কৌশিকী অমাবস্যায় পিতৃতর্পণ, কিন্তু তারাপীঠের দেবী কি হিন্দু দেবী?

তারাদেবীর উপাসক বামাক্ষ্যাপারও জন্মদিন কৌশিকী অমাবস্যায়।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ২ সেপ্টেম্বর কৌশিকী অমাবস্যা। তন্ত্র সাধনার মোক্ষম দিন। পুরাণ মতে এদিন অসুরভ্রাতৃদ্বয় শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন দেবী।। তারাপীঠে মা তারার বিশেষ পুজো হয় এদিন। কয়েক লক্ষ তারা ভক্ত উপস্থিত হবেন তারাপীঠে। তারাদেবীর প্রিয় ভক্ত বামাক্ষ্যাপাও এদিন জন্মগ্রহণ করেন। তারাপীঠ শ্মশানে ভক্তরা এদিন পিতৃপুরুষের স্মৃতিতে তর্পণ করবেন। সত্যি বলতে কি পুরী যায়নি এমন বাঙালি আতসকাঁচ দিয়ে দেখতে হয়। তেমন কালী ভক্ত বাঙালি জয় মা তারা বলে তারাপীঠ দর্শন করেননি এমন সংখ্যা কোটিতে গুটিক। মাতৃ আরাধনায় পীঠস্থান রাজ্যের বীরভূম জেলা। নামেই প্রকাশ। বীরের ভূমি। শক্তিপীঠ। পুরাণ আর ভাবাবেগের পাশে ইতিহাস কতটা মানানসই তাই নিয়ে বিতর্কও কম নয়। প্রচলিত বিশ্বাস, দ্বারকা নদীতে স্নান করে দেবী তারার মন্দিরে পুজো দিলে পরজন্মে সাত খুন মাফ।

রাতের অন্ধকারে চলবে গুপ্ত তন্ত্রসাধনা।

সুতরাং এই জন্মে খুন চুরি করা যেতেই পারে এমন ধারণা পোষণ করলে সেই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত।তারাপীঠ মন্দিরে বিশেষ বিশেষ দিনে দেবীর বিশেষ পুজোর রীতি। অন্যতম কৌশিকী অমাবস্যা। এই বিশেষ তিথিতে মহা রাজবেশ ও মহাভোগে দেবীর আরাধনা হয়। মহাভোগে পাঁচ রকম ভাজা, সাদা ভাত, পোলাও, নতুন ফুলকপির ডালনা, ইলিশ মাছ, কাতলা মাছ, চিংড়ি মাছ ও অবশ্যই শোল মাছ থাকে। থাকে বলি প্রদত্ত পাঁঠার মাংস। কালী ভক্ত অনেকেই বলেন, শনিবার হলে মা যেন ডাকেন আয় খোকা আয়। আয় খুকু আয়। কিন্তু প্রশ্ন দেবী তারা কি সত্যিই কি হিন্দু দেবী?

পুজোর ভোগে ফলমূল ছাড়াও পোড়া শোল মাছ, ইলিশ, কাতলা, চিংড়ি সহ পোলাউ , মন্ডা মিঠাই থাকবে।

পৌরাণিক কাহিনী বলে, দেবী কালিকার দশ মহাবিদ্যা রূপের অন্যতম রূপ তারা। বামা কালীর মত তিনিও বাম পা শিবের বুকে রেখে দন্ডায়মান। তবে দেবী খর্বা। লম্বোদরী। ভীমা ব্যাঘ্র চর্ম পরিহিতা। জ্বলন্ত চিতায় তাঁর অবস্থান। চতুর্ভুজা। ডান হাতে খড়্গ, কর্তৃকা, নীল পদ্ম ও সমুন্ড খর্পর। পিঙ্গলবর্ণা, একজটাধারিনী। ত্রিনয়না, করালবদনা , হাস্যমুখী, ভীষণ দন্তা। বিশ্বব্যাপী জলের মধ্যে শ্বেত পদ্মের উপর অবস্থিতা । গলায় নাগোপবিতা মন্ত্র স্ত্রিং। দেবীর পুজো তিনটি ভাবে। ব্রহ্মজটা, উগ্রতারা ও নীল সরস্বতী। পুরাণে বর্ণিত চোলা হ্রদে দেবীর সৃষ্টি। সেই হ্রদ আজ বঙ্গোপসাগর নামে পরিচিত। দেবীর প্রথম সাধক বশিষ্ঠ মুনি। এখনকার দেবী মূর্তি আর বশিষ্ঠদেবের মূর্তিতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। বশিষ্ঠদেবের বর্ণনায় বলা হয়েছে দেবী দ্বিভূজা, সর্পময় জগ্য যজ্ঞোপবীত ভূষিতা। বামকোলে স্বয়ং মহাদেব, পুত্র রূপে ভাবিত। সমুদ্রমন্থনে হলাহল পান করে শিব যখন নীল কণ্ঠ হয়ে বিষের জ্বালায় জর্জরিত , দেবী তাঁর স্তনের দুগ্ধ পান করিয়ে শীতল করছেন।

বশিষ্ঠ মুনি চিনাচার তারাতন্ত্র শিখতে চিনে যান কেন?

প্রচলিত কাহিনীতে আছে দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত ও কবিন্দ্র কর্নাভরণ চিন কামরূপ মগধ ও . ত্রিহুতে সস্ত্রীক সাধনা করে তারা হরা নামে দুই যমজ কন্যা লাভ করেন। দৈব আদেশে তারাপীঠে বশিষ্ঠদেবের পঞ্চ আসনে সাধনা করে তারাদেবীর দর্শন পান। দেবীর মহিমা নিয়ে আছে আর এক কাহিনী। দেবীর ভোগে শোল মাছ পোড়া দেওয়া হয়। কথিত আছে, বণিক জয় দত্ত ব্যবসার কাজে দ্বারকা নদী পথে যাচ্ছিলেন। উত্তর প্রদেশ থেকে বাণিজ্য সেরে দীর্ঘপথ অতিক্রমে বাড়ি ফিরছিলেন বীরভূমের রত্নগড়ে। এই গ্রাম এখন গদাধরপুর রেল স্টেশনের চার মাইল দূরে। পথে আজকের তারাপীঠে। প্রাচীন যুগে নাম ছিল চন্ডিপুর। সেই ঘাটে নোঙ্গর ফেলেন বণিক। সেই রাত্রে বণিকের পুত্র সাপের ছোবলে মারা যায়। ইতিমধ্যে রান্নার তোড়জোড় চলছিল। মাঝিমাল্লারা একটি শোল মাছ কিনে ছিল মৃত অবস্থায়। মাছটি দ্বারকা নদীর জলে ধুতেই মাছটি জীবিত হয়ে ওঠে। অলৌকিকতায় সবার সঙ্গে বণিক জয় দত্তও অবাক হন। সেই জল মৃত বণিক পুত্রের গায়ে ছেটাতেই সে বেঁচে ওঠে। এরপর দৈব বাণী পেয়ে বণিক চন্ডিপুর শ্মশানের শ্বেত শিমুল গাছের নিচে খুঁড়ে এক মাতৃরূপী শিলা মূর্তি পান। তিনি সেখানে মন্দির নির্মাণ করেন। মহুলা গ্রাম থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ভৈরব পৈতন্ডিকে নিয়োগ করেন। এই তথ্য মেলে বামদেবের সঙ্গী মন্দিরের পান্ডা নগেনের শ্যালক তৎকালীন হস্ত রেখাবিদ যতীন পান্ডার লেখা এক পান্ডুলিপি থেকে।

রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর শ্রী দুর্গা গ্রন্থে লিখেছেন, বৌদ্ধ দেবীর তন্ত্র বাদ হিন্দুরা আত্মসাৎ করেছে।

এবার ঐতিহাসিক তথ্যে নজর দেওয়া যাক। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর শ্রী শ্রী দুর্গা গ্রন্থে লিখেছেন,,,,,,, পণ্ডিতেরা তন্ত্রবাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে গবেষণা করে দেখেছেন যে তন্ত্র ও তন্ত্রবাদ উত্তরদেশীয় বৌদ্ধ ধর্ম থেকে জন্মলাভ করেছে।,,, বৌদ্ধ ধর্মের বোধিসত্ব ও বৌদ্ধ দেবীদের হিন্দু তন্ত্রআত্মসাৎ করে নিয়েছিল। বৌদ্ধ আক্ষোভ্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মে হয়েছেন শিব ও তারা দেবীর উপাসক। শ্রদ্ধেয় শ্রী বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তাঁর ছদ্মবেশী দেবদেবী প্রবন্ধে একই কথা বলেছেন। তিনিই বলেছেন তারা দেবী হিন্দু দেবী নন। ইনি বৌদ্ধদের দেবী একজটা দেবীর একটি রূপান্তর বিশেষ। এবং ইহা মহাহীন তারা বলিয়া বৌদ্ধ সাহিত্য খ্যাত। হিন্দু তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কোনও ধর্ম গ্রন্থ নাই যাহা নিঃসন্দেহে সপ্তম শতাব্দীর পূর্ববর্তী হইতে পারে। ইহা হইতে মনে হয় , হিন্দুরা বৌদ্ধদের নিকট হইতেই এই দেবীকে গ্রহণ করিয়াছেন।( প্রকাশক রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ )।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনা গ্রন্থে ১৪৮ ও ১৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, পুরোহিত ও প্রতিমা পূজা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে নেওয়া।

স্বামীজি তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,,,,,, কিন্তু ড: শ্রী প্রবোধচন্দ্র বাগচী সম্মোহন গ্রন্থ থেকে নজির তুলে দেখিয়েছেন অক্ষোভ্য একজন মুনিরূপী শিব ছিলেন। উত্তর মেরু প্রান্তে ছিল তাঁর নিবাস। তিনিই প্রথম তারা দেবীর আরাধনা করেন এবং চিন্তা করেন যে তারা দেবীই চিন দেশে পার্বতী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহাপ্লাবনের সময়। অক্ষোভ্য মুনিই চিন দেশ থেকে ভারতে প্রথম তারাদেবীর পুজোর প্রবর্তন করেন। কিন্তু মহাচিনাচার তন্ত্রে বশিষ্ঠদেবকেই তারা দেবীর উপাসকরূপেই দেখা যায় এবং তিনিই চিন দেশ থেকে ভারতবর্ষে প্রথম তারাদেবীর পূজা প্রবর্তন করেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী তারা মা যে হিন্দুরা আত্মস্বাৎ করেছেন তার ঐতিহাসিক সত্যতা কি? সেক্ষেত্রে বলা যায় , সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ের শাসক শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধন ও কামরূপপতি ভাস্কর বর্মণ সামরিক অভিযানের সময় পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। ফলে তিব্বতী বৌদ্ধতন্ত্রের সঙ্গে গৌড় বাংলার সংস্কৃতির সংঘাত ঘটে ও বাংলার তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে রসায়নচর্চাকর নাগার্জুন তিব্বত থেকে বৌদ্ধ দেবী তারার সাধন পদ্ধতি ভারতে তথা বাংলায় নিয়ে আসেন। ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ বলেছেন, পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সঙ্গে বাংলায় বৌদ্ধ দেবী তারার সাধনা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের উত্থানে বৌদ্ধ দেবী হিন্দুদেবীতে পরিণত হন। রসায়নচার্য নাগার্জুন লোককথায় বশিষ্ঠ মুনিতে বদলে যান।

পৌরাণিক কাহিনীতে এমন অনেক রুমাল বেড়ালে পরিণত হয়েছে। কালী পুজোর রাতে তারা দেবীকে কালী রূপে পুজো হয়। শ্মশানে বানানো হয় কুটির। পঞ্চমুন্ডির আসন বানানো হয়। নর করোটি, সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল ও খরগোশের করোটি দিয়ে। নরমুন্ডে রাখা হয় কুমারী কন্যা বা আত্মহত্যা করেছেন এমন ব্যক্তির করোটি। তারাপীঠে তারা মা ছাড়া কিন্তু আর কোনো দেব দেবীর পুজো নিষিদ্ধ। বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনা গ্রন্থে প্রতিমা সম্পর্কে কি বলেছেন দেখা যাক। তিনি বলেছেন, পুরোহিত ও প্রতিমা পূজা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে হিন্দুরা গ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস ( আদি পাঠ) গ্রন্থে লিখেছেন,বৌদ্ধ তারা দেবী তো ব্রাহ্মণ্য আয়তনে ( ধর্মে) কালী দুর্গার অন্য নাম!( প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং , পৃষ্ঠা ৫৫৪)। সতীন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর তন্ত্রের কথা গ্রন্থে লিখেছেন, তারা বৌদ্ধতন্ত্রের নামজাদা দেবী। হিন্দুরা তারা দেবীকে দশ মহাবিদ্যা স্থান দিয়ে আত্মসাৎ করেছে। তারাই এখন ব্রহ্মময়ী। বজ্রযানের জনপ্রিয় দেবতা লোকেশ্বর বা অবলোকিতেশ্বর ( লোকনাথ)। পৃষ্ঠা ৮২-৮৩। আবেগ শ্রদ্ধার। প্রশ্রয়ের নয়। ইতিহাসকে প্রামাণ্য নথি মেনেই স্বীকার করা উদার মানসিকতার পরিচয়। তারা দেবী হিন্দু দেবী নন, বৌদ্ধ দেবী। হিন্দুদের বহু দেবদেবী বৌদ্ধ সংস্কৃতি ছিনিয়ে যে ভাবে আত্মীকরণ করা হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে জানাবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *