন রানু সোমের। পরবর্তী সময়ে যিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী সাহিত্যিক প্রতিভা বসু। প্রতিভা ওরফে রানুকে নজরুলগীতি গান শেখাতেন দীলিপ রায়। সেই সূত্রে রানুকে গান শেখাতে যেতেন নজরুল। কিন্তু পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে হলো বিবাদ।থানা পুলিশও হলো। তারপর আর বিষয়টা বেশিদূর এগোয়নি।অনেকে বলেন, মাঝে মাঝেই বেপাত্তা হয়ে যেতেন বোহেমিয়ান নজরুল। ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলতেন, নজরুলকে পাওয়া যাবে কাননদেবীর বাড়িতে। জিনিয়াসরা প্রেমে পড়বেন সেতো ইতিহাসে বারবার প্রমাণ মিলেছে। নজরুলের রাজনীতি যোগ নিয়ে এবার দেখা যাক।
১৯২৬ সালে কবি একবার স্বরাজ দলের পক্ষে ভোটে দাঁড়ান ঢাকা বিভাগের মুসলিম কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য পদে। কংগ্রেস থেকে কয়েকজনকে নিয়ে এই দল গড়েছিলেন নজরুল।তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, তিনি নব্বই শতাংশ ভোট পাবেন। সেকথা তিনি বলেছিলেন বাংলার পল্লী কবি জসীমউদ্দীনকে। কিন্তু ভোটে চতুর্থ প্রার্থী হিসেবে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। রাজনীতির পাঠ নজরুল নিয়েছিলেন অনেক ছোট বয়সেই। দেশপ্রেমের টানে দশম শ্রেণীতে পড়তে পড়তেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে নাম লেখালেন ব্রিটিশ সেনাদলে। একসময়ে ফিরেও এলেন। বন্ধু মুজাফফর আহমেদ তখন কমিউনিস্ট আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছেন। বন্ধু নজরুলকে বলেন, তুমি কি কমিউনিস্ট হবে? নজরুল জবাব দেন, সেজন্যেই ফিরে আসা। ফজলুল হকের আর্থিক আনুকূল্যে প্রকাশ হলো সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ। ১৯২০ সালের ১২জুলাই। সেখানেই ১৯২১ সালে মুদ্রিত হয় তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতা। ১৯২২ সালে নজরুল নিজে প্রকাশ করেন তাঁর সম্পাদনায় অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু। বিদ্রোহী কবিকে আশীর্বাণী পাঠান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। ১৯২১ সালের পুজোর ছুটিতে অধ্যাপক শহিদুল্লার সঙ্গে নজরুল শান্তি নিকেতনে আসেন। সেখানেই বিশ্বকবির সঙ্গে বিদ্রোহী কবির প্রথম পরিচয়। নজরুল বিশ্বকবির কাছে একটি কবিতা আবৃত্তির আবেদন করেন। বিশ্বকবি বলেন,সে কি হে, আমি তো তোমার গান আর কবিতা শোনার অপেক্ষায় আছি। নজরুল তাঁকে শোনান অগ্নিবীণার আগমনী কবিতা আর গান। বিশ্বকবি শোনান মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন দিনের স্রোতে। ছোট থেকেই নজরুল ছিলেন অন্ধ রবীন্দ্র ভক্ত। কৈশোরে একবার একজন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলায় নজরুল খেলার মাঠের গোলপোস্ট উপড়ে তুলে তার মাথা ফাটিয়ে দেন।থানা পুলিশও হয়েছিল। বিশ্বকবি ঘটনার কথা কবি মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে শুনে বলেছিলেন, যাক! আমার আর ভয় নেই তাহলে। এরপর থেকে রবিকবি আর নজরুলের সম্পর্ক দাঁড়ায় পিতাপুত্রের মত । একবার পরিচালক নরেশ মিত্র ছবি বানালেন রবীন্দ্রনাথের গোরা। সঙ্গীত পরিচালক নজরুল। সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানায় বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি। অভিযোগ, বিশ্বভারতীর কোনো শিক্ষকের তালিম নেওয়া হয়নি। ফলে ছবিbমুক্তি থমকে গেল। বাধ্য হয়ে প্রযোজক,পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক নজরুল শান্তিনিকেতনে এলেন বিশ্বকবির দরবারে। প্রিন্ট আর প্রজেক্টর মেশিন নিয়ে। কবি সব দেখে শুনে বলেন, কী কাণ্ড বল তো! তুমি শিখিয়েছো আমার গান, ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে। তোমার চেয়ে আমার গান কি ওরা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?
অথচ এমন ঘটনাও ঘটলো, রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হলেন নজরুলের প্রতি। আসলে বাঙালি দুজনকে যতই ঈশ্বরের আসনে বসাক দুজনেই তো ছিলেন মানুষ। দুজনেরই ছিল কিছু সীমাবদ্ধতা। নাহলে বিদ্রোহী কবি একদিকে সাম্যবাদের গান লিখছেন, অন্যদিকে শ্যামাসঙ্গীত। আবার আল্লাহর প্রতি ,কোরআনের প্রতি আস্থা। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কথা হলেই পার্টির শৃংখলা মেনে চলা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ হবে জেনে আর কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লেখালেন না। তাঁর সাম্যবাদী কবিতায় মানবিক দরদ থাকলেও শ্রেণীসংগ্রামের বিচারে উত্তীর্ণ নয়। শোষণকারী ধনীদের তিনি কবিতায় শ্রেণী সংগ্রামের ভীতি না দেখিয়ে দোজখের আগুনে পোড়ার ভয় দেখান। সর্বহারাদের কবিতায় লেখেন, আল্লাহ আমার সহায়। ধনী দরিদ্র জাতপাতের বিরুদ্ধে বলেও লিখেছেন, এক আল্লার সৃষ্টিতে আর রহিবে না কোনো ভেদ । রাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তাঁর ভাবনা নিস্তেজ হয়ে গেল ১৯২৬ সালে নির্বাচনে জনতার কাছে প্রত্যাখিত হওয়ার পর। অথচ পূর্ণ স্বরাজের দাবি ভারতে প্রথম তোলেন মওলানা হসরত মোহানি।বাংলায় প্রথম দাবি তোলেন নজরুল।
রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও বাঙালির পরিচয় ছিল হিন্দু বাঙালি । অর্থাৎ সহজেই চিহ্নিত হয় বাঙালি দুধরনের। হিন্দু, মুসলিম। একবার প্রেসিডেন্সি কলেজে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ এক হিন্দু কবি তাঁর কবিতায় রক্তের বদলে খুন শব্দ ব্যবহার করায় চটে যান কবি। বলেন, এক বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন খুন। পুরাতন রক্ত শব্দে তাঁর কাব্যের রঙ যদি না ধরে, তাহলে বুঝব সেটাতে তাঁর অকৃতিত্ব। শনিবারের চিঠি ও বাঙলার কথা দুই পত্রিকার প্রতিবেদনে বাঙালি হিন্দু কবির বদলে লেখা হলো বাঙালি কবি। এখানেই হলো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের ভুল বোঝাবুঝি।নজরুল ভাবলেন, তিনি অনেক কবিতা গানে খুন শব্দ ব্যবহার করেন বলেই বিশ্বকবির তিরস্কার। বাংলা কবিতায় আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ভেবে নজরুল লিখলেন, বড়’র পিরীতি বালির বাঁধ। আজকের রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই চিরচেনা রবীন্দ্রনাথ নন। তাঁর পিছনের বৈয়াকরণ পণ্ডিত এসব বলাচ্ছে তাঁকে। সেই সময় নজরুলকে এই লেখার জন্য সমালোচিত হয়ে হয়। সজনীকান্ত শনিবারের চিঠিতে লেখেন ছোট’র পিরীতি বালির বাঁধ।
কিন্তু নজরুলের মনে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার প্রমাণ মেলে যখন রবির অস্তাচলের দিনটিতে বেতারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল। সেদিনই তিনি লিখেছিলেন বিদায় কবিতা_ ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না, জাগায়ো না/ সারা জীবন যে আলো দিল, ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না। এর একবছর পর নজরুল নিজেই ফুলের জলসায় নীরব হয়ে যান। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, আর সবকিছু ভাগাভাগি হয়ে গেছে,ভাগ হয়নিকো নজরুল। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? নজরুলের যথার্থ মূল্যায়ন কি হয়েছে? হ্যাঁ। নজরুলের রাজনৈতিক সম্যক চেতনায় সীমাবদ্ধতা ছিল, ধর্মীয় সত্ত্বায় প্রথম জীবনে উদার থাকলেও পরবর্তী সময়ে মুসলিম ধর্মের বিধানে ফিরে যান। এটা তাঁর ব্যর্থতা নয়। সীমাবদ্ধতা । সেই সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করার প্রাসঙ্গিকতা বোধ হয় আজ অপ্রাসঙ্গিক।