পর্ব : ৩৪
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বাংলায় দেবদাসীদের অস্তিত্বের তেমন কোনো প্রমাণ মেলেনি এই সম্পর্কে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র ডিরেক্টর অজিত কুমার দণ্ড বেশ কিছু বছর আগে দেশ পত্রিকায় বাংলায় দেবদাসী প্রথা কেন নেই শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন,,,,, উড়িষ্যা, তামিল নাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ বা কর্ণাটকে যেভাবে ছিল বা এখনও কিছুটা আছে, সেভাবে কখনও ছিল বলে আমার জানা নেই। এই জায়গাগুলোতে দেবদাসী প্রথা যেভাবে এসেছে তার কারণও এক নয়। উড়িষ্যার দেবদাসী প্রথার একটধারার উৎস জগন্নাথদেব, অন্যটির তান্ত্রিক আচার। তান্ত্রিক আচারে আমরা জানি ‘পঞ্চ ম – কার’ -এর প্রচলন রয়েছে। তার মধ্যে একটা হল মৈথুন। এই আচারটিকে অর্থাৎ দেবদাসী প্রথার এই অংশটুকু যদি আমরা ধরে নিই তা হলে বলা যেতে পারে যে সেইভাবে দেবদাসী প্রথা বাংলাদেশে ছিল বা আছে।
তান্ত্রিক আচারে মৈথুন।
লেখক লিখেছেন, কিন্তু অন্যভাবে অর্থাৎ তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এমনকি গোয়াতেও যেভাবে দেবদাসী প্রথা রয়েছে সেভাবে বাংলায় দেবদাসী প্রথা ছিল বা আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। তামিলনাড়ুতে দেবদাসী প্রথার পেছনে ধর্মীয় কারণ ছাড়াও একটা সামাজিক কারণও ছিল।, সবটাই দেবতাদের বিনোদন এই ব্যাপারটা কিন্তু নয়। ওখানে একটা সামাজিক রীতি ছিল বা আছে যে, কোনও পরিবারে ক্রমাগত অকল্যাণ হচ্ছে কিংবাধরা যাক কোনও পরিবারে শুধুমাত্র কন্যাই জন্ম নিচ্ছে , তখন সেই পরিবার হয়ত ঠিক করল নিজেদের একটি মেয়েকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করবে। এইরকম উৎসর্গ করার ঘটনা বাংলাদেশেও যে হত না তা নয়, তবে তামিলনাড়ু ইত্যাদি জায়গায় যেভাবে সেটা একটা ইনস্টিটিউশন হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এখানে সেরকম হতে পারেনি, তার একটা কারণ আমার মনে হয় এই যে দেবদাসীরা মূলত সমাজের যে অংশ থেকে আসত ( প্রাথমিকভাবে দেবদাসী হত উচ্চবর্ণের মেয়েরাই, পরবর্তীকালে এল নিম্নবর্ণের মেয়েরা ) সমাজের সেই দূর্বল অনগ্রসর শ্রেণীর পক্ষে নানা বাধা অতিক্রম করে একটা প্রথা চালু করা সম্ভব ছিল না।
চোলা রাজাদের যুগে দেবদাসী প্রথার আড়ালে যৌনতা ছিল স্বাভাবিক।
ওখানে এটা হতে পেরেছিল তার বড় কারণ হল চোলা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা। নাইন্থ সেঞ্চুরিতে দাক্ষিণাত্যে চোলা ডাইন্যাস্টি বেশ ক্ষমতাশালী ছিল, তারা এই ব্যাপারটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেরকম সাহায্য করেছিল এখানে রাজাদের দিক থেকে তেমন কোনও জিনিস ঘটেনি। তেমন কোনও প্রভাবশালী রাজতন্ত্র এখানে ছিলও না। আমি মনে করি এই একটা বড় কারণে বাংলায় দেবদাসী প্রথার এই দক্ষিণী অংশত কিছু থেকে থাকলেও তার বড় রকম প্রকাশ ঘটেনি। এখনকার ব্যাপারটা খুব বিক্ষিপ্ত , তেমনভাবে উল্লেখ করার মত কিছু নয়।
স্তনের আকার নিরীক্ষণ করে দেবদাসীর মূল্য নির্ধারণ করতেন সেযুগের ধনী রাজন্য ব্যক্তিরা।
দেবদাসী প্রথা শুরু কবে থেকে গবেষকরা এখনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তবে প্রথার উদ্ভব ঈশ্বরের সেবাদাসী বানিয়ে আসলে পুরোহিতদের লালসা তৃপ্তি ছিল মূল উদ্দেশ্য। অনেকসময় ধনী ব্যক্তিরা পছন্দসই দেবদাসী পছন্দ হলে মন্দিরের পুরোহিতদের মোটা টাকা প্রণামী দিয়ে মেয়েদের কিনে নিতেন যৌন সম্ভোগ করার জন্য। বাড়িতে অতিথি এলে তাঁদের সেবাতেও মেয়েদের দেওয়া হত। অনেক ক্ষেত্রে উপপত্নী বা রক্ষিতা হওয়ায় এক পুরুষকে সন্তুষ্ট করলেই হত। এই প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ গ্রন্থে ৬৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,, যুদ্ধে পাওয়া বন্দিনী নারী অনাদিকাল থেকে সকল সমাজেই গণিকালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।( চলবে)
আগামী পর্ব ,,১২ আগস্ট , সোমবার