পর্ব : ৮ ও শেষ পর্ব
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আগের কয়েকটি পর্বে বিবেকানন্দ সমালোচক নিরঞ্জন ধরের লেখনী থেকে বলেছিলাম , বিবেকানন্দের বিদেশ সফর যে শুধু বেদান্ত প্রচার ছিল না, আসলে বেশি প্রয়োজন ছিল অর্থের। কারণ রামকৃষ্ণ অনুরাগী গৃহী ভক্তদের উপাসনা ও সন্ন্যাসীদের মাথার ওপর ছাদ ছিল ভরুরি। এর জন্য দরকার টাকা। আগেই বলেছি আমেরিকা যাওয়ার খরচ কলকাতার কেউ দেননি।শোনা যায়, বিবেকানন্দ ছিলেন দত্ত কায়স্থ। সুবর্ণ বণিক। কলকাতায় আর্থিক প্রতিষ্ঠিত সুবর্ণবণিক সমাজ তাঁদের গোত্রের কেউ বিদেশে গিয়ে নাম করুক সেই হেতু প্রথমে খরচ দিতে চাইলেও পরে কোন এক রহস্যময় কারণে পিছিয়ে যায়।
সেদিনের বরানগর মঠ।
শোনা যায় বরাহনগর মঠের জন্য রামকৃষ্ণ অনুরাগী সুরেশবাবু পাঁচশ টাকা আর এক রামকৃষ্ণ অনুরাগী বলরামবাবুর কাছে গচ্ছিত রাখেন বিবেকানন্দ তাঁর পারিবারিক মোকদ্দমার খরচ বাবদ সেই টাকা ধার নেন। মোকদ্দমা সম্পর্কে কোনো গুরুভাই কৌতূহল দেখালে অসন্তুষ্ট হতেন বিবেকানন্দ। একবার অভেদানন্দ প্রশ্ন করে অপমানিত হন।
অথচ স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব দীক্ষিত কোনো সন্ন্যাসীর অর্থ সংগ্রহকে ব্রাহ্মণ বিধবার অনেককাল হবিষ্যি খেয়ে, ব্রক্ষচর্য করে, বাগদী উপপতি করার সমতুল্য মনে করতেন। যে বিবেকানন্দ দেশীয় রাজা, জমিদার ও আমেরিকা ইংল্যান্ড ও বিশ্বের বহু ধনী অনুরাগীদের কচ থেকে টাকা সংগ্রহ করে বেলুড় মঠ শুধু নয়, সংসারের খরচ হিসেবে মাকে টাকা পাঠাতেন সেই তিনিই ১৮৯৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিসেস বুলকে লিখেছেন মনুর মতে সন্ন্যাসীর পক্ষে সৎকার্যের জন্যও অর্থ সংগ্রহ ভালো নয়। আমি এখন প্রাণে প্রাণে বুঝছি প্রাচীন ঋষিরা যা বলে গেছেন তাঅতি যথার্থ।অথচ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মিশন ও পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে গেছেন। এমনকি মঠের নির্মাণ বাবদ টাকা থেকেও কিছু নিয়ে বাড়িতে পাঠাতেন। এমনকি বিদেশি আর্থিক আনুকূল্যে বেলুড় মঠের জমি কিনেছিলেন নিজের নামে।
মিসেস বুল ও বিবেকানন্দ।
বিবেকানন্দ অনুরাগী মিসেস বুল যিনি ধীরামাতা নামে পরিচিত তিনি ১৯০০. সালের ১ মে একটি পত্র লেখেন যা থেকে জানা যায় , স্বামীজী বেলুড় মঠের জন্য সংগৃহীত ছাব্বিশ হাজার টাকা ভেঙে ফেলেন। মিসেস বুল এককালীন তিরিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ছাব্বিশ হাজার টাকা দেনা শোধের পর চার হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকে সেই টাকার সঙ্গে অন্যসূত্র থেকেপাওয়া দু তিন হাজার টাকা ও সুদের টাকা থেকে ব্যক্তিগত খরচ নির্বাহ করার পরামর্শ দেন। এমনকি টাকা পয়সা হিসেব নিকেশ নিয়ে সন্ন্যাসী হিসেবে মাথা না গলাতে পরামর্শ দেন।
সেই সময়ে নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পুরুষদের অধিকাংশ যুক্তি দিয়েছিল, অর্থ উপার্জন নারীদের জন্য নয়। সমাজের উচিত মেয়েদের চাকরি করতে উৎসাহী না করা। অথচ মার্কিন ব্দেশে শ্রীত সময়ে আর্থিক সংকট এতটা ছিল যে নারী পুরুষ দুজনে কাজ না করতে সংসার চালানো মুশকিল ছিল। পুরুষদের যুক্তি ছিল মা- বাবা দুজনেই চাকরি করলে সন্তান প্রতিপালন ব্যাহত হবে। এটাও স্বাভাবিক ছিল মেয়েরা তখনও রাজনীতিতে উৎসাহী ছিল না। সেই সুযোগে পুরুষদের যুক্তি ছিল নারী যখন রাজনীতিতে উৎসাহী নয়, তখন বাড়ির বাইরে বেরোনোর কি দরকার? এমনকি এও বলা হয়েছিল মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলে চাকরি করলে পুরুষের চাকরির সংস্থান কমবে।
যে বিবেকানন্দ বলতেন, স্ত্রী ভক্তের হাতির রান্নাও খেতে নেই। তাতে মন নিম্নমুখী ও স্বাস্থ্যের হানি হয়।( নব যুগের মহাপুরুষ ,স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, পৃষ্ঠা ১৫৬)। অথচ আমেরিকায় কিন্তু বিদেশি গৃহে অতিথি হিসেবে থাকাকালীন মহিলাদের হাতের রান্না খেয়েছেন।১৮ শতকে আমেরিকায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা ছিলেন গৃহবন্দী। একটা সময় মেয়েরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।১৮৭৬ সালে অর্থাৎ বিবেকানন্দের আমেরিকা পৌঁছানোর মাত্র ১৭ বছর আগে শিকাগোতে মেয়েরা শিকাগো ওমেন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আরও ন বছর পর ১৮৮৫ সালে ক্লাবটি সরকারিভাবে স্বীকৃত আর। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ক্যারোলিন ব্রাউন। প্রায় তিরিশজন সদস্যা সামাজিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সংগঠনের সদস্য ১৮৮৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ছ’ শ। বিবেকানন্দ তখন আমেরিকাতেই
১৮৯৩। শিকাগোর মহিলা নাগরিকেরা তখনও ভোটাধিকারের অধিকার পাননি। পুরুষের অধীন।
এটাও মনে রাখা দরকার তখনও কিন্তু আমেরিকায় ভোট দেওয়ার অধিকার মেয়েদের কয়েকটি প্রদেশ ছাড়া কোথাও ছিল না।মেয়েদের ভোটাধিকার সর্বত্র স্বীকৃত হয় ১৯২০ সালে।১৮৭১ সালে শিকাগোতে একটি বিরাট অগ্নিকাণ্ডে একলাখ মানুষ গৃহহীন হন। কয়েক বর্গমাইল জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। ফলে জনরোষে শহরের প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। শুরু হয় নতুন করে নগরায়নের কাজ। নাগরিক ক্ষোভ দূর করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল ছিল বিশ্ব মহামেলা। সেখানে আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে বিশ্বের সব জায়গা থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের আমন্ত্রণ করা হয়। বিশ্ব বাজারে পরিচিত হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল বিবেকানন্দের।
আমেরিকান মহিলা অনুরাগীদের সঙ্গে বিবেকানন্দ।
আমেরিকান সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে ওঠা স্বচ্ছল নারীদের একাংশ তাই বিবেকানন্দের ভগ্নী সম্বোধনে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। আমেরিকার নারীদের মহীয়সী আখ্যা দিয়ে যে সম্মান বিবেকানন্দ দেখান পরবর্তীকালে তাঁর প্রতি আমেরিকান নারীদের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন এদেশের ( আমেরিকা) স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখিনি।,,, এরা কেমন স্বাধীন! উদ্যোগী। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয় অপবিত্র বলি। তার ফল আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন দরিদ্র। এদের মেয়েরা কি পবিত্র। আবার দেশে ফিরে সেই বিবেকানন্দ বলেন, ওদেশে ( পাশ্চাত্যে) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হত না। ঠিক যেন পুরুষ মানুষ! গাড়ি চালাচ্ছে,অফিসার বেরুচ্ছে , স্কুলে যাচ্ছে, প্রফেসারি করছে! একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা, বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায়।
দেড় বছর পর স্বামীজী যখন দেশে ফেরেন তখন তাঁর সঙ্গে বেশি কয়েকজন আমেরিকান নারী পুরুষ এদেশে আসেন। আমেরিকায় থাকাকালীন এমনই এক ভদ্রমহিলা ইসাবেলাকে এক চিঠিতে লেখেন ,,,, গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটি মীরস্যম পাইপ কিনেছি। ফাদার পোপকে যেন আবার বলো না। কোটের দাম পড়বে ৩০ ডলার। আমি তত বেশ ভালই আছি। খাবারদাবার জুটছে, যথেষ্ট টাকাকড়িও। আগামী বক্তৃতাগুলো হয়ে গেলে ব্যাংকে কিছু রাখতে পারব। আশা করি। এমনকি কলকাতা ফেরার ইচ্ছেও তেমন ছিল না।১৮৮৩ সালের শেষে অনুরাগী আলাসিঙ্গাকে লেখেন, ভারতে গিয়ে ফল কি? ভারত আমার আইডিয়া শক্তিশালী করতে পারবে না। আমার আইডিয়ার প্রতি এদেশের ( আমেরিকার) মানুষ সহৃদয়। নিজের বোনকে লিখছেন আমার হৃদয় রয়েছে আমেরিকায়। আমি ভালবাসি ইয়াঙ্কি দেশকে। স্ববিরোধী বিবেকানন্দ প্রবন্ধে অভিজিৎ রায় লিখেছেন,,, আজকের দুর্দিনের বাজারে কাপড়ের দোকানে সেল দিলে ৪০ ডলারে মেলে থ্রি-পিস স্যুট। সঙ্গে টাই ফ্রি। সেযুগে সেখানে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ১৩ ডলারে তামাকখাওয়ার পাইপ কেনেন। এব্যাপারে বিবেকানন্দের অনুরাগী লুই বার্ক মোহভঙ্গ হওয়ার পর তাঁর সেকেন্ড ভিজিট গ্রন্থে স্বামীজীর ভোগবিলাস ও জিহ্ববা লাম্পট্যের অনেক উদাহরণ সংকলিত হয়েছে।( মেরি লুইস বার্ক, স্বামী বিবেকানন্দ’স সেকেন্ড ভিজিট টু দ্য ওয়েস্ট, বেদান্ত প্রেস)।
( শেষ)