সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: পৌরাণিক চরিত্র দ্রৌপদী। পাণ্ডব জায়া। তাঁর শ্লীলতাহানি ঘটালেন পরিবারের সদস্যরাই। জুয়ার আসরে দ্রৌপদীকে পণ করলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করলেন রাষ্ট্রের ভাবী শাসক। দৃষ্টিহীন রাষ্ট্রনায়ক নীরব। নীরব রাষ্ট্রের মহানায়কেরা। পাণ্ডব সখা কৃষ্ণ নয়, যুধিষ্ঠিরের জুয়াড়ি মনোবৃত্তির নেতিবাচক পরিস্থিতি সামলাতে দ্রৌপদীর শ্লীলতা রক্ষা করতে আসেন স্বয়ং ধর্মরাজ। কৃষ্ণ তখন মথুরাতে ছিলেন রাক্ষস বধ করতে। প্রশ্ন ওঠে পুত্র যুধিষ্ঠিরের অপকীর্তি ঢাকতেই কি ধর্মরাজের আগমন?
প্রশ্ন ওঠে কৃষ্ণ তো অন্তর্যামী। তিনি কি জানতেন না দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হবে? তিনি নাকি জানতেন কৌরব হবে পরাজিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। পাণ্ডবসখা হয়েও তিনি যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকলেন কেন? তিনি দ্রৌপদীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যাঁরা দ্রৌপদীর শ্লীলতাহানি করেছে সবাই নিহত হবে যুদ্ধে? তাঁর অনুপস্থিতি আর নিরপেক্ষ থাকা কি আসলে নারীর মর্যাদা রক্ষা তেমন গুরুত্ব নয় বলেই? নাহলে গীতার নবম অধ্যায়ের বত্রিশ নম্বর শ্লোকে কেন নারীকে বলবেন পাপযোনি উদ্ভুত? মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে কেনই বা ভীষ্ম বলবেন পূর্বজন্মে পাপে মানব নারী হয়ে জন্মায়? সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় ছোট্ট পরিসরে তবু সোমবার সন্ধায় জ্ঞানমঞ্চে যেটুকু পরিবেশিত হলো সেও এক সাহসিক পদক্ষেপ।
সোমসন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার জ্ঞানমঞ্চে কোহিনূর ড্যান্স একাডেমি নিবেদন করল নৃত্য ছবি দ্রোহী ও রাবণ । পুরাণ কাহিনী ও সমসাময়িক কালের নারী দমনের আধারে প্রথম পর্বে মঞ্চায়ন হয় দ্রোহী।১৮ জন নারী নৃত্যশিল্পী যাঁরা সংগঠনের ছাত্রী তাঁদের নিপুণশৈলী দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দ্রৌপদীর কুরু সাম্রাজ্যের সভায় লাঞ্ছনার প্রেক্ষিতে বর্তমান ভারতের আচ্ছেদিন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারীর ধর্ষণ , খুন ও লাঞ্ছনার প্রেক্ষাপট বিষয়ের ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে ওঠে। কাহিনী নির্মাণে কৌশিক সেনগুপ্তের ভাবনা এক সামাজিক বার্তা হয়ে ওঠে। আত্ম সমালোচনার কষাঘাতে দর্শকদের ভাবতে বাধ্য করায়।
দ্বিতীয়ার্ধে সংগঠনের প্রাণপুরুষ কোহিনূর সেন বরাট রাবণ আলেখ্যর মূল চরিত্রে মঞ্চ কাঁপালেন। সঙ্গে ১৬ জন পুরুষ শিল্পী। যাঁরা প্রত্যেকেই গুরুদক্ষিণা দিলেন মঞ্চে। ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য সংস্কৃতির ধারক বাহকদের হাতে রামায়ণ হয়েছে বিকৃত। বাল্মীকির রামায়ণে যেখানে প্রতিটি চরিত্র গড়ে ওঠে মানবিক ধারায় সেখানে পরবর্তী লেখক কবিদের মনের মাধুরী মিশিয়ে দেবত্ব আরোপিত করে পরিবেশন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে দর্শকরা জানলেন, রাক্ষস অর্থের সঠিক সংজ্ঞা। জানলেন শৈব উপাসক দ্রাবিড় সংস্কৃতিকে কিভাবে কালিমাযুক্ত করা হয়েছে। রাবণ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পরিবেশিত হলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশিত হলে সোনায় সোহাগা হত।
এক, বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্য কাণ্ডে ৫৫ সর্গে রাবণ যখন সীতাকে বলছেন, হে সীতা, তোমার আমার এই মিলন অনেক সৌভাগ্যের ফলে সম্ভব হয়েছে। এই মিলন ঋষিদের দ্বারাও সমর্থিত। তখন ৫৯ সর্গে সীতা উত্তর দিচ্ছেন তুমি আমার শরীরকে নিজের আলিঙ্গনে নেওয়ার জন্য স্বতন্ত্র একজন। আমি শরীরী মানরক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না অথবা আমি কোনো ভুল করেছি ভেবে আফসোস করছি এমন নয়। সুতরাং সীতা হরণে সীতার শ্লীলতাহানি হয়েছে সেই তথ্যও সঠিক নয়। তবু স্বীকার করতেই হয়,শুরু থেকে শেষ দুটি পর্বই শিল্পী কলাকুশলীদের ছন্দময় উপস্থাপনায় দর্শক এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে পারেননি। শিল্পের সৃষ্টি শুধু নান্দনিকতা উপহার দেওয়ার জন্য নয়, শিল্পের নির্মাণ সামাজিক মূল্যবোধের পরিচয়।
তাই কোহিনূর ড্যান্স একাডেমির এই দুটি প্রযোজনা এই মুহূর্তে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্রশক্তির অপপ্রচারের বিরুদ্ধে চপোটাঘাত বলা যায়। দুটি আলেখ্যই প্রথম রজনী। অথচ পেশাদারী শৈলীতায় যা চরম উৎকর্ষের প্রমাণ মিলল। কোহিনূর এদিনের অনুষ্ঠানটি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করলেন সদ্য প্রয়াত ওড়িশি নৃত্যগুরু পৌষালী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে।অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত কোহিনূর সেন বরাটের নৃত্য গুরুমা অনিতা মল্লিক সহ বিশিষ্ট ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পীদের সম্বর্ধনা জানালেন কোহিনূর ও তাঁর সংগঠনের ছাত্রছাত্রীরা।