বেশ্যার বারোমাস্যা

পর্ব: ৩৬

বৈদিক যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল স্বল্প সময়ের জন্যে।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বৈদিক যুগে বেশ্যা নামে পরিচিত নারীদের জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা গড়তে সেই সময়ের নারী সমাজের ছবিটা বোঝা দরকার। হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণ মানুষকে বৈদিক যুগের ঐতিহ্যময় সমাজের গল্প শোনান।কিন্তু কেমন ছিল আসল সেই ছবিটা? প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে তুলে ধরছি কঙ্কন সিংহের ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত গ্রন্থের কিছু তথ্য। কি লিখেছেন লেখক? ,,,,, ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য, দুই মহাকাব্য সর্বক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শক্তির মিলিত প্রাধান্য। বৈশ্য শক্তিকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। শুদ্র তো মানুষই নয়। কোথাও নারী সম্মানিত নয়, প্রাচীন ভারতের ধর্মশাস্ত্রে, বৈদিক সাহিত্যে কোথাও নারীর মূল্য মনুষ্যত্বের মানদণ্ডে নির্ণীত হয়নি, নারীকে প্রয়োজন হত শুধু সম্ভোগের জন্য।

সীতার স্বর্ণমূর্তি পাশে রেখে রামের যজ্ঞ।

লেখক লিখছেন,উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা আবার নারীকে সম্ভোগ করার ক্ষেত্রে বর্ণধর্মের সুবিধা ভোগ করতেন, তারা নিজ বর্ণ ছাড়াও , নিম্নবর্ণের যে কোনও নারীতে সঙ্গত হতে পারতেন। নারীকে পণ্যরূপে বিনিময় করা যেত, দান করা যেত। সেসব পুণ্যকর্ম রূপেই বিবেচিত হত। যজ্ঞের অপরার্ধ যজমান পত্নী। জঘনাধো যা যজ্ঞস্য যৎ পত্নী।( শতপথ ব্রাহ্মণ ৩/৪/২/২) সেজন্যেই পত্নীকে সহধর্মিণী রূপে পাশে বসিয়ে রাখা। তবে নারীকে কোনও মন্ত্র উচ্চারণ করতে হত না। নারী অমন্ত্রক, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একধরনের আনুষ্ঠানিকতা। সহধর্মিনীকে বাদ দিয়ে পুরুষ যে যজ্ঞ করতে পারতেন না তা নয়। সীতাকে নির্বাসন দিয়ে রাম স্বর্ণসীতা তৈরি করে রামঅধার্মিক আচরণ করেছেন এমন কথা কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মুখে উচ্চারিত হয়নি। রামের মহতী যজ্ঞে উপস্থিত মুনি- ঋষিরাও তাকে অধর্ম বলেননি।( প্রকাশক,র‍্যাডিকাল ইমপ্রেশন, পৃষ্ঠা ১৫)

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শিক্ষাবিদ রাধাকৃষ্ণন বলেছেন, বিবাহ প্রথা পুরুষ আধিপত্য বজায় রাখার জন্যই।

লেখক কঙ্কর সিংহ জানিয়েছেন, বৈদিক সমাজে অল্প সময়ের জন্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী স্বাধীনতা ছিল এটা কিছুটা সত্যি হলেও দৈহিক শক্তির নিরিখে প্রভাব পুরুষদেরই ছিল। প্রাক্তন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের একটি মন্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানের উৎস কাব্যিক প্রণয় নয়, পাশবিক কামও নয়। আদিম বিবাহ নারীকে বশে রাখার উপায়মাত্র ছিল। তার আর্থিক প্রয়োজনের উপর তা নির্ভর করতো। এই বিবাহে ক্ষণিক আবেগের কোন স্থান- আদিম স্বামী-ই ছিল না।,,, আতিথ্যের সাধারণ রীতি হিসাবেই যৌনসঙ্গ দেবার জন্য তার স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় ধার দিত, কিন্তু কাজের লোক হিসাবে তার ওপর প্রভুত্ব সম্বন্ধে সে খুব সতর্ক ছিল। জীবনে ব্যক্তি সম্পদ ধারনা যখন প্রতিষ্ঠিত হল, তখন উত্তরাধিকারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যই বিবাহ প্রথার সৃষ্টি। সৃষ্টি হয় আট রকমের বিবাহ। সেখানে বলপূর্বক কন্যাহরণ ও অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন , ধর্ষণ পর্যন্ত বৈধতা পেয়ে বিবাহ প্রথায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। পুত্র পেল উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি। পুত্রের জন্ম দেওয়া ছিআবশ্যিক। ফলে বৈদিক সাহিত্যে , মহাকাব্যে কোনও কানীন কন্যার সন্ধান মেলে না। ক্ষেত্রজ কন্যাও নয়। পুত্র কন্যার ভারসাম্য রাখাটাই তো প্রাকৃতিক বিন্যাস।

মৃত্যুশয্যায় ভীষ্ম বলেছেন, ধর্মপ্রাণ পুরুষকে প্রলুব্ধ করে পাপী সাব্যস্ত করতেই নারীর জন্ম।

মহাভারতে আছে মৃত্যুপথযাত্রী শরশয্য্যায় শায়িত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, আদিকালে পুরুষেরা এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তাঁরা তখন নারীর সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করার জন্য। পুরাণে,ধর্মশাস্ত্রে নারীকে নীচ, কামুক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে স্বর্গ -বারাঙ্গনা অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দিয়ে বলানো হয়েছে: নারী স্বভাবতই অবিশ্বাসিনী, কামনা ছাড়া কোনো কিছুকেই সে মনে স্থান দেয় না এবং কামনায় উত্তেজিত হয়ে সে না করতে পারে এমন কোনো কাজই নেই। তারও আগে ঋগ্বেদে স্বয়ং উর্বশী তার প্রেমিক পুরুরবাকে বলছে, একটি নারীর জন্য কেন তুমি আত্মহত্যা করবে? করো না।, নারীর সঙ্গে কোনো বন্ধুত্বই হয় না। এদের হৃদয় নেকড়ে বাঘের মত। ন বৈ স্ত্রেনানি সখ্যানি সস্তি সালাবৃকানাং হৃদয়া ন্যেতা। (ঋগ্বেদ ১০/৯৫/১৫) (চলবে)

পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার ১৯ আগষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *