পর্ব : ৬
বিবেকানন্দ জন রাইটের বস্টনের বাড়িতে অতিথি থাকাকালীন।
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আগের পর্বেই উল্লেখ করেছি আমেরিকায় পাঁচদিন কোন কোন বিষয়ে বিবেকানন্দ ভাষণ দেন। সেখানে রামকৃষ্ণের সাধনা সম্পর্কে কোনো উল্লেখ তিনি করেননি। এই নিয়ে রামকৃষ্ণের গৃহী ও সন্ন্যাসীদের একটা ক্ষোভ জন্মেছিল। তাঁরা তীব্র সমালোচনা পর্যন্ত করেছিলেন বিবেকানন্দের। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। নিরঞ্জন ধর তাঁর বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে লিখেছেন,,,,,,, বিবেকানন্দের আমেরিকা যাত্রার উদ্দেশ্য কেবল বেদান্ত প্রচার ছিল না। ধনকুবের ও দানবীরদের দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।,,,,, ভারতীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সিংহভাগও তিনি আমেরিকা থেকে জোগাড় করেছিলেন। একমাত্র বেলুড় মঠ নির্মাণ করতেই সেযুগে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছিল তা থেকেই এসম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণার করা যায়। ( পৃষ্ঠা ৪৫)
স্বামী ত্রিগুণাতীত এক ভক্তের কাছে জানান ৪০ হাজার টাকায় বেলুড়ে জমি কেনা হয়েছে। আরও ১২০ বিঘে জমি কেনা হচ্ছে। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায়।
নিরঞ্জন ধর তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তথ্য পেশ করে এই গ্রন্থে লেখেন, কীভাবে মঠ নির্মাণের ব্যয় সংকুলান হলো বারাণসীবাসী রামকৃষ্ণ অনুরাগী প্রমোদাদাস তা জানতে চাইলে স্বামী ত্রিগুণাতীত লিখে জানান, মঠ নির্মাণের ব্যয়ভার ঈশ্বর-ই গ্রহণ করিয়াছেন _ ৪০ হাজার টাকা দিয়া ১৮ বিঘা উত্তম জমি গঙ্গার পশ্চিম উপকূলে ক্রয় করা হইয়াছে। আরও, মঠের জন্য একশত বিঘা জমি ঐ জমির চতুস্পার্শে ক্রয় করিবার মতো আছে। জমিতেই প্রায় ২ লক্ষ টাকা পড়িয়া যাইবে। এতদ্ব্যতীত মন্দিরাদি নির্মাণ করিতে প্রায় ১০/১২ লক্ষ টাকা পড়িবে। এ সমস্ত বৃহৎ ব্যয়ভার একমাত্র ঈশ্বর ব্যতীত আর কে লইতে সমর্থ? বলা বাহুল্য , ঈশ্বর আমেরিকাবাসীদের হাত দিয়েই বিবেকানন্দে ভিক্ষাপাত্র পূর্ণ করে দিয়েছিলেন।( পৃষ্ঠা ৪৫)
১৮৮২ সালেই বোস্টন শহর থেকে কলকাতায় এসে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন জোসেফ কুক।
এবার সরাসরি চলে যাব মূল প্রসঙ্গে। আমেরিকার মানুষ সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন কেন? এই প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধর তাঁর গ্রন্থে কি লিখেছেন দেখা যাক। লেখক লিখেছেন,,,,, আমেরিকা অবশ্য নিত্য – নতুন হুজুগের দেশ। বিচিত্র সব মতবাদেও সেখানে সমর্থকের অভাব ঘটে না। সাধারণত পাশ্চাত্য দেশবাসীদের কাছে রহস্যবাদী বলে চিহ্নিত ভারতবর্ষের অধ্যাত্ববাদী চিন্তার একটা সীমিত বাজার বরাবরই আমেরিকায় ছিল। বিবেকানন্দ সেখানে বেদান্ত প্রচার করতে গিয়েছিলেন সেকথা আমরা আগেই বলেছি। বেদান্ত কিন্তু তখন শিক্ষিত আমেরিকাবাসীদের কাছে সম্পুর্ণ অজ্ঞাত ছিল না। বিবেকানন্দ আসার আগে বেশ কিছু কাল ধরে থুরো, এমারসন, হুইটম্যান প্রমুখ দার্শনিক ও সাহিত্যিকেরা সেখানে বৈদান্তিক চিন্তা ভাবনার অনুকূলে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। এমনকি রামকৃষ্ণও তখন আমেরিকায় একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। আমেরিকার প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা জোসেফ কুক তাঁর দলবল নিয়ে ১৮৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণকে দর্শন করতে আসেন এবং তাঁর ধর্মীয় জীবনের গভীরতায় মুগ্ধ হন।( পৃষ্ঠা ৪৬)
নিরঞ্জন ধর তাঁর গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে লিখেছেন, বিবেকানন্দ নতুন বিশ্বে যেটুকু প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার কৃতিত্ব তিনি কী বলেছিলেন তার জন্য ততখানি নয়, যতখানি তিনি কেমন করে বলেছিলেন তার জন্য। তিন অসাধারণ বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন এবং ইংরেজি ভাষার ওপর তাঁর দখল ছিল উল্লেখযোগ্য। বিবেকানন্দের অভিনয় দক্ষতাও ছিল যথেষ্ট। কীভাবে সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে হয় সে সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন।,,,,,,,,,, প্রথম বক্তৃতার শুরুতেই বিবেকানন্দ ধর্মসভায় অন্যান্য বক্তাদের চেয়ে নিজের পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত করলেন। অন্যেরা যেখানে শ্রোতৃমন্ডলীকে ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ বলে সম্বোধন করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁদেরকে সম্বোধন করলেন আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ বলে। সঙ্গে সঙ্গে সভাগৃহ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বলে প্রকাশ। এই করতালি তিনি পরেও কয়েকবার পেয়েছিলেন। এখানে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে যে, সভার করতালিধ্বনি ভারতবর্ষ থেকে আগত বক্তাদের মধ্যে কেবল বিবেকানন্দেরই একচেটিয়া ছিল না। অন্যান্য বক্তারাও করতালির দ্বারা যথেষ্ট অভিনন্দিত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, এইসব তথাকথিত বাহবা দানের অনেকখানিই সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল কৃষ্ণকায় বক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য।( চলবে)
পরবর্তী পর্ব : ২০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার,২০২৪