সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: গতকাল এক নিবন্ধে জানিয়েছিলাম দেবর্ষি নারদের অভিশাপে শ্রী বিষ্ণুর রাম হয়ে জন্মান পৃথিবীতে। শাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে লীলাবতার। নিন্দুকেরা বলে, অনার্য শৈব সংস্কৃতির প্রতিভূ লংকেশ্বর রাবণকে বধ করতে এমন একটা রামায়ণী গপ্পো নির্মাণ খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। বিখ্যাত বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থের লেখক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, বৌদ্ধ ধর্ম সন্ন্যাসের ধর্ম। এরই প্রতিশোধ গার্হস্থ্য ধর্মের রামায়ণ। প্রসঙ্গে ফেরা যাক। নারদের অভিশাপে বিষ্ণু না হয় পৃথিবীতে মানব জন্ম নিলেন, কিন্তু রাবণ বধ করে আর্য সংস্কৃতি যে তিনি প্রতিষ্ঠা করবেন তার গ্যারান্টি কি? রাজ পরিবারে জন্ম নিয়ে বিলাসব্যাসনে জীবন উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না তো? এমনটাই ভাবলেন স্বর্গের দেবতারা। মনে রাখা দরকার, ইতিমধ্যেই ধনী পরিবারে জন্মে মানব মুক্তির জন্য সন্ন্যাস নিয়ে সাংখ্যদর্শন লিখে ফেলেছেন খুলনার বঙ্গসন্তান ঋষি কপিল। তারও আগে দশম শতাব্দী নাগাদ এই বাংলার চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে জন্মে বিশ্বব্যাপী এক ধর্মমত ছড়িয়ে দিয়েছিলেনআর এক বঙ্গতনয় মৎসেন্দ্রনাথ। তিনিও ছিলেন ধনী রাজপরিবারের সন্তান। সুতরাং রামচন্দ্রকেও সন্ন্যাস জীবনে প্রবেশ না করালে প্রভাব বিস্তার হবে কি করে? বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে এলে তবে তো আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণকারীকে বধ করবেন। এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য দেবতারা গেলেন স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা এর আগে আর্যবিরোধী রাক্ষস অসুরদের বর দিয়ে দেবকূলকে বিপদে ফেলেছেন। তাই এবার আর নিজে কোনো দায়িত্ব নিলেন না। উপায়ের ভার দিলেন একাধারে কন্যা ও শয্যাসঙ্গিনী দেবী সরস্বতীকে। পুরাণ অনুযায়ী, বিষ্ণুর দ্বিতীয় স্ত্রী সরস্বতীর সতীন লক্ষ্মীর সঙ্গে সম্পর্ক মধুর ছিল না। ( বাস্তবে আজও নেই , শিক্ষিতের সম্বল দারিদ্রতা, অশিক্ষিতের সম্বল প্রচুর অর্থ)। বিষ্ণুও যে সরস্বতীর তুলনায় লক্ষ্মীর প্রতি বেশি অনুরক্ত সেটাও সরস্বতী বুঝেছিলেন। তিনি এটাও জানতেন, পৃথিবীতে বিষ্ণু জন্মালে সঙ্গী হবেন লক্ষ্মী। তাই বিষয়টা ঘেঁটে দিতে যোগ্য ব্যক্তি সরস্বতী ছাড়া আর কেই বা হতে পারে?
সরস্বতী তাই কৈকেয়রাজ অশ্বপতির রাজ্যে জন্ম নেন মন্থরারূপে। অশ্বপতি এক বর পেয়েছিলেন। তিনি পাখির ভাষা বুঝতেন। তবে বর পাওয়ার একটি শর্ত ছিল। সেই কথা তিনি দ্বিতীয় কারও কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না। করলে মৃত্যু হবে। এক রাতে বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। জানলার পাশে এক গাছে দুই জৃম্ভ পাখি( পৌরাণিক যুগের এক জলচর পাখি) নিজেদের মধ্যে ব্যক্যালাপ করছিল। তাদের কথা শুনে অশ্বপতি হেসে উঠলেন। রাণী হাসতে দেখে স্বামীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। স্বামী বরের শর্ত অনুযায়ী বলতে চাইলেন না। রাণীও নাছোড়বান্দা। অশ্বপতি জানালেন তিনি বলতে অসমর্থ। কেননা শর্ত অনুযায়ী পাখির ভাষা ব্যক্ত করলে মৃত্যু। তবুও রাণী জেদ করায় কৈকেয়রাজ অশ্বপতি স্ত্রীকে নির্বাসন দেন। কন্যা কৈকেয়ী তখন শিশু। সেই শিশু প্রতিপালনের কাজ পান কুব্জা মন্থরা। যিনি আসলে সরস্বতী। দশরথের সঙ্গে বিয়ের পর কৈকেয়ীর সঙ্গে যৌতুক হিসেবে অযোধ্যায় আসেন নেদাসী মন্থরা। দশরথ বৃদ্ধ হলে তিনি বড় ছেলেকে রাজা বানানোর মনস্থ করেন। মন্থরা খবর পেয়ে কৈকেয়ীকে এসে বলেন রাম রাজা হলে ভরতের ভবিষ্যত নেই। তোমার দুটি ইচ্ছা পাওনা আছে স্বামীর কাছে। তুমি একবরে ভরতকে রাজা করতে বলো। দ্বিতীয় বরে রাজ্যে যেন বিদ্রোহ না হয় তাই রামকে চোদ্দ বছরের জন্য বনবাস প্রার্থনা করো।
বিজ্ঞাপন
ছোট থেকে মাতৃহারা কৈকেয়ী মন্থরার কাছে মাতৃস্নেহ পেয়েছেন। তিনি তাই মন্থরার পরামর্শ মত দশরথের কাছে দুই বর চেয়ে নেন। তারপর কি হল সবাই জানেন। বনবাসে যাওয়ায় সীতা অপহৃত হন। রাবণ হন রামের শত্রু। হল যুদ্ধ। দেবতাদের ইচ্ছায় রাবণ বধ। এদিকে নারদের অভিশাপ মত দাম্পত্য জীবনে রাম যেমন সুখী হলেন না, তেমনই বাঁদর সমাজের সাহায্য নিতে হয় সীতা উদ্ধারের জন্য। যাঁরা নারদের অভিশাপে রামের জন্ম নিবন্ধটি পড়েন নি তাঁরা এটি পড়ে নিলে নারদ কেন রামকে অভিশাপ দেন জানতে পারবেন। এহেন রাম অযোধ্যায় নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু রামকে সব মন্দিরে পূজিত হতে দেখি সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে। কিন্তু অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হলেন একা। সীতা ও লক্ষ্মণ সেখানে ব্রাত্য। কেন ব্রাত্য? হিন্দুত্ববাদী রামভক্তরা বলছেন, অযোধ্যায় যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি বালক রামের। সেখানে সীতা কোথায় আসবেন?
ঠিকই। মূর্তি যখন বালক রামের অর্থাৎ রামলালার সেখান সীতা কেন থাকবেন ? এবার যদি প্রশ্ন করেন লক্ষ্মণের মূর্তি নেই কেন? হিন্দুত্ববাদী রামভক্তরা কি বলেন আলাদা , আসলে পুরাণ বলছে, লক্ষ্মণ তো আসলে বিষ্ণুর নৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর বিছানা তৈরির সেবক মাত্র। তিনি কি করে বালক রামের পাশে স্থান পাবেন?
বিছানা তৈরির সেবক বললে অনেকেই বুঝবেন না। তাই বিস্তৃত তথ্য প্রয়োজন। বৈকুণ্ঠ বিষ্ণুর বাসস্থান। সেখানে তিনি শেষনাগের অনন্তশয্যায় আধশোয়া অবস্থায় লক্ষ্মীদেবীকে দিতে পা টেপান। সেই অনন্ত নয় প্রভুর বিরহে বৈকুণ্ঠে না থেকে লক্ষ্মণ হয় জন্মান। শিষু বয়সেও লক্ষ্মনের কোনো অলৌকিক কাণ্ড নেই , তাহলে তিনি কেন স্থান পাবেন রামের বালক মূর্তিতে? আবার নিন্দুকেরাপ্রশ্ন করতে পারেন শিশু বয়সে রামের কি গুরুত্ব?
বিজ্ঞাপন
বাল্মীকি রামায়ণ বলছে , রাম হাতি ও ঘোড়া চড়ায় ছিলেন পারদর্শী। রাম কিন্তু একা ঘুমোতে যেতে পারতেন না। সঙ্গী ছিলেন লক্ষ্মণ। ভোজন করতেন লক্ষ্মণকে নিয়ে। অযোধ্যায় রামের পাঁচ বছরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উচ্চতা ৫১ ইঞ্চি। সাধারণত পাঁচ বছর বয়সী শিশুর উচ্চতা হয় সর্বাধিক ৪৫ ইঞ্ছি।৬ ইঞ্চি বেশি কেন? এর কোন স্পষ্ট উত্তর নেই। তবে রাম শৈশবেই গুরু দক্ষিণ দিতে আদিবাসী রমণী তাড়কাকে হত্যা করে প্রথম নারী হত্যার সম্মান লাভ করেন।