হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পথে ভোটের আগে আর এক ধাপ সি এ এ কার্যকর কতটা অশনি সংকেত?

পর্ব: ১

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বনগাঁয়ে মতুয়াদের কাছে ঠাকুর বাড়ির সত্ত্বাধিকারী শান্তুনু ঠাকুর বলছেন দেখলেন তো , সবুরে মেওয়া ফলে। আনন্দে উদ্বেল মতুয়াদের এক বড় অংশ। ঢাকঢোল, কাঁসর আর শিঙ্গার আওয়াজে মতুয়ানগর মুক্তির স্বাদ অনুভব করছেন। কিন্তু যে ফল হাতে পেলেন সেটি বিষ বৃক্ষের ফল নয়ত? যখন বুঝবেন তখন মূল নিবাসী বাঙালির যতটা ক্ষতি হবে সেটা পূরণ করা যাবে তো? এমনটাই বলছেন বিরোধীরা।

বিজ্ঞাপন

১১ মার্চ। সন্ধ্যা ৬ টা। রাষ্ট্রপতির সাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে দেশে চালু হয়ে গেল বহু প্রতীক্ষিত সি এ এ। সত্যি বলতে কি, এখনও রাজ্যের বহু শিক্ষিত মানুষ এন আর সি ও সি এ এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না। ফলে এই বিলের লাভ লোকসান কি পুরোটাই গোলমেলে? সি এ এ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হতে চলল দেশের তো বটেই রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা মৌন। মুম্বাইয়ের সিনে জগতের মুখেও কুলুপ। কেবল কঙ্কনা রানওয়াত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যা বলেন , তাই করেন। তৃণমূল বিধায়ক চিরঞ্জিত বলেছেন, বিষয়টা বুঝতে সময় লাগবে। 

            কৌশিক সেন বলেছেন দুর্নীতি থেকে নজর ঘোরাতে সি এ এ নির্বাচনের আগে। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় অবশ্য তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা বিজয় তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর নিজের দল আছে। তিনি রাস্তায় নামার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। কমল হাসানও প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন।কেন্দ্রের শাসক দল বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বোঝাতে পেরেছে এতদিন তোমরা ভারতে ছিলে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আমরা তোমাদের নাগরিক অধিকার দিলাম। এই পরিকল্পনা বিজেপির স্বাভাবিক। রাজ্যে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিম ভোট। যে ভোট বিজেপির বিরুদ্ধেই যায়। ফলে অহিন্দু নিম্ন বর্গের যাঁরা মুসলিম , খ্রিস্টান নন, আবার হিন্দুও নন তাঁদের ভোট যদি বিচ্ছিন্ন করা যায় তাহলে হিন্দুত্ববাদী ভোট ব্যাংক বাড়ানো যায়।

  সেই মত যে তুরুপের তাস ২০১৯ ও ২০২১ এর বিধানসভার নির্বাচনের আগেই বিজেপি ফেলবে বলেছিল কিন্তু প্রস্তুতির অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। ফলে রাজ্যে আড়াই লক্ষ মতুয়া ভোট বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। চাপ বাড়তে থাকে মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের নেতা শান্তনু ঠাকুর। অশনি সংকেত পেয়ে এবার বছরের শুরুতেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেন্দ্রের শাসক দলের দু নং ব্যক্তি অমিত শাহ কথা দেন লোকসভা নির্বাচনের আগেই সি এ এ চালু হবে। সেই কথা বিজেপি রেখেছে। সি এ এ চালু। সি এ এ বিষয়টি কি এবং কেন জানতে বা বুঝতে পিছিয়ে যেতে হবে অতীতে।

দেরিতে হলেও অমিত শাহ কথা রেখেছেন। সি এ এ চালু।

সি এ এ অর্থাৎ সিটিজেনস এ্যামেন্ডমেন্ট এ্যাক্ট বাংলায় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। সি এ এ ও সি এ বি দুটোই এক। আইন তৈরিতে কোনো প্রস্তাব লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হলে বিলটি আইন হিসেবে স্বীকৃত হয়।২০১৬ সালে প্রস্তাব আনা হয় কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির নীতি মত। কিন্তু রাজ্যসভায় শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিলটি পাশ করানো সম্ভব হয়নি। বিলটিকে খিড়কি দরজা দিয়ে পাশ করানোর জন্য পর্যালোচনার নামে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি ( জে পি সি) তৈরি হয়। সেই কমিটি ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে একটি রিপোর্ট পেশ করে। সেবার সংখ্যাধিক্যের জেরে বিলটি পাশ হয়ে যায়। এবার দেখা যাক সি এ এ তে কি আছে?

সি এ এ তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্থান ও আফগানিস্থান থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখের মধ্যে যেসব হিন্দু বৌদ্ধ জৈন শিখ পার্সি ও খ্রিস্টান ধর্মের মানুষেরা ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে বা ভয়ে ভারতে চলে এসেছেন তাঁদের অবৈধ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না। এরপর যদি তাঁরা পাঁচ বছর ভারতে থাকেন ও সংবিধানের তৃতীয় সিডিউলের দ্বারা যোগ্য হন ভারত সরকার তাঁদের ন্যাচারালাইজেশন শর্তের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে পারে। ভারতে চার রকমের নাগরিকত্ব মেলে।১) জন্মের সূত্র,২) উত্তরাধিকার সূত্রে ৩) রেজিস্ট্রেশন সূত্রে ও ৪) স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।

সি এ এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির শুনানিতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ তে পাকিস্থান , বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে অ মুসলিম অভিবাসীর সংখ্যা ৩১৩২৩। এঁরা সবাই ভারতে এসেছেন২০১৪র ডিসেম্বরের মধ্যে। ইন্ডিয়া টু ডে পত্রিকায় ১৭ জুলাই ২০১৮ তে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয় ২০১১ সালে ইউ পি এ সরকার ২৯ ডিসেম্বর এক চিঠিতে একটি স্ত্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বিজ্ঞাপিত করে, যার সাহায্যে যেকোনো শরণার্থী দীর্ঘমেয়াদির আবেদন করতে পারেন। এল টি ভি অর্থাৎ লং টাইম ভিসাস।

    এই ভিসায় তাঁর প্যানকার্ড, আধার কার্ড , ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন। সম্পত্তিও কিনতে পারেন। জানা দরকার ডিসেম্বর ২০১৪ এর আগে যে সব অমুসলিম শরণার্থী পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে ভারতে এসেছেন তাঁরা এদেশের নাগরিক হিসেবে বৈধতা পেয়ে গেছেন। বাড়তি পাওনা ভোটদানের অধিকার আগে যা ১২ বছরের অপেক্ষা ছিল সেটা কমিয়ে ছ বছর করা হয়েছে। এটাও যে শ্রীলঙ্কা থেকে তামিল শরণার্থী বা পাকিস্থান ও আফগানিস্থান থেকে আসা আহমদিয়া, হাজারা বা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত তসলিমা নাসরিনের মত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব. ও ভোটাধিকার দেওয়ার কোনো সংস্থান সি এ এ বিলে নেই।

ভোটার কার্ড আর আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়।

এর কারণ সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা এর পিছনে তিনটি কারণ।১) বিজেপির নজর বাংলাদেশ থেকে আসা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি শরণার্থী।২০১৯ এ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা আসাম ভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন যদি আমরা সি এ বি না আনি তাহলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ১৭ টি আসন হাতছাড়া হবে।২) ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে সি এ এ ভারতীয় সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রকে দূর্বল করে তোলা বিজেপি ও আর এস এসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।৩) এন আর সি ও সি এ এ সম্মিলিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোদী ও শাহ জমানা মুসলিমদের নাগরিকত্ব নাকচ করতে চায়। এই তথ্যের প্রমাণ রয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ১২ জুলাই ২০১৯ পত্রিকায়। হিন্দু বাঙালির মধ্যে পুরানো ঘা খুঁচিয়ে অমিত শাহের বক্তব্য উল্লেখ করে ইন্ডিয়া টু ডে সংবাদ মাধ্যমে লেখে , অমিত শাহ সংসদে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বিতর্কের সময়ে দাবি করেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্থানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার ছিল ২৩ শতাংশ। ২০১১ সালে যা কমে হয় ৭.৮ শতাংশ।এই মানুষেরা গেলেন কোথায়? হয় ওদের ধর্ম পরিবর্তন করানো হয়েছে , নয়ত হত্যা করা হয়েছে। তাড়িয়ে দেওয়াও হতে পারে যাঁরা ভারতে চলে এসেছেন।

অথচ তথ্য বলছে, পাকিস্থানের অমুসলিম জনসংখ্যা কখনই ২৩ শতাংশ ছিল না। এমনকি অবিভক্ত পাকিস্থান অর্থাৎ বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার আগেও মুসলিম জনসংখ্যা b১৫ শতাংশও ছিল না। সর্বোচ্চ ছিল ১৯৫১ সালে ১৪. ২ শতাংশ। পশ্চিম পাকিস্তানে যা ছিল ৩.৪৪ শতাংশ। জনগণনার নিরিখে বিগত দশকগুলিতে অমুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৩.৫ শতাংশের আশেপাশে। ভারতের সংবিধানে নাগরিকত্ব সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে ৫ থেকে ২২ অনুচ্ছেদ।৫ ও ৬ অধ্যায়ে সংবিধান প্রযুক্ত হওয়ার দিন অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে কারা কারা ভারতীয় নাগরিক , সেটা নির্দিষ্ট করে বলা আছে।

প্রশ্ন ওঠে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সংজ্ঞায় ভারতে জন্ম হয়েছে এটা প্রাথমিক শর্ত। প্রমাণ হিসেবে বার্থ সার্টিফিকেট। যা দি রেজিস্ট্রেশন অফ বার্থ অ্যান্ড ডেথস্ অ্যাক্ট ১৯৬৯। আইনটি বলবৎ হয় দেশে n১ এপ্রিল ১৯৭০। ফলে স্পষ্ট হয় পশ্চিমবঙ্গে n১ এপ্রিল ২০০২ এর আগে পঞ্চায়েতের হাতে জন্মের শংসাপত্র দেওয়ার কোনো আইনি সংস্থান ছিল না। শহরের পুরসভার ক্ষেত্রে বার্থ সার্টিফিকেট থাকার কথা। পঞ্চায়েত যদি আগে কোনো বার্থ সার্টিফিকেট দিয়েও থাকে আইনি কারণে তা অবৈধ। তাহলে? এতদিন পরিপূরক নথি হিসেবে মাধ্যমিকের এডমিট কার্ড, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট মান্যতা পেয়েছে । তাহলে এখন যাঁদের বয়স ৪০ বা বেশি স্কুলে পড়েননি তাঁদের ভবিষ্যত অন্ধকার।

            বিজেপি নেতা ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু আগেই জানিয়ে রেখেছেন ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। তাহলে এঁদের ভোটে জিতে আসা কোনো বিধায়ক সাংসদ সবাই বেআইনি। সংবিধানে ১৫ নং অধ্যায়ে ৩২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে ১৮ বছরের উপর প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ভোটদানের অধিকার। অর্থাৎ ভোটার হওয়ার দুটি শর্ত। এক নাম। দুই ভারতের নাগরিকত্ব ।তথ্য বলছে, আসামে ১৯৫০ সালের এন আর সির তালিকা তৈরির সময় ১৯৫১ সালের সেনসাস এবং ১৯৫২ সালের ভোটার তালিকাতেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

হরিণঘাটার বিজেপির বিধায়ক অসীম সরকার সঠিক প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ১৯৫৫সালের আইন প্রয়োগ করেই যদি শরণার্থীদের নাগরিক অধিকার দেওয়া যায় তবেএত কাঠখড় পুড়িয়ে ২০১৯ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ করানোর কী প্রয়োজন ছিল? আমরা তাহলে কেন এত আন্দোলন করলাম কেন? যদিও তিনি কোনো অঙ্গুলি হিলনে এখন চুপ করে আছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, মূলত হিন্দু মুসলমান আসলে বাঙালি বিভাজন।বিভাজন তথাকথিত নিম্নবর্ণের সঙ্গে উচ্চ বর্ণের বিভাজন। সবই ভোট ব্যাংকের কারণে। কিন্তু এই সি এ এ আর এন আর সি বাঙালির জন্য কতটা অশনি সংকেত? ইতিমধ্যেই কিন্তু একজন পশ্চিমবাংলার নাগরিক সি এ এ আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন। বিষয়টির আরও গভীরে আগামীকাল।

আগামীকাল ২৪ মার্চ, ২০২৪ পর্ব: ২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *