বাঙালির ইতিহাস ও বহিরাগত তত্ত্ব

পর্ব: ৫

করোনা সময়কাল। হঠাৎ একদিন সকালে ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধু কুণাল ঘোষের ফোন। কুশল বিনিময়ের পর কুণাল জানালো বাড়িতে যখন বন্দী।, তখন একটা গবেষণামূলক লেখা লিখুন। আমি ই বুকে প্রকাশ করব। বিষয়টি সেই নির্বাচন করে দিল। বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাস। শুনেই চমকে উঠেছিলাম। কাকে দিচ্ছ রাজার পার্ট। আমি সামান্য এক ক্ষুদ্র সাংবাদিক। এই বিশাল ব্যাপ্তির কাজে হাত দেওয়া মানে সাপের গর্তে হাত ঢোকানো। তবু অনড় কুণাল। ওঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার হাজার যোজন দূরের সস্পর্ক। কিন্তু কলকাতায় যখন কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব ছিল না তখন কলকাতা দূরদর্শনে বেসরকারি প্রযোজনায় সংবাদ ম্যাগাজিন তৈরির দুঃসাহস তো দেখিয়েছিলাম কুণালের মত তৎপর সাংবাদিককে পাশে পেয়েছিলাম বলে। বাংলার টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যদি পত্তন করতে পারি সাফল্যের সঙ্গে, তবে এই কাজটাও পারব ।। সবচেয়ে বড় কথা,, এই লেখায় আমার কৃতিত্ব নেই। আমার কাজ তো তথ্য সংগ্রহ করে মালা গাঁথা। করোনা প্রবাহে শুরু করেছিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম বাংলার ঐতিহাসিকদের বহুলাংশই উচ্চবর্ণের মানুষ। ফলে ভূমিপূত্র বাঙ্গালির ইতিহাস, সংস্কৃতি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই আমার তথ্য খোঁজার কাজটা হলো গোয়েন্দার সূত্র খোঁজার মত।

সেই খুঁজে পাওয়া তথ্য যদি বাঙালির কোনো কাজে লাগে সেই আশায় পর্ব অনুযায়ী পরিবেশন করতে চলেছি। শুধু প্রশংসা নয়,সমালোচনাও চাই। তবে তো নিজের ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধন করত পারবো। বিষয়টি যেহেতু কুণাল ঘোষের অনুপ্রেরণায় তাই লেখাটি তাঁকেই উৎসর্গ করছি।

প্রাচীন অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বঙ্গের আগমন

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ফিরে যাই প্রাচীন বঙ্গে। মানব সভ্যতার প্রারম্ভিক যুগে এই অস্ট্রিক গোষ্ঠী নৌ পথে আরব ও মিশরের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলে। অস্ট্রিক কারা? ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস আদি পর্বে এই অস্ট্রিক গোষ্ঠী সম্পর্কে লিখেছেন,,,, এই কৃষিকার্য যে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি এই অস্ট্রিক গোষ্ঠী ভাষাভাষী আদি অস্ট্রেলীয় লোকেরাই আমাদের দেশে প্রচলন করিয়াছিলেন । অনেক ঐতিহাসিকদের বক্তব্য , অস্ট্রিকদের সঙ্গে বিরোধে পিছু হটে নিগ্রোরা। নিগ্রো শব্দ থেকেই বোঝা যায় এঁরা আদি আফ্রিকার মানুষ।আবার কেউ বলেন, নিগ্রোদের সঙ্গে আপস করেই বঙ্গে বসতি গড়ে তোলে অস্ট্রিকরা। এরপর বঙ্গে আগমন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর। তাদের পরিচয়ও নাকি ছিল বং জাতি হিসেবে।ঐতিহাসিকদের একাংশের দাবি, বং জাতির দ্রাবিড়দের থেকে বঙ্গ নামের উৎপত্তি। দ্রাবিড় বলতে আমরা বুঝি দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। কথাটা ঠিক।কিন্তু দ্রাবিড় গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন মেসোপটেমিয়া থেকে। এদের বঙ্গে আসার সঠিক সময় এখনও নির্ধারিত করা যায়নি। তবে এই দ্রাবিড়গোষ্ঠী মেসোপটেমিয়ার ফোরাত (ইউফ্রেটিস) দজলা (টাইগ্রিস) নদী পেরিয়ে ব্যবেলোনিয় অঞ্চল থেকে ভারতে আসে। এক অংশ আসে সিন্ধু উপত্যকায়। আরেক দল সিদ্ধান্ত নেয় তাদের দেবতা সূর্য। তাই ভারতের পূর্বদিকে অর্থাৎ সূর্যের উদয় হয় যে অঞ্চল থেকে, সেখানেই তারা বসতি স্থাপন করবে। ইদানিং জাতীয় কংগ্রেসের পরামর্শদাতা শ্যাম পিত্রদার কিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক শুরু। আসলে আদি ভারতীয়দের নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়নি। ফলে স্পষ্ট ধারণা অনেক শিক্ষিত মানুষেরই নেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। দ্রাবিড় শব্দের উৎস দ্রামিল শব্দ থেকে। সেখান থেকেই তামিল শব্দের উৎপত্তি। দ্রাবিড় শব্দের অর্থ তিনদিকে জল বেষ্টিত ভূমি। কিন্তু অস্ট্রিকদের হাতে বাংলার গ্রামীণ সভ্যতা গড়ে ওঠে। দ্রাবিড়দের হাতে নগর সভ্যতা। পরবর্তী সময়ে হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকেরা বলেন, দ্রাবিড় সংস্কৃত শব্দ। বৈদিক ও পরবর্তী হিন্দু গ্রন্থে বাংলার পাশাপাশি ভারতকেও বলা হয়েছে মেলেচ্ছস্থান। অর্থাৎ পাপী নিচ জাতির অঞ্চল। এই গ্রন্থগুলির রচয়িতা আর্য সম্প্রদায়। যারা দ্রাবিড় সভ্যতার সিন্ধু অধিকার করে নেয়। দ্রাবিড়রা সরে যায় দক্ষিণ ভারতে। যাদের পরিচয় ছিল অনার্য নামে। কিছু নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মত, দ্রাবিড় সভ্যতা অনেক প্রাচীন। ভারতের জিনপুল দুটি অংশে বিভক্ত। এ এন আই (এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান) এবং এ এস আই (এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান)। এই দক্ষিণী জিন পুল ভারতের বাইরে কোথাও নেই। বরং উত্তরীয় জিনপুল বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে মেলে।
সবশেষে বাংলায় আসে । ইতিহাস বলে প্রায় ছ হাজার বছর আগে অস্ট্রিক জাতি ইন্দো চিন থেকে বাংলায় আসেন এবং এখানকার নিগ্রো বটুদের তাঁরা পরাজিত করেন। এরপর খাইবার গিরিপদ ধরে তাঁরা বাংলায় আসেন। অস্ট্রিক জাতির সঙ্গে সংমিশ্রণে তাঁরাই বাংলায় আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠী গড়ে তোলেন।

প্রথম বঙ্গে দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের আগমন

এই তো সেদিন ।২০০৪। সমস্ত ভারতীয় ভাষার মধ্যে তামিল প্রথম ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কৃত ভাষা নিয়ে যতটা উদ্যোগী, ততটা যদি পালি ভাষা সম্পর্কে উদ্যোগী হওয়া যেত তাহলে পালি ভাষাও প্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো। এখন তো শুনছি, বাংলাও নাকি প্রাচীন ভাষা নয়। তাই ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হয় নি।


আমাদের বাঙালি ভাষাবিদ সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, দ্রাবিড় ভাষা থেকে অনেক শব্দ সংস্কৃতে ঢোকানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, দ্রাবিড় অনেক শব্দ আধুনিক বাংলায় আছে। সেগুলি একেবারে ঘরোয়া শব্দ। যা লোকে বই পড়ে শেখে না, যা পরিবারে ধারাবাহিক রূপে চলে আসে। সংস্কৃতে ও বিস্তর দ্রাবিড় শব্দ আছে……. কেটলের এর কন্নাড়ি ভাষায় অভিধানের ভূমিকায় প্রায় ৪৫০ সাধারণ সংস্কৃত শব্দ দেওয়া আছে। যেগুলি দ্রাবিড় থেকে নেওয়া।
তবে বঙ্গের দ্রাবিড়গোষ্ঠী ও দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় গোষ্ঠীর জিনগত ও ভাষাগত কিছু বিভাজন আছে। ভাষাতাত্ত্বিকদের বিচারে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী প্রাথমিক ভাবে পাঁচ ভাগে বিভক্ত। দক্ষিণী দ্রাবিড়দের বেশিরভাগ ভারতের বাইরে সিংহলসহ অনেক দেশে বসতি স্থাপন করে। ভাষাগত বিভাজনে রয়েছে দুটি ভাগ। একভাগে কর্নাটকি কন্নড় ও টুলু। অন্য ভাগে মালায়লাম ও তামিল ভাষা

বাংলায় আদায় প্রথম আফ্রিকার নিগ্রো বটু সম্প্রদায়।

বাংলায় নিগ্রোদের সঙ্গে আদি অস্ট্রিকগোষ্ঠীর মিলনে এক কোলিডগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। আদি এই বাঙালি গোষ্ঠীর তালিকায় আছে বেদিয়া, চেরো, গোণ্ড, বিরহোর, কর্মালি, খারোয়া, কোরোয়া, লোহারা, মহালি, গারহইয়া, সহরিয়া, পাহাড়িয়া ইত্যাদি গোষ্ঠী। বাংলার দ্রাবিড়গোষ্ঠীকে ঐতিহাসিকরা পরিচয় দিয়েছেন মেডিটেরিয়ান ওই। আজকের বাঙালি গোষ্ঠীর মূল সম্পর্ক এদের সঙ্গেই। সে হিসেবে বিশ্বের সব জাতিই সংকর জাতি। একমাত্র আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী ছাড়া । ( চলবে)

পর্ব ৬ আগামী রবিবার ১২ মে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *