পর্ব: ২ ও শেষ পর্ব
শ্রীজিৎ চট্টরাজ : রামদেব বাবা বারবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হন।. ২০২২এ মুম্বাইতে এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে রামদেব বাবা বলেছিলেন, মেয়েদের জামাকাপড় না পড়লেও ভালো লাগে দেখতে। মুম্বাইতে অক্টোবর মাসে বিরঙ্গনা সন্মেলনে রামদেব বাবা আরও বলেছিলেন, সালমান খান ড্রাগস নেন। আমির খান সম্পর্কে কিছু না জানলেও তাঁর ছেলে ধরা পড়েছিল। অভিনেত্রীদের সম্পর্কে কি আর বলব, ভগবান জানেন সব। মহিলাদের সম্পর্কে অশ্লীল উক্তি করার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহারাষ্ট্রের উপ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের স্ত্রী অমৃতা। ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের পুত্র শ্রীকান্ত শিন্ডে। মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদের ডেপুটি চেয়ারপার্সন নীলম গোর বাবার মন্তব্যের নিন্দা করেন। রাজ্য মহিলা কমিশনও নোটিস জারি করেন। কমিশন প্রধান স্বাতী মাহিয়াল বলেন, বাবার উচিত গোটা দেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। সেই সময় তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র বলেছিলেন, এতদিন জানতাম রামদেব সালোয়ার কামিজ পছন্দ করেন। তাই পুলিশে ভয়ে রামলীলা ময়দান থেকে মেয়েদের পোশাক পড়ে পালিয়েছিলেন। তাঁর চোখ ট্যারা। তাই তাঁর মতামতও বৈষম্যমূলক। তবে ঘটনার n৪৮ ঘটনার মধ্যে রামদেব বাবা ক্ষমা চেয়ে মহিলা কমিশনে চিঠি দেন।
এই পর্বের বিষয় একটি রহস্যময় মৃত্যু ও রামদেব বাবার উত্থান। রামদেব ওরফে রামকিষেন যাদবের জন্ম দরিদ্র কৃষক পরিবারে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে। গুরুকুলে পড়াশোনা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর সত্যার্থ বই পড়ে। গুরু প্রদুম্নর গুরুকূলে পড়াশুনোর দৌলতে বন্ধুত্ব এখনকার পতঞ্জলি সংস্থার প্রধান বালকৃষ্ণের সঙ্গে। এরপর আস্থা চ্যানেলে পতঞ্জলি যোগ শিক্ষা নিয় তাঁর কর্মকাণ্ড মোটামুটি সবাই জানেন। তিনিই বলেছিলেন হাতের আঙ্গুলের নখ ঘষলেই টাকে চুল গজাবে। রামদেব বাবার পতঞ্জলি সংস্থার রমরমা সম্পর্কে ২০১৬ সালের ১২ জুন আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় প্রতিবেদক অগ্নি রায় লেখেন , পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের মুক্তানন্দজী ছাত্রবস্থার বন্ধু হওয়ার সুবাদে পতঞ্জলি ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ ও ট্রাস্টির প্রতিষ্ঠাতা হন।২০০৫ সালে বামনেত্রী বৃন্দা কারাত অভিযোগ করেছিলেন রামদেব বাবার দিব্য ফার্মেসির ওষুধে জন্তু ও মানুষের হাড় ব্যবহার হয়। স্যাম্পেল টেস্টেও সত্যি প্রমাণিত হয়।
রামদেবের ভাই ৪০ বছর বয়সী রামভরত দিব্য ফার্মেসির সি ই ও। রামদেব বাবার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক অভিযোগ করেন জনৈকা ডা: মীরা।২০১৮ সালে ফেসবুকে তিনি লেখেন, একসময রামদেব বাবার ওষুধ সংস্থায় কাজ করতেন। তিনি সন্ন্যাসিনী হতে এসেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি বোঝেন রামদেব আসলে ধর্মের ভেকধারী একজন অপরাধী। হরিদ্বারের বাসিন্দা ডা z: মীরা বলেন গুরু রাজীব দিক্ষিতের খুনের দায় রামদেব বাবা ও তাঁর সঙ্গীদের। প্রধানমন্ত্রীকে ৪৮ পাতার একটি চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। মিডিয়াকেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বোঝাপড়ায় সব চাপা পড়ে গেছে। তিনি কোর্টেও মামলা করেন। ভিডিওতে তিনি এও অভিযোগ করে বলেন,রামদেব বাবা নকল জিনিস বিক্রি করেন।২০ টাকার জিনিস ২০০ টাকায় বিক্রি করে। কিন্তু রামদেব বাবাকে দেশজ ওষুধ আর পণ্য উৎপাদনের পরামর্শদাতা রাজীব দীক্ষিতের মৃত্যু রহস্য আজও রহস্য থেকে গেছে।
কে রাজীব দীক্ষিত? রাজীবের জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯৬৭। মৃত্যু ৩০ নভেম্বর ২০১০।২৩ বছর আগে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। এলাহাবাদে জন্ম। এম টেক করেছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি কানপুর থেকে। বাবার নাম রধেশ্যাম দীক্ষিত। মায়ের নাম মিথিলেশ কুমারী। ভাই এর নাম প্রদীপ দীক্ষিত। ছোটবেলার পড়াশোনা ফিরোজাবাদে। ছোট থেকেই দেশজ চিকিৎসার ওপর আস্থাশীল। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল কর্পোরেট দেশি বিদেশি সংস্থা মানুষের পকেট কেটে ওষুধ ও পণ্যের দাম নিচ্ছে। ছোট ছোট সভা করে এই বিষয়ে মানুষকে বুঝিয়েছেন।
তিনি চেয়েছিলেন পণ্যের নির্মাণে আত্মনির্ভরতা। তিনি কেন্দ্রের সরকারের সমালোচনা করে বলতেন প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো হয়, কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে কৃপণ। রাজীব এলাহাবাদে যখন বি টেক করছেন তখন ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা h। রাজীব বলেছিলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়। আমেরিকা একটি পরীক্ষামূলক কাজ করতে গিয়ে গিনিপিগ করেছে ভারতের গরীব নাগরিকদের। তাঁর মাতৃভাষায় শিক্ষা দান দাবি ছিল। দিল্লিতে একবার কর্পোরেট সংস্থার এক মিটিংয়ে কিছু উচ্চপর্যায়ের অফিসার আসেন। দলবল নিয়ে রাজীব বিক্ষোভ দেখানোয় গ্রেপ্তার হন। সেখানে তিনি দেখেন ধৃত বন্দীদের নগ্ন করে শারীরিক পরীক্ষা হচ্ছে।ব্রিটিশ আমলের এই আইনের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে ওঠেন। মুক্তি পাওয়ার পর কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে জন সচেতনতা সভা বেশি করে শুরু করেন। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে তাঁর। অসাধারণ কুশলী বক্তা ছিলেন তিনি।
বিষয়টি লক্ষ্য করেন রামদেব বাবা।২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি।রামদেব বাবা ভারত স্বাভিমান ট্রাষ্ট এন জি ও গঠন করেন। সেখানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করেন রাজী দীক্ষিতকে। রাজীব জানতেন তাঁর একার পক্ষে এই কর্পোরেট বিরোধী আন্দোলন করা সম্ভব নয়। তিনি রামদেবের এন জি ওর পতাকার নিচে প্রচার শুরু করেন। রাজীব রামদেব জুটি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।২০১০ এর ২৬ নভেম্বর। রাজীব দীক্ষিতের সভা ছিল ছত্রিশগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে।নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী তিনি সভা করেন।২৯ নভেম্বর তিনি সভা করতে যান দুর্গ জেলায়। রাস্তায় হঠাৎ ঘামতে শুরু করেন। রাজীবের সঙ্গী ছিলেন রামদেবের আশ্রমের এক যোগী আচার্য দয়াসাগর। রাজীব জানান, তাঁর গ্যাস ও এসিডিটি আছে। একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্ত দয়াসাগর ঝুঁকি নেননি।
রাজীবকে নিয়ে যান নিজেদের আশ্রমে। সেখানে বাথরুমে গিয়ে পড়ে যান রাজীব।বেশ কিছুক্ষণ পরেও তিনি ফিরে না এলে বাথরুমের দরজা ভেঙে বাথরুমে রাজীবকে অচেতন অবস্থায় দেখেন সবাই। কিছু পরে রাজীবের জ্ঞান ফিরলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয় তোড়জোড় শুরু হয়। রাজীব বলেন, এ্যালোপ্যাথি হাসপাতালে তিনি যাবেন না। আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাকা হোক। দুজন আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এসে চিকিৎসা করলেও রাজীবের শারীরিক উন্নতি হয় না। বাধ্য হয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যাপেলো হাসপাতালে। রাত ১২ টায় ভর্তি হন। রাত ২ টো থেকে ৩ টের মধ্য রাজীব দীক্ষিত মার যান। কিন্তু নিয়ম মতো তাঁর দেহের ময়না তদন্ত হলো না। শুধু তাই নয়, রাজীবের মৃতদেহ আলিগড়ে তাঁর বাড়িতে না পাঠিয়ে হরিদ্বারে রামদেবের স্বাভিমান ট্রাস্টের আশ্রমে নিয়ে যাওয়া হয়। কার নির্দেশে?
রহস্য অন্য জায়গায়। যদি হৃদরোগে রাজীবের মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে তাঁর মুখের রং নীল হয়ে যায় কেন? চেহারা ছিল ফর্সা। ময়না তদন্তের দাবি করেন রাজীবের ভাই ও কিছু অনুরাগী। কিন্তু সেই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০১০এ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। রামদেব ছিলেন ইউ পি এ সরকারের কঠোর সমালোচক। ফেসবুকে রামদেবের বিরুদ্ধে যিনি ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন সেই ডা: মীরার বক্তব্য ছিল,রাজীবের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, চক্রান্ত। সংবাদসূত্রের খবর, রামদেব স্বাভিমান ভারত গর্ব নামে যে সংগঠন করেন তার রাষ্ট্রীয় সচিব পদে বসিয়েছিলেন রাজীব দীক্ষিতকে।
মূলত রাষ্ট্রীয় স্বদেশী জাগরণের বার্তা দিয়ে এক রাজনৈতিক দল তৈরির পরিকল্পনা ছিল। সেই সময় আন্না হাজারে কে সামনে রেখে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আম আদমি পার্টি তৈরি করে ফেলেছে। ফলে রামদেব দল তৈরির পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। রামদেব বাবা আবারও হয়ত নতুন নতুন বিতর্কে জড়াবেন কিন্তু রাজীব মৃত্যু রহস্য রহস্যই থেকে যাবে। যেভাবে নেতাজি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু রহস্য আজও রহস্য থেকে গেছে।