সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ১৭ এপ্রিল এবারের রামনবমীর আলাদা তাৎপর্য। কারণ রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা।আবেগে ভাসছেন দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ। পুরাণ মতে রামচন্দ্র ত্রেতা যুগে ১৪ বছরের বনবাসে ছিলেন পিতৃশর্ত রক্ষার্থে। সেটা এখন আর ধর্তব্য নয়। নতুন সূত্র উঠে এসেছে। রামচন্দ্র কলি যুগে পাঁচশ বছরের বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরেছেন । অবশ্য ভাই লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতাকে রেখেই। কোথায় ফিরছেন? নিজের মন্দিরে। যে মন্দির গুঁড়িয়ে গড়া হয়েছিল বিধর্মীদের মসজিদ। সময়টা ১৫২৮। রাম ভক্তদের প্রতিবাদ কিন্তু প্রথম উঠল আরও ৩২৫ বছর পর। এত দেরিতে প্রতিবাদ কেন? ইতিহাস বলছে,১৮৫৩ সালে তৎকালীন বোম্বে অধুনা মুম্বাইতে প্রথম রেললাইন পাতা হয় । পরের বছরই বাংলায়। এর ন বছর পর রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট করে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। বাংলায় অবশ্য ১৮২৭ সালেই প্রথম প্রতিবাদ ধর্মঘটে যান পালকি বাহকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে। সেটাই ছিল দেশের প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। ধান ভানতে শিবের গীত ছেড়ে ফিরি মূল বিষয়ে। রাম মন্দির ধ্বংসের ৩২৫ বছর পর হঠাৎ হিন্দু জাগরণ গড়ে উঠল। বাবরি মসজিদ রাম মন্দির গুঁড়িয়ে তৈরি। এরপর ২৫ বছর।১৮৫৩ সালে ধর্মকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ালো।
এরপর ৯৯ বছর রামভক্তরা আবার শীত ঘুমে। ৯৯ বছর পর ঘুম ভাঙল। বাবরি মসজিদের আশেপাশে কিছু মানুষের ছুটোছুটি শুরু ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। দাবি উঠল মসজিদ থেকে জ্যোতি প্রকট হচ্ছে। সেই জ্যোতি রামচন্দ্র। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবি কিছু হিন্দু লুকিয়ে মসজিদে রামমূর্তি রেখে এসেছে। দাবি পাল্টা দাবি গড়াল আদালত অবধি। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। দেশ গড়ার সময়। কেন্দ্রীয় সরকার বিতর্কিত বিষয় বলে মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর তারিখ পে তারিখ। মামলা চলল। ১৯৮৬ সালে জেলা আদালত মসজিদের দ্বার উন্মুক্ত করে হিন্দুদের উপাসনার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপরের ঘটনার পুনরাবৃত্তির মানে হয় না। কিন্তু যে প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি তা হলো অযোধ্যার কোথায় ছিল রামের জন্মস্থান সেটার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণকিন্তু আজও মেলেনি। শ্লোগান ছিল মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে। কিন্তু মন্দির তৈরি হল বাবরি মসজিদের তিনকিলো মিটার দূরে। তাতে কি? হিন্দুত্বের ধজ্বা তো উড়ল? প্রশ্ন করা যাবে না, তর্কের খাতিরে যদি রামকে বাস্তব চরিত্র ভাবা যায়, সেই সময়ে কি হিন্দু ধর্ম ছিল। রামায়ণ মহাভারতের কোথাও তো হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই।
যাঁকে নিয়ে বিতর্ক তিনি তো মর্যাদা পুরুষোত্তম রামলালা। তিনি হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। পৌরাণিক অভিধান মতে দেবতারা সময়ে সময়ে মানুষের দেহ নিয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেন। পুরাণে বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বলা আছে। আবার পৌরাণিক মতে অবতারের চরিত্র গুণ সাত । পূর্ণাবতার, অংশাবতার , পুরুষাবতার, লীলাবতার, গুণাবতার, মন্বান্তরাবতার, যুগাবতার ও শক্ত্যাবেশাবতার। শ্রী বিষ্ণুর সর্বগুণাবলী নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ আসেন ধরাধামে মানবরূপে। তাই তিনি পূর্ণাবতার। সাংখ্যদর্শন প্রণেতা কপিল অংশাবতার। যিনি ঐশ্বর্য, মাধুর্য, কৃপা , তেজ কারণার্ণশায়ী, গর্ভোদশায়ী, ক্ষীরোদশায়ী। পুরুষাবতার বিষ্ণু তিনটি রূপ ধারণ করেন তিন পুরুষ হিসেবে। তাঁরা হলেন বলরাম ওরফে সংকর্ষণ ও কৃষ্ণ পুত্র প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ। লীলাবতার রাম, পরশুরাম নৃসিংহ, বামন। লক্ষ্য করার বিষয় বিষ্ণুর সর্ব গুণের অধিকারী কৃষ্ণকে বলা হলেও রাম কিন্তু পরের স্তরের অবতার। অন্যতম কারণ কি রামের জন্ম হয়েছিল অভিশাপে? কার অভিশাপে? বিষ্ণুর নামগানকারী দেবর্ষি নারদের অভিশাপে। শিব পুরাণের সৃষ্টি খণ্ডে চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে চিরকুমার নারদ একবার এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে পড়েন। স্বয়ংবর সভায় সুসজ্জিত হয়ে যাওয়ার বাসনায় বিষ্ণুর কাছে তাঁকে সুন্দর মুখশ্রী করে দিতে বলেন। বিষ্ণু রাজি হন। যথাসময়ে স্বয়ংবর সভায় নারদ উপস্থিত হলে তাঁকে দেখে সভায় উপস্থিত রাজকন্যার পানিপ্রার্থিরা এবং স্বয়ং রাজকন্যা নারদকে দেখে হাসতে থাকেন। প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখে চমকে ওঠেন নারদ। তাঁকে দেখতে হয়েছে বাঁদরের মত। রাগে দুঃখে তিনি বিষ্ণুর কাছে গিয়ে এমন মর্মান্তিক রসিকতার জন্য বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন তিনি যেমন স্ত্রী সুখে বঞ্চিত হলেন বিষ্ণুকেও পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে স্ত্রী থাকলেও বঞ্চিত হবেন স্ত্রী সুখে। যে বাঁদরের মুখ তিনি নারদকে দেন সেই বাঁদরদের সাহায্য নিতে হবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। সেই অভিশাপে বিষ্ণুর পৃথিবীতে মানব জন্ম নেওয়া। স্ত্রী বিচ্ছেদ। এমনকি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঁদর সেনার সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়।
পৃথিবীতে জন্ম নিয়েও বিষ্ণু রাম রূপে একই ধরণের অমানবিক মস্করা করেন রাবণের বোন শূর্পনখার সঙ্গে। যার ফলশ্রুতিতে রাবণের সীতা হরণ। শূর্পনখার সংস্কৃতগত অর্থ কুলোর মত নখ। বাল্মীকি যখন তাঁর সৃষ্ট রামায়ণে শূর্পনখার চরিত্র অঙ্কন করেন লেখেন, কুৎসিত চেহারার রাক্ষস নারী। তামিল কাম্বা রামায়ণে বলা হয়েছে শূর্পনখার হাতের আঙ্গুলের নখ ছিল চাঁদের আকৃতির মত। তিনি তাঁর মাতামহী কেতুমতীর মতই সুন্দরী। বনে রাম লক্ষণকে দেখেন তিনি। স্বামী হারিয়ে শূর্পনখা তখন বিরহী। রামকে প্রেম নিবেদন করেন। রামচন্দ্র জানান তিনি বিবাহিত। মস্করা করে তিনি বলেন তাঁর সঙ্গী ভাই লক্ষ্মণ কুমার। সে লক্ষণকে বিয়ে করতে পারে। লক্ষ্মণ বলেন তিনি বিবাহিত। সেযুগে রাবণের রাজত্বে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকায় শূর্পনখার প্রেম নিবেদনকে রাম ও লক্ষ্মণ দুজনেই হাসির খোরাক করেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে অপমানিত নারী অভিভাবক লঙ্কারাজ রাবণকে অভিযোগ জানান। সহোদরার অপমানের বদলা নিতে শত্রুর স্ত্রী হরণ। নারীর মর্যাদার মূল্য বোঝাতেই ছিল রাবণের সীতা হরণ।
পুরুষোত্তম রামের মহান কীর্তির শুরুটা দেখা যাক। ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে রামেরা চারভাই বিদ্যা ও অস্ত্র শিক্ষা করেন। রামের ১২ বছর বয়স পূর্ণ হতে বিশ্বামিত্র ঠিক করেন এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন। এক, রাম কেমন অস্ত্র শিক্ষা করেছেন তার পরীক্ষা নেওয়া। দ্বিতীয়, দন্ডকারণ্য বনে আর্য ঋষিদের আশ্রমে যজ্ঞপণ্ডকারী রাক্ষসী তাড়কাকে বধ করানো। ব্রাহ্মণ হয়ে নারী হত্যার পাপ নিজের কাঁধে না নিয়ে ক্ষত্রিয় সন্তান রামের ঘাড়ে নারী হত্যার পাপ তুলে দেওয়া। রাক্ষসী তাড়কা। এক অনার্য ও আদিবাসী শক্তিশালী যোদ্ধা রমণী। তিনি আর্য ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ পণ্ড করতেন কেন? একটু যুক্তি দিয়ে বোঝার আগে রাক্ষস শব্দের অর্থ জানা প্রয়োজন। রাক্ষস শব্দের অর্থ যিনি রক্ষা করেন। নারী ক্ষেত্রে রাক্ষসী। সাদা চামড়ার আর্য সম্প্রদায় দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের ভূমিপুত্র কালো চামড়ার মানুষদের সম্বোধন করত রাক্ষস, দানব নামে। বৌদ্ধ দর্শন পাঠচক্র প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত এস সি এস টি ওবিসিদের প্রতি ব্রাহ্মণদের কটূক্তি শীর্ষক একটি বইতে লেখক দিলীপ গায়েন লিখেছেন, ভারতে তখন আর্য আক্রমণ ঘটেনি। হরপ্পাবাসী সনাতন ধর্মে ( বস্তুবাদী) শপথ নেওয়ার সময় একপ্রকার রেশমি বস্ত্র পরত। তার নাম ছিল শুদ্রী। আর্যরা পরে পরাজিত হরপ্পাবাসীদের শূদ্র নামে অভিহিত করে। শূদ্র শব্দের অর্থ বিকৃত করে ধরা হয়, নিচ, ক্ষুদ্র, অস্পৃশ্য। চণ্ডাল শব্দের প্রকৃত অর্থ তেজস্বী, প্রচণ্ড তেজী। এই অনার্য সম্প্রদায়কে আর্য ব্রাহ্মণ ডোম মেলেচ্ছ হিসেবে চণ্ডাল শব্দের অর্থের বিকৃতি ঘটায়। তেমনই রাক্ষস শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণের হাতে পাল্টে হয় কাঁচা মাংস খাদক, কুশ্রী, হিংস্র । হিন্দু মতে কোনো নারীকে অপহরণ করে বিয়ে করাকে বলে রাক্ষস বিবাহ। তাহলে ক্ষত্রিয় পুত্র অর্জুন কি করে মামাতো বোন সুভদ্রাকে অপহরণ করে বিয়ে করে? সেটিও তো রাক্ষস বিবাহ। যাই হোক আসল কথায় আসি।
বিজ্ঞাপন
দন্ডকারণ্যে পৌঁছে রামকে কেন প্ররোচিত করলেন শিক্ষাগুরু বিশ্বামিত্র? তাড়কা শব্দের অর্থ যে তাড়না করে। অর্থাৎ সেই আদিবাসী রমণীর আসল নাম বাল্মীকি উল্লেখ করেননি। যেহেতু তিনি আর্য ব্রাহ্মণদের তাড়না করেন তাই নাম দেওয়া হল তাড়কা। কেন এই আদিবাসী রমণী তাড়না করেন? কেন যজ্ঞ পণ্ড করেন? বনাঞ্চল ভূমিপুত্রদের বাসস্থান। ঋষিরা কেউ বনে জন্মান নি। পরবর্তী সময়ে লোকালয় ছেড়ে সুন্দর পরিবেশে ঈশ্বর আরাধনা করার জন্য বনাঞ্চলের গাছ কেটে আশ্রম বানান। যজ্ঞের আগুনের নিত্য কাঠ সংগ্রহ করেন গাছ কেটে। যজ্ঞের আগুনে ঘি দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে বনের পরিবেশ দূষণ করেন। পশু পাখি ধোঁয়া দেখে আগুনের ভয়ে ছোটাছুটি করে। শত কণ্ঠে জোরে জোরে বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণে বনের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেন। এতেই আপত্তি ছিল বনবাসী আদিবাসীদের। তাঁরা বাধ্য হয়ে তাড়না করতেন যেন বনাঞ্চল ছেড়ে বৈদিক ব্রাহ্মণ ঋষিরা চলে যায়। কিন্তু তাঁরা কি চলে যাওয়ার পাত্র? রীতিমত রাজ অনুগ্রহে তাঁদের প্রতিপত্তি। ফলে ক্ষত্রিয় রাজাদের দিয়ে রাক্ষস বধ তো পুরাণের ছত্রে ছত্রে মেলে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য বালক রাম বলেছিলেন, তাড়কা তো আমার কোনো ক্ষতি করেননি। আপনিই তো শিখিয়েছেন নিরপরাধ ব্যক্তির প্রতি অস্ত্রধারণ পাপ। বিশ্বামিত্র জবাব দেন , তাড়কা আমাদের তাড়না করে। তাই সে শত্রু। গুরুদেবের শত্রু বধ করে তুমি গুরুদক্ষিণা দাও। সেযুগে ক্ষত্রিয় রাজারা রাজ্য শাসনের নিরাপত্তার কারণে ব্রাহ্মণ ঋষিদের আদেশ মেনে চলতেন। নাহলে রাজ্যে বিদ্রোহ ঘটাতে ব্রাহ্মণদের জুড়ি নেই। আজও রাষ্ট্র নায়করা যে কারণে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের পুরষ্কার দিয়ে খুশি রাখেন। যাতে জন বিদ্রোহের হোতা তাঁরা না হন। রামচন্দ্র তাই কথা আর না বাড়িয়ে তাড়কা রাক্ষসী (?) কে বধ করেন। বালক রামচন্দ্র জীবনের প্রথম ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করলেন এক নারীকে বধ করে।
সীতা হরণের পর রামচন্দ্র বুঝেছেন , সমুদ্র পেরিয়ে তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় সীতা উদ্ধার। অথচ এই রাম হরধনুর মত বিশাল ভারী ধনুক ভেঙে সীতা জয় করেন। তাঁর দরকার হলো আদিবাসী জনতার। যাঁরা সমুদ্র লঙ্ঘনের ক্ষমতা রাখে। খোঁজ মেলে দক্ষিণ ভারতের কিষ্কিন্ধ্যায় সুগ্রীবের। এক শত্রু বধের জন্য সুগ্রীবের দাদা বালী ঢুকেছিলেন এক গুহায়। অনেকক্ষণ না ফেরায় পাহারারত বাইরে সুগ্রীব ভেবে নিলেন দাদার মৃত্যু হয়েছে। এই ভেবে রাজ্যে ফিরেই বিয়ে করে বসেন দাদার স্ত্রী তারাকে। তারপর রাজত্ব। একসময়ে বালী ফিরে ভাইয়ের কাণ্ড দেখে তাঁকে রাজ্য থেকে বহিস্কার করলেন। এই দুই ভাইয়ের মনমালিন্যকে কাজে লাগালেন রাম। বললেন তিনি তাঁর দাদাকে হত্যা করায় সাহায্য করবেন। বদলে সীতা উদ্ধারে বানর সেনা দিয়ে সাহায্য করতে হবে। সুগ্রীব তো এক পায়ে খাঁড়া। রাম জেনেছিলেন অধিক বলশালী বালীর সঙ্গে মল্লযুদ্ধে সুগ্রীব পেরে উঠবে না। বাধ্য হয়ে গাছের আড়াল থেকে অন্যায় ভাবে বাণ ছুঁড়ে বালীকে বধ করেন ভগবান রাম। বালী এমন অনৈতিক কাজ যে আর্য পুত্র করবেন ভাবেননি। বাল্মীকি লিখছেন , পঞ্চ পঞ্চখা ভক্ষ্যা ব্রহ্ম ক্ষত্রেষু রাঘব, শশকঙ্খ শল্লকী গোধা খড়্গ কুর্মশ্চ পঞ্চমা।।১৬।৩৫, অভক্ষ্যানি চ পঞ্চৈ ব মানি রাম শ্রুতানি মে, শৃগাল শ্চৈব নক্রসছবানার:, কিন্নরো নর: ১৬।৩৬ অর্থাৎ শরাঘাতে মৃত্যুপথযাত্রী বালী বলেছেন, হে রাঘব, পাঁচটি নখর বিশিষ্ট প্রাণীকে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা হত্যা করে খায়। গোসাপ, খরগোশ, সজারু গন্ডার ও কচ্ছপ। কিন্তু নিষিদ্ধ শিয়াল, কুমির, বানর, কিন্নর আর নর। আমি তো বানর। আমায় হত্যা করলেন কেন,? রাম কি জবাব দিয়েছিলেন? রামায়ণে বানর বলে যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে আসলে বনবাসী আদিবাসী সমাজকে আর্যরা ঘৃণা করে বানর নাম দেয়। আমরা যেমন বাঁদর বলে গাল দিই ঠিক তেমনই। এই কথার প্রতিধ্বনি শুনি রবীন্দ্রনাথের লেখায়। বিশ্বভারতী ১৪০১ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য গ্রন্থে তিনি লিখেছেন রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের দলে লইয়া বহুদিনের চেষ্টায় ও কৌশলে ( এই) দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন, এই কারণেই তাহার গৌরব গান আর্যদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল।( পৃষ্ঠা ১০৩, প্রবন্ধ সাহিত্য সৃষ্টি,)। তিনি এই গ্রন্থে ১০৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, রাক্ষসরা অসভ্য ছিল না। বরঞ্চ শিল্পবিলাসে তাহারা আর্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। রামের হাতে নারী নিগ্রহ শুধু তাড়কা নন, ত্রয়োমুখীও হয়েছেন। লঙ্কায় রাবণ বসেছিলেন যুদ্ধে বিজয়ের যজ্ঞে। অঙ্গদ ও বানর সেনারা পৌঁছে লাঞ্চিত করেছে রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীকে চুলের বিনুনি টেনে। তবু রাবণের তপস্যা ভঙ্গ হয়নি। কিন্তু স্ত্রী যখন স্বামীকে তিরষ্কার করে বলেন স্বামী হয়ে স্ত্রীকে রক্ষা না করা রাজার ধর্ম নয়। বাধ্য হয়ে তপস্যা ভঙ্গ করে রাবণ বানর সেনাদের তাড়ান। যদি তিনি তপস্যায় সিদ্ধ হতেন তাহলে কি উল্টো রামায়ণ লিখতে হত?
বিজ্ঞাপন
এবার পুরুষোত্তম রামের বর্ণ বিদ্বেষের দুটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। যা লিখেছেন বাল্মীকি। বনবাসের শুরুতে সরযূ নদী পেরিয়ে গন্তব্য পঞ্চবটি।। পথে মিত্র দলিতরাজ গুহকের এলাকা। সেখানে মিত্রের আতিথ্য গ্রহণ। গুহক তাঁকে ফলমূল আর মাংসের নানা পদ দিয়ে গ্রহণের অনুরোধ করেন। রাম বলেন বনবাসে তন্ডুল জাতীয় খাদ্য তিনি গ্রহণ করবেন না। সামান্য ফল খেয়ে বিদায় নেন। সত্যিই কি রাম বনবাসে ফল ছাড়া খাদ্য গ্রহণ করেননি? দেখা যাক অধ্যাপক কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মহাকাব্যের রসুই ঘরে গ্রন্থে কি লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,,,,,, অযোধ্যা কাণ্ডে (২০/২৯) বনবাসে যাত্রাকালে মাতা কৌশল্যার কাছে শ্রীরাম মনস্থ করেছিলেন যে চৌদ্দ বছর বনে বাসকাল পশুমাংস তিনি আহার করবেন না। কন্দ মূল আর ফল খেয়েই কাটাবেন- চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে। কন্দমূলফলোই ফলৈ র্জীবন হিত্বা মুনিবদ্ আমিষম্। কিন্তু সেই কথা মেনে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। গঙ্গা পার হয়ে সুমন্ত্র আর গুহককে বিদায় দিয়েই গভীর অরণ্যে রাম লক্ষ্মণকে প্রবেশ করতে হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন জনকনন্দিনী সীতা। তখন ভীষন ক্ষুধা তাঁদের গ্রাস করেছিল। অতএব নান্য পন্থা! পথ নেই। অরণ্যে প্রবেশ মাত্র তাঁরা দুই ভাই হত্যা করলেন চারটি বিশাল আকারের পশু। বরাহ ( boar) ঋষ্য ( the printed or white footed antelope), পৃষত ( the spotted antelope), আর মহারুরু ( a species of antelope), চটপট সেই সব পশু মাংসের স্বাদ গ্রহণ করার পর তাঁরা এক বিশাল বনস্পতির তলায় রাত কাটালেন( রসে বশে মাংস, পৃষ্ঠা ৪৯)। কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় আরও লিখেছেন,,,,, রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে দেখা যায় যে শ্রীরাম তাঁর ভার্যা সীতার হাতে তুলে দিচ্ছেন মৈরেয় সুরা ( ৪৫/২০, পাঠান্তরে৪২/১৮/১৯) সীতামাদায় হস্তেন মধু মৈরেয়কং শুচি: পায়য়ামাস কাকুস্থ: শচীমিন্দ্রো যথামৃতম। ( মহাকাব্যে মদ্যপান, পৃষ্ঠা ৫৯/৬০)।
এরপর শম্বুক হত্যা। এক ব্রাহ্মণ বালকের অকাল মৃত্যুর জন্য ব্রাহ্মণেরা রামের কাছে অভিযোগ করেন দলিত শম্বুক যাদু করে বালকের প্রাণ নিয়েছে। রামচন্দ্র ব্রাহ্মণ চটাবেন কেন ? শম্বুকের গলা কেটে দিলেন তলোয়ার দিয়ে। ব্রাহ্মণ চক্রান্তে ক্ষত্রিয় উচ্চবর্ণের হাতে দলিত ভূমিপুত্র হল খুন। বিনা দোষে। এরপর তো নারদ মুনির প্ররোচনায় হনুমানকে পর্যন্ত বধ করতে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র। লক্ষ্মণ বধের ঘটনাও ঘটত। কিন্তু লক্ষ্মণ আত্মহত্যায় করায় ভ্রাতৃহত্যার পাপ থেকে বাঁচেন রাম। পরে হয়ত স্ত্রীর আত্মহত্যা ভাইয়ের আত্মহত্যায় কাতর হয়ে নিজেও সরযূ নদীতে নিজেও আত্মহত্যা করেন পুরুষোত্তম ভগবান রামচন্দ্র। এহেন রামের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল।২৪ এর নির্বাচনের পর শুরু হবে রাম রাজত্ব। এই প্রতিশ্রুতিতে বিজেপি নির্বাচনী রণে অবতীর্ণ হবে। বিশ্বের সমীক্ষায় অসুখী দেশের তালিকায় দেশ যতই পিছিয়ে যাক না কেন রামলালাতে মজে দেশের এক বিরাট অঙ্কের মানুষ। মন্দিরে স্থান হয়নি অর্দ্ধাঙ্গিনী স্ত্রী সীতার। হবে কি করে? রামের অভিষেক তো হয়েছে বালক রামের। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পাশেও তো স্থান হয়নি বিবাহিত স্ত্রীর। তাতে কি? দেশের নারীশক্তির এক বিশাল অংশ মোদি ও রামের শরণেই মাথা নত করে অপার শান্তি পেতে চান। অসুখী দেশের তালিকায়, অপুষ্টির তালিকায় যতই পিছিয়ে ঠিক না কেন , সবার আগে তো দেব ভক্তি। মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না?