শ্রীজিৎ চট্টরাজ : রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে সুরের সম্পর্ক বোঝাতে সৈয়দ মুজতবা আলী মাছের সঙ্গে ঝোলের সম্পর্কের উল্লেখ করেছিলেন। তেমনই বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক বোঝাতে দাদু ও নাতির সম্পর্কের সেতুর কথা উদাহরণ হিসেবে বলাই যায়। ইতিহাসে সাহিত্যের সৃষ্টি বহু প্রাচীন । বিজ্ঞান তো অল্প কিছুদিন আগের আবিষ্কার। বিজ্ঞানের প্রয়োগও বলতে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ে। এখনও অনেক পথ চলা বাকি। যদিও বিজ্ঞান ও সাহিত্য দুই মেরু মনে হলেও দুটি বিষয়ের এক যোগসূত্র আছে। সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য বিনোদন শর্তে জীবনের গভীরতা মাপা। আর বিজ্ঞান প্রমাণের নিক্তিতে সত্যের খোঁজ করে। সাহিত্য যখন হৃদয়ের অস্তিত্ত খোঁজে বিজ্ঞান তখন মস্তিষ্কের সূক্ষ্মতা নিরূপণ করে। মানুষ সেই কবে ডানা জুড়ে পরীর কল্পনা করেছিল, বিজ্ঞান তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে বিমান আবিষ্কার করে। বিদেশে সাহিত্য ও বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে চললেও আমাদের দেশে এখনও সমাদর পায়নি।
অন্যতম কারণ, কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় ভারতীয়দের প্রকৃতি নির্ভরতা বেশি। দর্শন তাই ভাববাদী। বিষয়টি নিয়ে আইনস্টাইন ও রবিকবির মুখোমুখি আলোচনা হয়েছে । দুজনেই দুজনের বোধ ও চেতনার স্তরে দুটি মত প্রকাশ করেছেন। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। ফিরে আসা যাক কলকাতা প্রেস ক্লাবে। সম্প্রতি সৌমিক চৌধুরী তাঁর নিজের লেখা কাহিনী অবলম্বনে প্রথম পরিচালিত ছবি নীরব মৃত্যুদণ্ড’র কাহিনী গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করলেন। পেশাগত ভাবে সৌমিক একজন এম ডি ডাক্তার ফরেনসিক বিভাগের। সহকারী অধ্যাপক ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজির । আমেরিকা ও স্কটল্যান্ড থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক স্বীকৃতি। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ও আরব মেডিক্যাল জার্নাল অফ ফরেনসিক সাইন্সেস অ্যান্ড ফরেনসিক মেডিসিনের পর্যালোচক।নীরব মৃত্যুদণ্ড ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যের দায়ও সৌমিকের। ছবির প্রযোজক বাণী। ক্যামেরায় স্বয়ানভ, সম্পাদক সুদীপ, সংগীত পরিচালক পরাগবরণ। অভিনয়ে আছেন সৌমদেব, রাজর্ষি, মহুয়া, ইন্দ্রনীল সঙ্গীতা, শাকিল, ঐশী, সুকান্ত প্রমুখ। ইতিমধ্যেই ছবিটি তিনটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে।
ছবির কাহিনী তথাকথিত বাণিজ্যিক ফর্মুলায় তৈরি নয়। পরিচালক তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতার নিরিখে কাহিনী নির্মাণ করেছেন। ফলে নীরব মৃত্যুদণ্ড কাহিনীর ভিত্তিতে বাংলা ছবি যে সাবালক গোত্রে স্থান পেয়েছে বলাই যায়। পরিচালক কাহিনীকার সৌমিক অরিত্র , তিয়াশা ও তাঁদের ছোট্ট সন্তান পাভেলকে ঘিরে কাহিনী নির্মাণ করেছেন। অতিমারী পরিস্থিতিতে বিশ্বে ওঠা ঝড়ের প্রকোপ এই ছোট্ট সংসারেও পড়ে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় তিয়াশা যখন জায়েদ নামের এক তরতাজা যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সাংসারিক ছন্দপতন চরম পর্যায়ে পৌঁছয় যখন তিয়াশার একরত্তি সন্তান আকস্মিক বিষক্রিয়ায় মারা যায়। অভিযুক্ত হয় তিয়াশা। চিকিৎসক রায়ান রায়ের রিপোর্টে প্রমাণিত হয় পাভেলের মৃত্যুর কারণ ইথিলিন গ্লাইকল পদার্থের বিষ। তিয়াশার আইনজীবি অদিতি বোস বিখ্যাত জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ডা,: অরুণাভ রায়চৌধুরী আদালতে প্রমাণ করেন, গ্লাইকল পয়জনিং এবং জন্মগত অসুখ মিথাইল ম্যালোনিক এসিডিমিয়ার সাদৃশ্য আছে। সুতরাংপাভেলের মৃত্যুর কারণ গ্লাইকল জাতীয় বিষ থেকে হয়েছে নিশ্চিত করে বলা যায়না। শেষপর্যন্ত প্রমাণের অভাবে আইনি জাল থেকে তিয়াশা মুক্ত হয়।
জটিলতা আরও বাড়ে, যখন তিয়াশা বুঝতে পারে _সে সন্তানসম্ভবা । তিয়াশার জীবনে চারিদিক যখন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দেয়াল গড়ে ওঠে, তখন স্বামী অত্রিয় তিয়াশার পাশে থেকেছে। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নবজাতকের অসুস্থতা। আবার সন্দেহের তীর তিয়াশার দিকে। দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা। রিপোর্টে সেই ইথিনিল গ্লাইকল বিষ মেলে। মাতৃত্বের এই সন্তানঘাতক রূপ সমাজে আলোড়ন ফেলে দেয়। আদালতে তিয়াশার জামিন নাকচ হয়। আদলত প্রথম সন্তান হত্যা ও দ্বিতীয় সন্তান হত্যার ষড়যন্ত্রে তিয়াশাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। এখানেই শেষ হতে পারত কাহিনি। কিন্তু ক্লাইম্যাক্স চরমে ওঠে, যখন একটা ইমেইল আসে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রায়ান ঘোষের কাছে । যেখানে উল্লেখ হয়েছে, কি গভীর ষড়যন্ত্র করে পাভেলের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সুতরাং রহস্যের শেষটুকু জানতে ছবিটি দেখতে হয়।
দিগদর্শন পোর্টালের পাঠকদের মনে থাকতে পারে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ এর ডিসেম্বর মাসে উজবেকিস্তান প্রশাসন অভিযোগ জানিয়েছিল, ভারত থেকে আমদানীকৃত শিশুদের কাফ সিরাপ খেয়ে সেখানকার ১৮ টি শিশু মারা গেছে। তদন্তে জানা গেছে, সিরাপে অবৈধ ভাবে মেশানো হয় ইথিলিন গ্লাইকল। ওষুধটির নির্মাতা ভারতে নয়ডা অঞ্চলের মারিয়ন বাওটেক কোম্পানি। ইথিলিন গ্লাইকল একটি আর্সেনিক ধরণের বিষ। বাংলায় বলা যায় সেঁকো বিষ। ফ্রিজে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রড বা তার কম তাপমাত্রায় কোনো তরল রাখলে সেটি জমে বরফ হয়।কিন্তু ঠান্ডা পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসে তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটায় না। কারণ এইসব কোমল পানীয়তে এ্যান্টি ফ্রিজার হিসেবে মেশানো হয় ইথিলিন গ্লাইকল। মানবদেহের জন্য যা নীরব ঘাতক। মূলত শিল্প কারখানার জন্য ব্যবহৃত এই রাসায়নিক স্বচ্ছ বর্ণ গন্ধহীন একটি উপাদান। সৌমিক চৌধুরী তাঁর গল্পে জানিয়েছেন, জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ডা: অরুণাভ রায়চৌধুরি আদালতে প্রমাণ সহ তথ্য পেশ করে জানিয়েছেন, ইথিনিল গ্লাইকল রাসায়নিকের সঙ্গে জেনেটিক রোগ মিথাইল ম্যালোনিক এসিডিমিয়ার মিল আছে। যেটি জন্মগত ত্রুটি। এই ত্রুটি নবজাতকের মানব রক্ত পরীক্ষার যে স্ক্রিনিং পদ্ধতি আছে তাই দিয়ে সনাক্ত সম্ভব নয়। একমাত্র জন্মের ২১ তম দিনে কুইবেক নিওনেটাল ব্লাড এন্ড ইউরিন স্ক্রিনিং করে জানা যেতে পারে। তবে সব রোগীর ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়।
এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক সূত্র বলেছে, ম্যালোনিক এসিডিমিয়া ও অটোসোমাল রিসেসিভ ইন্টেলেকচুয়াল ডেভলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার রোগে উচ্চমাত্রায় ম্যালোনিক অ্যাসিড ও মিথাইল ম্যালোনিক অ্যাসিডের জৈব রাসায়নিক আছে। বাংলা সাহিত্য বা সিনেমায় এর আগে সম্ভবত এমন বিষয় বা রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ে কোনো কাজ হয়নি! সেক্ষেত্রে বাঙালি পাঠক বা দর্শককে সাবালক করার যে প্রচেষ্টা পরিচালক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৌমিক চৌধুরী তাঁর সিনেমা বা সদ্য প্রকাশিত বইয়ের মাধ্যমে করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে ছবির কলাকুশলী ও শিল্পীদের সৌমিক কতটা সিনেমা নামক মাধ্যমটির মাধ্যমে উত্তরণ ঘটিয়েছেন সেটা বোঝা যাবে ছবিটি মুক্তি পেলে।
মনে পড়ছে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রের কথা। তিনি তাঁর বিজ্ঞানে সাহিত্য সম্পর্কে এক সভায় বলেছিলেন, প্রশ্ন হইতে পারে, সাহিত্য ক্ষেত্রে কি বিজ্ঞান সেবকের স্থান আছে?,,,,,,,,, আজ আমাদের পক্ষে সাহিত্য কোনো সুন্দর অলঙ্কার মাত্র নহে_ আজ আমাদের চিত্তের সমস্ত সাধনাকে সাহিত্যের নামে এক করিয়া দেখিবার জন্য উৎসুক হইয়াছি।