রামকৃষ্ণদেবের পুনর্জন্ম হয়েছে ১৯৮৬ সালে?

মৃত্যুশয্যায় প্রয়াত রামকৃষ্ণদেব

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ১৬ আগস্ট । চলতি বছরে রামকৃষ্ণদেবের ১৩৮ তম প্রয়াণ দিবস। রামকৃষ্ণ মিশন, দক্ষিণেশ্বর ছাড়াও বিশ্বের সব প্রান্তে রামকৃষ্ণভক্ত ও অনুরাগীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করবেন দিনটি।এই মুহুর্তে মনে পড়ছে তৃণমূল বিধায়ক ডা: নির্মল মাঝির অতি উৎসাহী বক্তব্য। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিতে আবেগে জারিত হয়ে যা বিষ্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন,তার সারমর্ম ছিল মমতা বন্দোপাধ্যায় জন্মান্তরে এসেছেন রামকৃষ্ণদেবের জায়া সারদাদেবীর অবতার হয়ে। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ দেননি।

রামকৃষ্ণ জায়া সারদাদেবী

বিষয়টি ডা নির্মল মাঝি বলেন বাঁকুড়া প্রগ্রেসিভ ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে।মমতা ব্যানার্জিকে তিনি সারদাদেবীর অবতার হিসেবে দাবি করেন । কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে তীব্র আপত্তি ওঠে রামকৃষ্ণ ও সারদাদেবীর অনুসারীদের কাছ থেকে। এমনটাই জানান বেলুড় মঠের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ । তিনি জানান, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বহু ভক্ত তাঁর কাছে এই অনভিপ্রেত ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। স্বামী সুবীরানন্দ নির্মল মাঝির নাম না উল্লেখ করে বলেন,বক্তা এমন তথ্য কোথায় পেলেন? কোন দায়িত্ববোধ থেকে এমন মন্তব্য করেছেন। আশা করবো,ভবিষ্যতে এমন কাণ্ডজ্ঞানবিহীন আচরণ থেকে তিনি বিরত থাকবেন।

আদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠাতা অন্নদা ঠাকুর

প্রশ্ন ওঠে, রামকৃষ্ণদেব এবং সারদা দেবী নিয়ে এমন মন্তব্য অনেকেই করেছেন। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবই বলেছেন, তিনি আবার পৃথিবীতে জন্ম নেবেন। সারদাদেবীও বলেছেন রামকৃষ্ণদেব অবতার বিশেষ। আবার তিনি জন্মাবেন। আদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাঠাকুরও বলেছেন, রামকৃষ্ণদেব আবার জন্মাবেন । এবার দেখা যাক, অবতার কাকে বলে? অবতারের স্বরূপ কি? মুনি ঋষিদের ব্যাখ্যা, তিনি অপরূপ লাবণ্যবিশিষ্ট। যিনি শৌর্য, বীর্য, ধৃতি, ক্ষমা, প্রেম, সহিষ্ণুতা, পৌরুষ, প্রভৃতি গুণের অধিকারী , তিনিই অবতার।অনেকে ৩২ ধরনের অবতারের কথা বলেন।অবতারের ৬৪ রকম গুণ থাকে।বলা হয়,অবতার চার প্রকারের। শক্ত্যাবতার, গুণাবতার, কলাবতার, পূর্ণাবতার। পূর্ণাবতার মাত্র একজন। তিনি শ্রীকৃষ্ণ।

এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে রামকৃষ্ণদেবের পুনর্জন্মের কথা

সারদাদেবী স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দজীকে বলেছিলেন , “ঠাকুর ( শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব) বলেছিলেন যে একশো বছর পরে আবার আসবেন। এই একশ বছর ( রামকৃষ্ণদেবের তিরোধান ও আবার জন্ম গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়) ভক্ত হৃদয়ে থাকবেন।”( শ্রী শ্রী মায়ের কথা, লেখক স্বামী জ্ঞানাত্মনন্দজী,প্রকাশক উদ্বোধন কার্যালয়, প্রথম প্রকাশ ৩০ শে ফাল্গুন,১৩৪৩, অষ্টম সংস্করণ ,পৃষ্ঠা ২৫৯) রামকৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছে ১৮৮৬ সালের ১৬আগস্ট। সারদাদেবীর বক্তব্যকে সঠিক ধরলে রামকৃষ্ণের আবার জন্ম হয়েছে ১৯৮৬ সালে।তারিখ মোটামুটি এক ধরলে নতুন জন্মে তাঁর বয়স হওয়া উচিত ৩৬ বছর। আদ্যাপীঠের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী অন্নদাঠাকুর তাঁর স্বপ্নজীবন গ্রন্থে লিখেছেন, ঠাকুর ( শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ) প্রফুল্ল বদনে যেন আমায় অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে দিতে বললেন,অন্নদা!,,,,,,,,, তোমার ভয় নেই,আমার দেহরক্ষার বত্রিশ বছর আমি আবার বাংলায় যাচ্ছি। সেই দেহ রক্ষার সত্তর বছর পর আমি আবার যাব; এইভাবে আমি আরও এগারবার অবতীর্ণ হব। যতদিন না বাংলার জনসাধারণ আধ্যাত্মিক ভাবে অনুপ্রাণিত হয়, ততদিন আমায় এইভাবে যেতে হবে।( স্বপ্ন জীবন, অন্নদা ঠাকুর, প্রকাশক দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণসংঘ, আদ্যাপীঠ, সুলভ সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ২২০)। এই বিষয়টি প্রয়াত যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রবীর ঘোষ তাঁর অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে উল্লেখ করেছেন ২৬২/২৬৩ পৃষ্ঠায়।

আদ্যাপীঠ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অন্নদা ঠাকুর তাঁর স্বপ্নজীবন গ্রন্থে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্মের উল্লেখ করেছেন।

প্রবীর ঘোষ আরও লিখেছেন, শ্রীশ্রী অন্নদাঠাকুরের কথা সত্যি বলে ধরলে রামকৃষ্ণদেব জন্মেছেন ১৮৮৬+৩২=১৯১৮ সালে। অর্থাৎ রামকৃষ্ণদেবের বর্তমান বয়স ৭৭ বছর। এই হিসেব প্রবীর ঘোষ দেন তাঁর এই গ্রন্থ প্রকাশের সময়কাল হিসেব করে। বছরটা ছিল ১৯৯৫। প্রবীর ঘোষ অসহায় ভাবে প্রশ্ন রেখেছিলেন, সারদাদেবী ও অন্নদা ঠাকুর দুজনেই মানুষের অতি শ্রদ্ধার ব্যক্তি। কিন্তু রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম কবে এই নিয়ে দুই মত মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। কার কথা সত্যি? সারদাদেবীর উক্তি সত্যি হলে রামকৃষ্ণদেবের পুনর্জন্মে বয়স হয় ৩৮। অন্নদাঠাকুরের কথা সত্যি হলে বয়স হয় ১০৬। অন্নদাঠাকুর জানিয়েছিলেন, রামকৃষ্ণদেব তাঁকে স্বপ্নে মৃত্যুর ৩২ পর জন্ম নেবেন বলেছিলেন, কিন্তু কোথায় জন্ম নেবেন এই বাংলায় কিংবা কত বছর বাঁচবেন বলেননি। যদি বলতেন, আমরা জানতে পারতাম তৃতীয় জন্ম কবে হবে। কেননা এটুকু রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বলেছেন, তিনি এগারোবার বাংলায় জন্ম নেবেন বাঙালিকে ধার্মিক করে তুলতে।

স্বামী ভূতেশানন্দজীর কাছে প্রয়াত প্রবীর ঘোষ প্রশ্ন রেখেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন কি রামকৃষ্ণদেবের পুনর্জন্মের দাবি মত খোঁজখবর করছেন? প্রশ্ন শুনেই নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন স্বামীজী ও তাঁর সচিব।এমনটাই লিখেছেন প্রবীর ঘোষ তাঁর অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের ২৬২/২৬৩ পৃষ্ঠায়।

প্রশ্ন ওঠে সারদাদেবী বা অন্নদাঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের নব জন্মেরআভাস দেওয়া সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ মিশন বা দক্ষিণেশ্বর মন্দির ট্রাস্ট কিংবা আদ্যাপীঠের কর্তৃপক্ষ কোনো তাঁকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিলেন না। বৌদ্ধ ধর্মের দলাই লামাকে কিন্তু খুঁজে বার করা হয়। প্রয়াত যুক্তিবাদী নেতা প্রবীর ঘোষ এই প্রশ্ন রেখেছিলেন বেলুড় মঠে স্বামী ভূতেশানন্দের কাছে। দিনটি ছিল ১৯৮৯ সালের ২৭ আগস্ট.। স্বামীজী ও তাঁর সচিব প্রশ্ন শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন প্রবীর ঘোষ। হাজার জনসেবার মাঝে এই কাজটি করলে লক্ষ লক্ষ রামকৃষ্ণভক্ত নতুন করে উৎসাহিত হতেন, নিজেদে ভাগ্যবান মনে করতেন।

তবে ব্রেকিং নিউজ আরও আছে। বিবেকানন্দও নাকি জন্ম নিয়েছেন বর্ধমানে। একথাও আগাম ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন সারদাদেবী ও অন্নদাঠাকুর।

আগামীকাল পর্ব ২ রবিবার ১৭ আগষ্ট ২০২৪।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *