শিরোনাম

গণেশ চতুর্থীতে মাতছে দেশ,কিন্তু গণেশ কি শুভ দেবতা?

পর্ব: ৪

*

অষ্ট বিনায়ক গণেশ।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : মহারাষ্ট্রে গণেশ পুজোর জাঁকজমকে দেশের সেরা। যেমন আমাদের দুর্গাপুজো।মহারাষ্ট্রের মুম্বাইসহ বিভিন্ন প্রান্তে অষ্টবিনায়ক মন্দির আছে। এই গণেশের আটটি রূপ। ময়ুরেশ্বর, সিদ্ধি বিনায়, বল্লালেশ্বর, শ্রী ধুন্ডি বিনায়ক, বরদাবিনায়ক, চিন্তামণি, গিরিজাত্মজ ও বিঘ্নেশ্বর। মোদ্দা যে কথাটা কেউ বলতে চায় সেটা হল মহারাষ্ট্রএমন একটা স্থান যেখানকার মানুষের অধিকাংশ অনার্য নিম্নবর্ণের। ব্রাহ্মণ্যবাদে চার বর্ণের সৃষ্টি হলেও দলিত সম্প্রদায়কে শূদ্রেরও নিচে দলিত আখ্যা দিয়ে পঞ্চম বর্ণে স্থান দেওয়া হয়। দলিত শব্দের উৎপত্তি মারাঠি শব্দথেকে উদ্ভুত। অর্থাৎ যাঁরা দমিত।২০১১ সালের শুমারি বলছে ভারতে মোট দলিতের সংখ্যা ২০ কোটি। প্রায় মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। অধিকাংশই মহারাষ্ট্র ও কেরালার অধিবাসী।

বুদ্ধদেবের মা বুদ্ধের জন্মের আগে শ্বেত হস্তির স্বপ্ন দেখেন।

আগেই বলেছি গণেশ শিবপুত্র। শিব তত আর্য গ্রন্থ বেদে নিন্দিত। সুতরাং গণেশ যে দলিত দেবতা হিসেবে চিহ্নিত হবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দলিত সম্প্রদায় আর্থিক দুর্বল, শিক্ষায় দূর্বল সেই সুযোগে গুজরাটের বণিক সম্প্রদায় মহারাষ্ট্রে থাবা বসায়। উচ্চবর্ণের সংখ্যালঘু মানুষ এই ভূমিপুত্র দলিতদের ওপর যে কি নিষ্ঠুর ব্যবহার করত , এখনও করে শুনলে শিউরে উঠতে হয়।১৮৯৮! সালে পণ্ডিত ইয়োথি থাস তামিলনাড়ুতে শাক্য বৌদ্ধ সমাজ দলিতদের বিকল্প হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মকে উপস্থাপন করে। মনে রাখা দরকার গৌতম বুদ্ধ জন্মের আগে তাঁর মা মায়াদেবী স্বপ্নে দেখেছিলেনএক সাদা হস্তি শাবক আকাশ থেকে নেমে এসে তাঁর উদরে মিলিয়ে গেল। সেই থেকেই হয়তশ্বেত হস্তি একটি গুরুত্ব পেতে শুরু করল। শঙ্করাচার্যের আগ্রাসনে বৌদ্ধদের যে অংশ আত্মসমর্পণ করে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে তাঁর পরিচিত হন মহাযানী হিসেবে পরিচিত হন যে বুদ্ধদেব ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলেন সেই বুদ্ধদেবের অনুসারী একাংশ পৌত্তলিক পুজোয় ফিরে গিয়ে নতুন নতুন ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন। হিন্দু সম্প্রদায় পুরষ্কারস্বরূপ বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতারে জায়গা দেয়।

এবার দেখা যাক, দলিত সম্প্রদায় কিভাবে গণেশকে ইষ্ট দেবতা হিসেবে গ্রহণ করেন। ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রয়াত প্রবীর ঘোষ তাঁর অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে হিন্দু উপাসনা _ ধর্মে তন্ত্র শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন আট অধ্যায়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন,,,,,,, ধর্মীয় আইনের স্রষ্টা মনু গণেশকে শূদ্রদের দেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। গণেশ পূজকদের উচ্চবর্ণের শ্রাদ্ধ বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। গণপতি বলতে সম্ভবত ট্রাইব বা উপজাতিদের নেতাদেরই এক সময় বোঝানো হত। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা গণপতি বিরোধিতা করেছিল। শিব ও কিরাতকন্যা পার্বতীর মতই গণেশ প্রথম দিকে আর্যবাদীদের কাছে ব্রাত্য ছিলেন।,,,, সর্ব বিঘ্নকারী গণপতি শেষপর্যন্ত হয়ে গেলেন বিঘ্ননাশক সিদ্ধিদাতা।( পৃষ্ঠা ২১৯)

প্রয়াত প্রবীর ঘোষ লিখেছেন, গণেশ পুজোর প্রাচীনবিধি পুরোপুরি তন্ত্র নির্ভর । বর্তমানে গণপতির পুজো সর্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে। ফলে গুহ্য বা গোপন তন্ত্রমতে গণপতির পুজো প্রকাশের করা সম্ভব হচ্ছে না। গণেশ তন্ত্রমতে , গজানন প্রচণ্ড সুরা ও নারী শক্তিতে আসক্ত। সুরাপান করতে করতে তিনি তাঁর শক্তির সঙ্গে শৃঙ্গার করেন। গণেশ পুজকদের ছটি ধারা। সেগুলো যথাক্রমে উচ্ছিষ্টগণপতি, মহাগণপতি, নবনীতগণপতি, হরিদ্রাগণপতি , স্বর্ণ গণপতি ও সন্তানগণপতি। উচ্ছিষ্ট গাণপত্যরা মনে করেন, উচ্ছিষ্ট , অপবিত্র বলে কিছু নেই । কেউ খেতে খেতে খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেল, তাঁর পড়ে থাকা খাবারকে উচ্ছিষ্টজ্ঞান করা অর্থহীন। কারণ প্রথম খাবার পরই তো সেই খাবার উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়। সেই খাবারই তো মানুষ খায়। খাদ্যবস্তু খাবার জন্য। একের খাবারের পর দ্বিতীয়জন সেই খাবার গ্রহণ করলে তাকে উচ্ছিষ্ট ভাবারকোনও কারণ নেই। নারী পুরুষের সম্পর্কও সেই রকম।

এবার দেখুন বিষ্ফোরক কি তথ্য দিয়েছেন প্রয়াত প্রবীর ঘোষ।,,,,,, এক নারী ও এক পুরুষের আমরণ সম্পর্ক , বহুর সঙ্গে মিলনের আনন্দ উপভোগের পক্ষে বাধা। বিয়েই এই বাধার সৃষ্টিকারী। নারী পুরুষের মিলন সবসময়ই সুন্দর। এই মিলনের পর কেউই কারও উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় না।,,, এঁরা জাতপাতে বিশ্বাস করে না। সুরাপানকে পঞ্চমকারের অঙ্গ হিসেবে এবং সুরাকে আনন্দদায়ক পানীয় বলে মনে করেন। পাপপুণ্যের ভেদ করেন না। এসবই আমাদের আদিম সমাজের ভাবধারাই স্মারক।

গণেশ তন্ত্রে রহস্য পরতে পরতে।

বাকি গণেশ উপাসকদের সম্পর্কে প্রয়াত প্রবীর ঘোষ লিখেছেন, মহাগাণপত্য মনে করেন গণেশ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। সৃষ্টি -কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকেন। সৃষ্টির জন্যই তিনি শক্তির সঙ্গে অনন্ত মিথুনরত। হরিদ্রা_ গাণপত্যরা বিশ্বাস করেন, গণপতি বিশ্ব- ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। ব্রহ্মাদি দেবগণের তিনি অংশস্বরূপ। এই সম্প্রদায়ের উপাসকরা তাঁদের বাহুতে গণেশের মুখএঁকে রাখেন। মূলত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে গণেশ পুজো শুরু। চলবে সেই দুর্গাপুজোর মত দশদিন ধরে।সুতরাং গণেশ আখ্যান বাকিটা আগামীকাল । এইটুকু ধৈর্য রাখুন । গণেশের এক নয়, দুই নয়। পাঁচ পাঁচ স্ত্রীর উল্লেখ আছে। তাঁরা কারা? গণেশ পুজোয় মোদক ও লাড্ডু মহারাষ্ট্রে গণেশের প্রিয় খাদ্য। কেন? এমন অনেক অজানা তব্য দিয়েই শেষ করব গণেশ উপাখ্যান। (চলবে)

শেষ পর্ব আগামী সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর,২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *