সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : মঙ্গলবার কলকাতা প্রেসক্লাবে ভিড় জমালেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু মেধাবী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী। হাজির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরও কিছু ছাত্রছাত্রী। উপলক্ষ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ওবিসি সংরক্ষণ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করার আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে আলোচনা সভা ও সাংবাদিক সম্মেলন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজি মাসুম আখতার তীব্র অভিযোগের সুরে বলেন,শুধু ভোটের স্বার্থে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ব্যবহার করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাঁদের সমষ্টিগত মানোন্নয়নের কোনো চেষ্টা করেনি কেউ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কিংবা শিক্ষা সংক্রান্ত পদে দলিত মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব সামান্যই। তাঁর বিষ্ফোরক অভিযোগ , যতদিন আমি বাম সরকারের সমালোচনা করেছি, ততক্ষণ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নজরে ভালো ছিলাম। মুসলিমদের নিয়ে একই খেলা যখন মমতা করতে শুরু করলেন , তখন আমি হলাম চোখের বালি। স্পষ্টই বললেন, মুসলিম ভোট মানে দুধ দেওয়া গরু, তার প্রতিবাদ করায় এখন আমি তাঁর বিষনজরে। আমি রাজনীতির লোক নই।অন্যায় হলে প্রতিবাদ করবই। যে বিজেপি সরকার সবকা সাথ, সবকা বিকাশ বলে, তাঁরা নিজেরাই মুসলিম। বিরোধী। এবার রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ইচ্ছাকৃত এমন কিছু আইনি ভুল করবেন, যেন কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। তাঁর পক্ষে প্রচার করা সম্ভব হবে, আমি তো ওবিসি সংরক্ষণ দিয়েছিলাম। কেন্দ্রের প্রভাবে হাইকোর্ট সেই অধিকার কেড়ে নিতে রায় দিয়েছেন। তিনি মুখে বলছেন, আদালতের রায় মানছি না। এটা কোনো যুক্তিযুক্ত কথা নয়। বরং উচিত ভুলগুলি শুধরে নেওয়া।
উল্লেখ্য, গত ২২শে মে কলকাতা উচ্চ আদালতের দু সদস্যের বেঞ্চের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ও তপোব্রত চক্রবর্তী এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছেন,২০১২ সালের বিধি অনুযায়ী সব ওবিসি শংসাপত্র বাতিল। যাঁরা এই শংসাপত্রের ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছেন তাঁদের চাকরি থাকবে। যাঁরা পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁরাও এই রায় থেকে মুক্ত। এমনকি যাঁরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও কোনো প্রভাব পড়বে না। আদালত এও বলেছে, নতুন তালিকার ক্ষেত্রে ১৯৯৩ সালের আইন মেনে কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অনগ্রসর কল্যাণ দফতর তাদের সুপারিশ বিধানসভার পেশ করবে। বাম আমলে ৪১ টি মুসলিম সম্প্রদায় – সহ মোট ৪২ টি সম্প্রদায়কে তালিকাভূক্ত করার সুপারিশ করলে বাম সরকার মেনে নেয়।২০১২ সালের ১১ মে তৃণমূল সরকার আরও ৩৫ টি সম্প্রদায়কে ( ওবিসি গোত্রে ৯ টি এবং ওবিসি – বি গোত্রে ২৬ টি সম্প্রদায়কে ) তালিকাভূক্ত করে।২০১২ সালে এগজিকিউটিভ অর্ডারে সংরক্ষণ চালু হয়।
কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের বাস্তব অবস্থা কি? স্বাধীনতার আগেই চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলায় মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু হওয়ার সুবাদে ৬০ শতাংশ চাকরিতে সুযোগ পাবেন যদি বাংলায় ক্ষমতা পায় কংগ্রেস। তিনি বেআরও বলেছিলেন কলকাতা পুরসভায় মুসলিম সংরক্ষণ হবে ৮০ শতাংশ। চিত্তরঞ্জন বুঝেছিলেন, মুসলিমদের মূল সমস্যা আর্থিক দুর্বলতা। তাই যতক্ষণ না মুসলিমরা বাংলায় সরকারী চাকরি ও জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব পাবেন ততদিন বাংলায় গনতন্ত্র আসবে না। ওরিয়েন্ট লং ম্যান প্রকাশন থেকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম গ্রন্থের ২৩/২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। এরপর বয়স বেড়েছে বয়সের। গত ৩৪ বছরের বাম শাসনে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অবস্থা ভারতের সব রাজ্যের চাইতে খারাপ। সাচার কমিটির রিপোর্টে তার উল্লেখ আছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু রাজ্যে মুসলিমদের পিছিয়ে থাকা শ্রেণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
একটি জাতিকে উন্নত করতে দরকার শিক্ষা। অথচ মুর্শিদাবাদ মালদা ও দুই দিনাজপুরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। পরিসংখ্যান সত্যিই বলছে, তথাকথিত হিন্দু এস টি এস সিদেরও চেয়ে করুণ অবস্থা মুসলিমদের।২০২০ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন তাঁর বাঙালি মুসলিমদের সংকট বইতে লিখেছেন, তফসিলিজাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত পুরুলিয়া জেলাতে প্রতি ৮৫২ জন মানুষ পিছু একটি স্কুল। সেখানে মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে ১৮৫১ জন পিছু একটি স্কুল। তিনি মাদ্রাসার ছবিও তুলে ধরে বলেছেন, জঙ্গিপুর মুনিরিয়া হাই স্কুলের ২৭০০ জন ছাত্র পিছু শিক্ষক ১৭। রহাতপুর হাই মাদ্রাসা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ১৯০০ ছাত্র পিছু শিক্ষক ১৭ জন। ভাটশালা হাই মাদ্রাসা যেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়, সেখানে ১০৫৯ ছাত্র পিছু ৫ জন শিক্ষক। মুসলিম অধ্যুষিত রায়গঞ্জ কর্পোরেশ স্কুলের ১৬০০ জন ছাত্র পিছু শিক্ষক ৪২ জন।
সুরেশ্বর সরকার তাঁর ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস বইতে ১১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন , গুপ্ত যুগ থেকে আমরা শুদ্র অতি শুদ্র নামে চিহ্নিত। আমাদের পূর্বজনেরা যখন মনুবাদী শক্তির বিরুদ্ধ লড়াই বেশুরু করেছিলেন, সেই ইংরেজ আমলে আমাদের নাম দেওয়া হয় অপ্রেসড অর ডিপ্রেসড ক্লাসেস ও বি সির অনেকেই সেই দলে নাম লেখাতে অস্বীকার করল। ফলে সংবিধানে স্থান পায় আর্টিকেল ৩৪০। মুসলিমদের তুরুপের তাস করে রাজ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ব্যক্তিস্বার্থ পূরণ করেছে। দেশের শীর্ষ আদালতের প্রথম মহিলা বিচারপতি ছিলেন ফাতিমা বেভি। বিচারপতি ফাতিমা বেভি ১৯৮৯ সালে শীর্ষ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ হওয়ার পর বলেছিলেন , ভারতের বিচার বিভাগ একটি পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।ধর্মের ভিত্তিতেও বিভাজন আছে। কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে,২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দেশে উচ্চ আদালতে নিযুক্ত হয়েছেন ৬৫০ জন বিচারক। এঁদের মধ্যে ৪৯২ জন সাধারণ বিভাগের। শতাংশের হিসেবে ৭৫.৬৯ । এই সময়ে তফসিলি জাতি ( এস সি) নিযুক্ত হয়েছেন ২৩ জন।১০ জন তফসিলি উপজাতি ( এস টি ) বিভাগে নিযুক্তের সংখ্যা ৭৬ জন। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী থেকে নিযুক্তির সংখ্যা ৩৬ জন। লোকসভায় কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির পরিসংখ্যান ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা ২০ কোটি।২০১১ সালের আদম শুমারিতে যে সংখ্যা ছিল ১৪.২ শতাংশ। সাতবছর বয়সি ও তার উর্দ্ধে সাক্ষরতার হার ৭৭.৭ শতাংশ। তবু কেন্দ্রীয় সরকারি কোনো মুসলিম প্রতিনিধি নেই। বাংলায় প্রায় ৩০ শতাংশ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু রাজ্য মন্ত্রিসভায় আনুপাতিক হার কি স্বাভাবিক?
অথচ এটাও বাস্তব,২০১৯-২০র তুলনায় ২০২০ -২১ শিক্ষাবর্ষে সারা দেশে উচ্চশিক্ষায় মুসলিম পড়ুয়ার সংখ্যা যখন কমছে, তখ পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনহাজার। কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রে মুসলিমরা ব্রাত্য হয়ে আছেন। তবে মাসুম আখতার সাহেব যেটা বললেন না সেটা হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলে যে বাংলার বাঙালি মুসলিম ব্রাত্য হয়ে আছেন তা নয়। নাহলে কলকাতায় প্রথম এসে নজরুল যে মেসে উঠেছিলেন সেখানে রান্নার ঠাকুর আর হিন্দু বোর্ডারদের আপত্তিতে তাঁকে কোনোক্রমে এক রাত্রি কাটিয়ে কমিউনিস্ট নেতা মুজ্জাফর আহমেদের চেষ্টায় শিয়ালদা অঞ্চনের একটি মেসে চলে যেতে হয়? কেন আজও কোনো বাঙালি মুসলিম হিন্দু মহল্লায় বাড়ি ভাড়া পান না? বাঙালি মুসলিম দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ পড়েছেন কিন্তু মোশারফ হোসেনের জমিদার দর্পণ পড়েননি। বাঙালি মুসলিম বিভূতিভূষণ চেনে কিন্তু আব্দুল জব্বারের ইলিশমারির চর পড়েননি। বাঙালি মুসলিম ক্ষুদিরামকে চেনেন কিন্তু বাঙালি মুসলিম বিপ্লবী যিনি প্রথম ফাঁসিতে জীবন দেন সেই আসফাকউল্লাকে কজন বাঙালি মুসলিম চেনেন? বাঙালি হিন্দু মুসলিম বাঙালিকে বাঙালি মানেন না। তাই শরৎচন্দ্র লেখেন, বাঙালির সঙ্গে মুসলমানদের ক্রিকেট খেলা। অস্বীকার করার উপায় নেই কলকাতায় বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন উর্দুভাষী মুসলিমরা ।পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগ নেই। মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি নিয়ে যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়, বাঙালি মুসলিমদের প্রসঙ্গ ওঠে না। ফলে বাঙালি মুসলিম যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গেছেন।
বাঙালি মুসলিমদের ব্রাত্য করে রাখার পরিকল্পনা যে এদেশীয় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা শুরু করেন তা নয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারত শাসনের ক্ষমতা হাতে পায়, তখনই সিদ্ধান্ত নেয় মুসলমানদের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে তাদেরকে দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত করবে। মন্থরগতিতে ব্রিটিশ এই পরিকল্পনা চালায়।১৮৬৯ সালে মুসলমানদের চাকরি কমিয়ে হিন্দু নিয়োগ করে দেওয়া হয়।১৮৭১ সালে তিনজন হিন্দু পিছু একজন মুসলিম চাকরিজীবী হল। এরপর প্রতি দশজনে একজন। আইনি ও কর সংক্রান্ত চাকরিতে ৩৩ জনের মধ্যে শূন্য, আই টিতে ১৯৬ জনের মধ্যে ৩০ জন। রেজিস্ট্রি বিভাগে ৫৮ জনের মধ্যে ২ জন। জজ ও সাব জজ ৪৭ জনের মধ্যে মুসলমান ৮ জন। এই তথ্য আছে গোলাম আহমাদ মোর্তজা লিখিত বজ্রকলম গ্রন্থের চাকরির বণ্টন ব্যবস্থা শীর্ষক রচনার২৬৭/২৬৯ পৃষ্ঠায়। বাঙালি মুসলিম শুধু হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী নয়, মুসলিম ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রেরও শিকার। এদিনের অনুষ্ঠানে মুসলিম সমাজের কিছু বিদগ্ধ মানুষ যেমন বক্তব্য রাখেন,1 তেমন বক্তব্য রাখেন শেখ আবিড হাসান ও আলিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উসামা চৌধুরী প্রমুখ।