প্রয়াত রিয়েলিস্টিক ছবির দুনিয়ার অন্যতম উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর স্মরণসভা

*

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ২০ আগস্ট সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার নিজের ফ্ল্যাটে প্রয়াত হন লেখক পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ।মৃত্যুর সময়ে বয়সে হয়েছিল ৭৬ বছরটি।২ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকেলে কলকাতায় প্রেস ক্লাবে অনুরাগীরা আয়োজন করেন এক স্মরসভার। উপস্থিত ছিলেন উৎপলেন্দুর দাদা প্রয়াত প্রাবন্ধিক দীপেন্দু চক্রবর্তীর পরিবারের লোকজন। ছিলেন কিছু বন্ধু,কিছু অনুরাগীরা। এসেছিলেন সমসাময়িক পরিচালক গৌতম ঘোষ, অনুষ্টুপ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্য। পরিচালক গিল্ডের প্রাক্তন সম্পাদক অশোক দে প্রমুখ।আয়োজকদের প্রধান ছিলেন তাঁর শেষ জীবনের অনুরাগী তথা সঙ্গী পরিচালক জীবনের সহকারী অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়। প্রত্যেকেই উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।অনুষ্ঠানের হাজির ছিলেন এই প্রতিবেদকও। স্মৃতিসভায় এই প্রতিবেদকও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করেন।

জীবন নামের চলমান উপন্যাসের আরও কিছু পর্ব থাকতে পারত উৎপলেন্দুর। উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর। ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান উৎপলেন্দু পাবনার ভূমিপুত্র।কিন্তু স্নাতক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জীবনবোধের বৌদ্ধিক চেতনা তাঁকে তাড়িত করেছে নতুন সূর্যের দেখার । তাই হয়ত নকশালরবাড়িত রাজনীতিতে আকর্ষণ। কিছুদিন চলে যান বাংলায় বিহার উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী এলাকার আদিবাসী স্কুলে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। এরপর কলকাতায় রুটি রুজির তাগিদে স্কুল শিক্ষকতা। বাম রাজনীতির কারণে শাসকের রসে কারারুদ্ধ।বিশ্ববিদ্যালয়ে বান্ধবী ইন্দ্রানীর সঙ্গে ঘর বাঁধা। পুত্র গোগোলের জন্ম। পাইকপাড়ার হর্ষমুখী রোডের বাড়িতে রবিবারের সকালে বসত আড্ডা। সিনেমা,রাজনীতির ছিল মুখ্যত আলোচনার বিষয়। আইজেন স্টাইন থেকে গোদার,ক্রুফো ফেলিনি পেরিয়ে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল ঘুরের তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার , উত্তম সৌমিত্রতে আলোচনা চলতে থাকত। সময়টা ১৯৮২। ফলে খুব বাড়ি আন্দোলনের ব্যর্থতা, বামফ্রন্টের শাসন সেসব থাকত আলোচনায়। বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে তখন রিয়েলিস্টিক সিনেমার নামকরণ হয়েছিল নিউওয়েভ ।

মুক্তি চাই ছবির সূত্রে শিক্ষক উৎপলেন্দুর নতুন পরিচয় হলো চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে। মুক্তি পেল চোখ। মিলল সেরা ছবি ও সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরষ্কার।জনমানসে মিলল স্বীকৃতি। ময়না তদন্ত , দেবদাস সহ আরও কিছু ছবি। পাশপাশি কিছু তথ্যচিত্র। এই তালিকায় মূল্যবান সংযুক্তি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীত ও দেবব্রত বিশ্বাসের তথ্যচিত্র। এরপর জীবনের তৃতীয় পর্ব। ছন্দপতন ব্যক্তিগত জীবনে। প্রথম স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে দূরত্ব। নতুন জীবনের শুরু অধ্যাপক তরুণ সান্যালের কন্যা শতরূপা সান্যালের সঙ্গে প্রণয়। বিয়ে।দুইটি কন্যা সন্তানের জনক হলেন উৎপলেন্দু।১০০ শতাংশ বাণিজ্যিক ছবি ছন্দনীড়। আক্ষেপ করে বলেছিলেন সেই নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা।

ক্রমশ দ্বৈত চরিত্রের শিকার হলেন উৎপলেন্দু। একদিকে বাম প্রতিবাদী সমঝোতাহীন লড়াই অন্যদিকে পারিবারিক জীবনে আর্থিক সংকটে সমঝোতা।সাইট দুইয়ের টানাপোড়েনে একটু একটু করে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছেন মননে । অভিমানী শিল্পীমন নিয়ে ক্রমশ মধ্যবিত্ত চক্র ব্যূহে ঢুকে পড়েন। কিন্তু বেরোনোর পথটি জানতেন না আজকের অভিমন্যু। ফলে দ্বিতীয় সংসার ভেঙে একাকী। সুখদুঃখের সাথী কেবল সহ পরিচালক ও বন্ধু অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়। সন্তানের চেয়েও বেশি আগলে রেখেছিলেন অর্থ তাঁকে।

আচমকা পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙল। ছিল আরও কিছু বার্ধক্যজনিত ব্যাধি। শেষ জীবনে ছিল না কারও বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ। ছিল শুধু একরাশ অভিমান। সেই অভিমান নিয়েই চলে যান তিনি। অনুষ্ঠানু চলাকালীন এলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক গৌতম ঘোষ। তাঁর স্মৃতিচারণে উঠে এল, উৎপলেন্দুর নিজেকে গুটিয়ে ফেলার কথা। গুণী মানুষকে নিয়ে থাকে অনেক বিতর্ক। উৎপলেন্দুও তার থেকে মুক্ত নন কিন্তু তাঁর প্রতিভার যে স্ফুরণ রেখে গেছেন বাঙালিস্মরণে না রাখলে হবে নতুন করে আত্মঘাতী। গৌতম ঘোষ জানান আগামী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে থাকবে উৎপলেন্দুর চক্রবর্তীর ছবি।

অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায় জানান , সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীতে নিয়ে যেত অসামান্য ছবিটি বানিয়েছিলেন উৎপলেন্দু সেটির মূল কপি আছে এন এফ ডি সির কাছে অনেক অনুরোধেও ছবিটি সত্যজিৎ রায়কে দেখাতের পারেননি প্রয়াত পরিচালক। একেই বোধহয় বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের দেওয়া ফ্ল্যাটের আইনি দাবিদার না থাকায় ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দিতে হব রাজ্য সরকারকে। প্রয়াত পরিচালকের ঘরের জিনিষ পুরষ্কার সব স্থান পেয়েছে অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি স্মরণ অনুষ্টানে হাজির মেয়র ফিরাদ হাকিমের কাছে একটি স্মৃতিগৃহের অনুরোধ জানান। মেয়র বিষয়টি দেখার অঙ্গীকার করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *