ইতিহাসে পয়লা এপ্রিল বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্কময় দিন

গ্রিক দেবী আফ্রোদিতির নামে বছরের চতুর্থ মাসের নাম এপ্রিল।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায : ইংরেজি বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল। মাসের প্রথম দিনটি পালিত হয় বোকা বানানোর দিন হিসেবে। আসলে দিনটি ইতিহাসে কলংকিত দিন। কিন্তু উদাসীনতায দিনটি তাৎপর্য বিকৃত হয়ে গেছে। সেই ট্র্যাজিক ঘটনা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক এপ্রিল মাসের জন্ম ইতিহাস। ইংরেজি ক্যালেন্ডা শব্দটির উৎপত্তি ক্যালেন্ডি শব্দ থেকে। যার অর্থ মাসের প্রথম দিন। ইতিহাস বলছে , খ্রিস্টের জন্মের ৩২০০ বছর আগে ক্রো ম্যাগনন মানবগোষ্ঠী এই ক্যালেন্ডারের আবিষ্কারক। খুবই জটিল ছিলসব এইসব প্রক্রিয়া। পোপ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে পুরানো রোমান ক্যালেন্ডারকে সংশোধন করে নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। নাম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।এর আগে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় বছর শুর হত বিষুবের দিন। যা মার্চ মাসের ২০/২১ তারিখে পড়ত৷ ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলের মানেদ্বিতীয় ৷ কেননা রোমান ক্যালেন্ডারে এপ্রিল ছিল দ্বিতীয় মাসা ল্যাটিন শব্দ এপরিয়ে থেকে এপ্রিল মাসের নামকরণ | অনেকে বলেন,গ্রিকদেবী আফ্রোদিতি থেকে এই মাসের নামকরণ | এপ্রিলের প্রথম দিনটি বিশ্বজুড়ে বোকা বানানোর দিন হিসেবে পালিত হয়। ফরাসি ভাষায় Poisson Davril বলা হয়। ইংরেজি Aprii fish বলা হয়। কেননা মাছ বোকার প্রতীক। ছিপের বড়শিতে খাদ্যের টোপ দিয়ে মাছকে প্রলুব্ধ করা হয়।possion এর অর্থ কষ্ট দেওয়া। যা যীশু খৃষ্টকে দেওয়া হয়।

স্পেনে ১ এপ্রিল পালিত হয় টার্কি ডে।

এক ফরাসি গবেষক বলেছেন, শব্দটিতেরয়েছে পাঁচটি শব্দের মিলিত রূপ। ফ্রেঞ্চ ভাষায় যা যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বর পুত্র ও প্রিয়। এক ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ইহুদিদের চালু করা যীশুকে বিদ্রুপ করার প্রথা। যা খ্রিস্টান সম্প্রদায় আপন করে নেয়। এপ্রিল ফুল বিষয়টা মুসলিম সম্প্রদায় গুনাহ হিসেবে দেখেন। কেননা কোরআনে ধোঁকা দেওয়া, মিথ্যে বলা, অপরকে কষ্ট দেওয়া, নবীকে নিয়ে ঠাট্টা করা পাপ। মধ্য যুগে ১ জানুয়ারি ফিস্ট অব ফুলস উদযাপিত হত ফ্রান্সে। একজনকে নকল পোপ নির্বাচিত করা হত। স্কটল্যান্ডে পয়লা এপ্রিল টার্কি ডে হিসেবে পালিত হয়। কোকিলের আর এক নাম টার্কি। ব্রাজিলে দিনটিকে বলা হয় মেন্দ্রিয়া বা লাই ডে।অনেক ঐতিহাসিকরা বলেন, ইরানিরা নওরোজের ১৩ তম দিনে এই প্রথা পালন করে আসছে খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩৬ সাল থেকে।

স্পেনে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মুসলিমদের পুড়িয়ে মারেন সম্রাট ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলা। দিনটি ছিল ১৪৯২ ,১ এপ্রিল।

প্রশ্নটা এপ্রিল পয়লা মজার দিন না বিশ্বাসঘাতকতার নিষ্ঠুর ঘটনার দিন। ফিরে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীতে । বহু দেশেই তখন মুসলিম শাসন। স্পেনেও ছিল মুসলিম শাসন। মুসলিম শাসনে স্পেনের বিজ্ঞান সাহিত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতি ছিল দেখার মত। মুসলিমদের ৮০০ বছরের শাসনে দেশের অর্থনীতি ছিল মজবুত। ফলে একটা সময় মুসলিম শাসকরা ভোগবাদী স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করেন। হতে থাকে নৈতিক অধঃপতন। দূর্বল মুহূর্তের সুযোগ নেয় খ্রিস্টান দুনিয়া। পরিকল্পনা মত পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলা পার্শ্ববর্তী দেশের মুসলিমদের প্রতি চরম বিদ্বেষী সম্রাট ফার্দিনান্দকে বিয়ে করেন। সম্পর্কে ছিলেন খুড়তুতো বোন। এর আগে দুজনেই বহু চেষ্টা করে স্পেন থেকে মুসলিম শাসন হটাতে পারেননি। বিয়ের পর পর্তুগালের সাহায্যে স্পেনের শস্য খামার ভোগা উপত্যকা পুড়িয়ে দেন সম্রাট। ফলে শহরে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। সম্রাট ঘোষণা করেন মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় তবে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন। খাদ্য সংকটে অসহায় স্পেনের মুসলিম সম্প্রদায় নিরস্ত্র হয়ে শহরের প্রধান ফটক খুলে মসজিদে আশ্রয় নেন। খ্রিস্টান সম্রাট ফার্নিহান্দ সেনা বাহিনীকে নির্দেশ দেন শহরে ঢুকে মসজিদে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে। মর্মান্তিক ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদে আশ্রয় নেওয়া নেওয়া মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হন। দিনটি ছিল পয়লা এপ্রিল।

বিজ্ঞাপন

ফিরে আসুন ১৯৯৩ সালে দিনটির ৫০০ বছর পূর্তিতে স্পেন এক সভায় সিদ্ধান্ত নেয়মুসলিম আগ্রাসন রুখতে খ্রিস্টান আগ্রাসন বাড়াতে হবে। আজ শুধু পয়লা এপ্রিল নয়, বিশ্বের সর্বত্র প্রায় রোজই মানুষকে রাষ্ট্রশক্তি ভুল তথ্য দিয়ে বোকা বানাচ্ছেন। মানুষ বাধ্য হচ্ছেন সঠিক তথ্য না জানায়। ভোট এলে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি বেড়ে যায়। অবশ্য একটি ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক ডিউক রিপোর্টার্স ল্যাব ২ এপ্রিল বিশ্ব ফ্যাক্ট চেকিং দিবস পালনের ঘোষণা করেছে। সারা বছর ধরে তারা তথ্য সংগ্রহ করে। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিমান মানুষদের এক অংশ অন্যকে বোকা বানিয়ে আত্মসুখ অনুভব করে শাসন ও শোষণ বজায় রাখেন। দোকানদার যখন ওজন কম দিয়ে ক্রেতাকে ঠকান, তখন বোকা বনেন ক্রেতা। আবার ক্রেতা যখন নকল টাকা দোকানদারদের গছিয়ে দেন তখন বিক্রেতা বোকা।

বিজ্ঞাপন

৫০ বছর বয়সী ইটালিয়ান নাগরিক টমাসো ডিবে নেদেতিতি গত দু দশক জুড়ে ইন্টারনেটে মিথ্যে তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন। তিনি পোপ, ফিদেল কাস্ত্রো, হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রাওলিংয়ের মৃত্যর ভুয়ো খবর ছড়াতেন। ইটলিয়ান এই ভদ্রলোক রোমে বহুদিন শিক্ষকতা করেছেন।২০ বছর বয়স থেকে বিখ্যাতদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হন। সেই তালিকায় ছিলেন ফিলিপ রথ, নোয়াম চমস্কি, গর্বাচভ, দলাইলামা।২০১০ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ধরা পড়ার পর বলেন, আমি ইটালিয়ান মিথ্যার রাজা হতে চেয়েছিলাম। তিনি সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে মিথ্যে রটান। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের ছবি চুরি করে ভুয়ো একাউন্ট খোলেন । ভুয়ো একাউন্টের দৌলতে প্রাক্তন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী টার সিসিও স্টেইন মেয়ার, রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির কোলোকোল্টসেভ সহ অনেকের ভুয়ো টুইটারে গুজব রটান।

লোক ঠকানো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান নটবরলাল।

           আমাদের দেশে বোকা বানানোর খেলোয়াড় হিসেবে কুখ্যাত হয়ে ছিলেন বিহারের সিওয়ান জেলার বানগ্রা গ্রামের মিথলেশ কুমার শ্রীবাস্তব।১৯১২ তে জন্ম। ছোট থেকেই যে কারও সই হুবহু জাল করতে পারতেন। বড় হয়ে এক বিদেশি দম্পতিকে তাজমহল বিক্রি করেন বহু টাকার বিনিময়ে। একবার নয়, নয়বার তিনি তাজমহল বিক্রি করেন। তার কাছে বোকা বনেছেন দেশের বহু শিল্পপতি। ধরা পড়েন১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে। অসুস্থতার জন্য ছিলেন জেল হাসপাতালে। একদিন পুলিশ পাহারায় কানপুর জেল থেকে হুইল চেয়ারে এইমস হাসপাতাল যাওয়ার পথে নিখোঁজ এরপর থেকে আর খোঁজ মেলেনি। তার বিক্রির তালিকায় ছিল লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন , সংসদ। এহেন ঠগ নটবরলাল নামে পরিচিত ছিলেন। মুম্বাইতে তাকে নিয়ে দুটি ছবিও তৈরি হয়। একটিতে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন ও অন্যটিতে ইমরান হাশমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *