চৈত্র নবমীতেই কি রামের জন্মদিন? পর্ব ২

ব্রাহ্মণের আদেশে রামচন্দ্র কি ভাই লক্ষ্মণ ও ভক্ত হনুমানকে বধ করতে চেয়েছিলেন?

বাল্মীকি রামায়ণে আছে , চৈত্র মাসের নবমী তিথিতেঅভিজিৎ মুহুর্তে রামের জন্ম। এই বছর নবমী তে পুনর্বসু নক্ষত্রে কর্কট লগ্নে অভিজিৎ মুহূর্ত ১২ টা ১৬ মিনিটে । তাঁর জন্ম মুহুর্তে জ্যোতিষ শাস্ত্র বলে রবি ছিল মেষ রাশিতে, মঙ্গল মকর রাশিতে, শনি তুলা রাশিতে বৃহস্পতি ও চন্দ্র কর্কট রাশিতে শুক্র মীন রাশিতে ছিল। এদিকে ইনস্টিটিউট অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ ওন ভেদাসের ডিরেক্টর সরোজ বালা বলেছেন , ঋকবেদ, রামায়ণ মহাভারত থেকে পাওয়া গ্রহ নক্ষত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে অঙ্ক কষে বের করেছেন রামচন্দ্রের জন্মদিন। এই অনুষ্ঠানে তো হাজির ছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী! তাহলে কিসের ভিত্তিতে চৈত্র নবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন পালন হচ্ছে?

বাল্মীকি রামায়ণে নেই এমন বহু ঘটনা বাংলার রামায়ণে প্রথম যুক্ত করেন কৃত্তিবাস মুখার্জি ওরফে কৃত্তিবাস ওঝা

শুধু জন্মদিন নিয়ে বহু মত ছাড়াও রামায়ণের কাহিনী নিয়েও বিতর্ক আছে। বাল্মীকি রামায়ণে নিই এমন বহু তথ্য কৃত্তিবাস লিখেছেন নিজের মনের মাধুরী দিয়ে। তথ্য বলছে, তিনিও মাত্র একটি অধ্যায় লেখার পর প্রয়াত হন। তারপর তাঁর এক আত্মীয় বাকি রামায়ণ লেখেন। ফলে বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে বহু পার্থক্য থেকে গেছে। অহিরাবণ , মহীরাবণের পাতাল ঘটনা, বীরবাহুর বীরত্ব ও যুদ্ধ , তরণীসেন কাহিনী, অকাল বোধন , হনুমানের রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ, সীতার রাবণ মূর্তি অংকন, মৃত্যু মুহূর্তে রামকে রাজ ধর্ম পালনের পরামর্শ, রামের সঙ্গে লব কুশের যুদ্ধ কৃত্তিবাস কোথায় পেলেন? এসব কি বাল্মীকি রামায়ণে আছে? রবীন্দ্রনাথ কি তাই লিখেছিলেন, সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে করি তব মনোভূমি , রামের জন্মস্থান অযোধ্যার ছেয়ে সত্য জেনো। সরি মিথ্যা প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন এক সত্য রামায়ণের কথা বলি।

দক্ষিণী ব্যক্তিত্ব পেরিয়ার সামী সত্য রামায়ণ গ্রন্থে রামায়ণের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

১৯৪৪ সালে তামিল পত্রিকা কুদি আরাসুতে ১৬ ডিসেম্বর সংখ্যায় লেখা হয় ১৯৪৪ সালে গ্রন্থটি প্রথম তামিল ভাষায় প্রকাশ ।১৯৫৬ সালে গ্রন্থটির একটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তামিল সংস্করণ প্রকাশ করে দ্রাবিড় কাঝাকম।১৯৫৯ সালে এই সংস্করণের প্রথম ইংরেজিঅনুবাদ প্রকাশিত হয়। দি রামায়ণা এ ট্রু রিডিং।১৯৬৮ সালে প্রকাশ হিন্দি অনুবাদ সচ্চি রামায়ণ প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করেন উত্তরপ্রদেশের জাতপাত বিরোধী দলিত মূলনিবাসী আন্দোলনকারী ললই সিং যাদব বইটি অনুবাদ করেন রাম আধার।১৯৬৯ সালে ডিসেম্বর মাসে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন চন্দ্রভানু গুপ্তের মুখ্যমন্ত্রীত্বে গঠিত রাজ্য সরকার গ্রন্থটির ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করে বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যুক্তি ভাবাবেগে আঘাত।

লেখক ও প্রকাশক রাজ্য সরকারের আদেশের বিরূদ্ধে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতে ও শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন। অনেক লড়াইয়ের পর ১৯৭৬ সালে ১৬ জানুয়ারি শীর্ষ আদালতের নির্দেশে বইটি মুক্তি পায়। শীর্ষ আদালতের রায় উপেক্ষা করে রাজ্য সরকার নিজেদের অবস্থান থেকে সরে না।১৯৯৫ সালে উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টির সরকার প্রতিষ্ঠা হলে মায়াবতী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীদের হামলার ভয়ে বইটির প্রকাশ কাজে পিছিয়ে যান। তখন অল ইন্ডিয়া ব্যাকওয়ার্ড অ্যান্ড মাইনরিটি কমিউনিটি এমপ্লয়িজ ফেডারেশন বইটি প্রকাশ করে ।২০০৭ সালে হিন্দুত্ববাদীরা আবার বইটির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করলে মায়াবতী সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেয় সরকারের সঙ্গে বইটির প্রকাশকের কোনো ভূমিকা নেই। সংসদীয় রাজনীতিতে উচ্চ বর্ণের ভোটের আশায় যে দলিত সরকারের নিরপেক্ষ সাজা সেকথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

দুয়ারে পাহারারত লক্ষ্মণ। ক্রোধে মত্ত ঋষি দুর্বাসা

২০২০ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আমলে বইটির নতুন হিন্দি সংস্করণ প্রকাশ করেন সাংবাদিক অশোক ঝা। সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক প্রমোদ রঞ্জন। পেরিয়ার বইটিতে বলেছেন, ব্রাহ্মণ্য হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা রচিত এই সকল পুরাণ গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়, এগুলি আসলে একটি বর্ণবিভক্ত উচ্চ নীচ অংশে বিভাজিত সমাজ সংস্কৃতির জন্ম দিতেই রচনা করা হয়েছে।,,,,,,, পুরাণগুলিতে কুৎসিত ভাবে লাম্পট্য দুষ্কর্ম চরিত্রহীনতা, অন্যায় হত্যা ও অসভ্যতার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। বাঙালি যদি বইটি সম্বন্ধে বিশদ জানতে চান তাহলে সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়ের সত্য রামায়ণ ও অন্যান্য রচনা বইটি সংগ্রহ কর পারেন। বইটির প্রকাশক ডুংরি , প্রকাশক শুভ নাথ। ফোন ৬২৯০০২৭৫৪৭।

রামকে ভ্রাতৃহত্যার দায় থেকে মুক্ত করতে লক্ষ্মণ নিজেই সরযূ নদীতে আত্মহত্যা করেন

বাল্মীকি রামায়ণে ফেরা যাক। রাম যে হনুমান আর লক্ষণকে হত্যা করার সংকল্পও নিয়েছিলেন সে কথা রামায়ণে উল্লেখ আছে। পুরাণ বলছে, রামের পরম ভক্ত হনুমান। হনুমান কে? যুক্তির নিরিখে বলা যায়, রাম সূর্যবংশীয় আর্য পুত্র। হনুমান আদতে অনার্য । ভারতের ভূমিপুত্র। সুতরাং হনুমানকে রামের ভক্ত না বানালে আর্য সংস্কৃতির পদতলে অনার্য সংস্কৃতির বশ্যতার প্রতীক স্থাপন হয় কী করে? বিষয়টি যে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধও আছে। বিশ্বভারতী সাহিত্য ১৪০১ সাহিত্য সৃষ্টি প্রবন্ধে ১০৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদিগকে দলে লইয়া বহুদিনের চেষ্টায় ও কৌশলে ( এই) দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন, এই কারণেই তাহার গৌরব গান আর্যদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল।’ একবার নারদ লক্ষ্য করেন, বিষ্ণুর অবতার রাম তাঁর চেয়ে হনুমানকে বেশি স্নেহ করছেন। তাই লঙ্কাজয় করে রাম ফিরে এলে কূলগুরু বিশ্বামিত্রসহ বহু ঋষি যখন আসেন রামকে অভিনন্দন জানাতে, রামচন্দ্র তাঁদের সেবার ভার দেন হনুমানকে। নারদ হনুমানের কাছে গিয়ে জানান, বিশ্বামিত্র ঋষি হনুমানের বিরুদ্ধে রামের কান ভারি করছেন। সুতরাং অন্য ঋষিদের আপ্যায়ন করলেও হনুমান যেন বিশ্বামিত্রকে অবজ্ঞা করেন। সরল আদিবাসী হনুমান নারদের কথা বিশ্বাস করে বিশ্বামিত্রকে অবজ্ঞা করেন। অপমানিত বিশ্বামিত্র রামকে আদেশ দেন, হনুমানকে প্রাণদণ্ড দিতে। গুরুর আদেশ মেনে রামচন্দ্র হনুমানকে বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। নারদ বেগতিক দেখে বিশ্বামিত্রকে আসল কথা জানিয়ে হনুমানের প্রাণরক্ষা করেন। লক্ষ্মণকেও রামচন্দ্র বধের সিদ্বান্ত নিয়েছিলেন। সেও এক ব্রাহ্মণের আদেশে। সেই ঘটনা জানা যাক।

ভুলের অনুশোচনায় রামচন্দ্র পর্যন্ত সরযূ নদীতে আত্মহত্যা করেন।

সীতার পাতালে প্রবেশের ( আত্মহত্যা?) পর রামচন্দ্র রাজত্ব করছেন অযোধ্যায় । যমরাজ বুঝলেন রামের মর্তে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই ব্রাহ্মণ ঋষির ছদ্মবেশে গেলেন রামের সঙ্গে দেখা করতে।l লক্ষ্মণ তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন রামের বিশ্রাম কক্ষে। ছদ্মবেশী যমরাজ রামকে বলেন তিনি কিছু জরুরি আলোচনার করতে এসেছেন।আলোচনাকালীন ঘরে যেন তৃতীয় কারো অনুপ্রবেশ না হয়। যদি কেউ ঘরে ঢোকে রাম যেন তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রাম রাজি হলেন। বাইরে পাহারায়l লক্ষ্মণ। যমরাজ রামকে বলেন তাঁর মর্তে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। রাবণ বধ হয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে অসহিষ্ণু ঋষি দুর্বাসা এসে উপস্থিত হন রামের সাক্ষাতপ্রার্থী হয়ে। লক্ষ্মণ তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। দুর্বাসা শোনার পাত্র নন। লক্ষ্মণ বহু চেষ্টাতেও বিফল হন। দুর্বাসা বলেন তাঁর পথরোধ করলে তিনি রঘু বংশ বিনাশের শাপ দেবেন। বাধ্য হয়ে লক্ষ্মণ রামের ঘরে প্রবেশ করেন দুর্বাসা ঋষির আগমন সংবাদ দিতে। লক্ষ্মণ ঘরে প্রবেশ করতেই যমরাজ অসন্তুষ্ট হয়ে অদৃশ্য হন। রাম পড়লেন দ্বিধায়। চিরসাথী ভাইকে কি করে মৃত্যুদণ্ড দেন? কুলগুরু বশিষ্ঠের পরামর্শ চান। কুলগুরু বিধান দেন লক্ষ্মণকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাম তাই করলেন
লক্ষ্মণ অযোধ্যা থেকে বিতাড়িত হয়ে বোঝেন রাম ছাড়া তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তিনি সরযূ নদীতেআত্ম বিসর্জন দেন। এই কাহিনী থেকে পরিস্কার , ব্রাহ্মণের কথা শিরোধার্য করেই ক্ষত্রিয় রাজাদের চলতে হত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *