সুদীপ্ত ব্যানার্জির ছবি দন্ত রহস্য

*

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : শনিবার বিকেলে পরিচালক সুদীপ্ত ব্যানার্জি তাঁর মুক্তি আসন্ন বাংলা বড় পর্দার ছবি দন্ত রহস্য নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হলেন। ছবির ট্রেলার পোষ্টার ও সংগীত মুক্তি ঘটালেন। ছবি অবশ্যই রহস্যধর্মী। এমনটাই বললেন পরিচালক। ওড়িশার ঐতিহাসিক প্রত্ন ময় এলাকায় এক বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সূত্রে পরিচালকের এই ছবির প্লট মাথায় আসে। পরিচালক মন রসদ খুঁজবেন একথা তো বাঙালির প্রিয় লেখক শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় কত আগেই তো বলে গেছেন। বহু ঐতিহাসিক তথ্যকে জুড়ে রহস্য গল্প তিনি অমর করে গেছেন তাঁর সত্যান্বেষী ব্যোমকেশকে সামনে রেখে। তিনি লিখেছেন, শিল্পীর শিরে পিলপিল করে আইডিয়া, লেখেন যখন পুস্তক তিনি তাই দিয়া, উইপোকা কয় চল এইবার খাই গিয়া। গোয়েন্দা গল্পে ঐতিহাসিক সূত্র সংযোজন করার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে শরদিন্দু বলেছিলেন, আমি বাঙালিকে তাহার প্রাচীনের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছি। বাঙালি যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে, ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইবে না।

বাঙালি তাই পেয়েছে কালের মন্দিরা, গৌড়মল্লার , তুমি সন্ধ্যার মেঘ, শিবাজি ও সদাশিব ও আরও অনেক গল্প। ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার শরদিন্দুকে বলেছিলেন, লোকে ইতিহাস পড়ে না, কিন্তু আপনার বই পড়বে। ঝিন্দের বন্দী ছবিটি যাঁরা দেখেছেন জানেন ইতিহাস ও রহস্য কতটা হাত ধরাধরি করে জনপ্রিয় হতে পারে। পরিচালক সুদীপ্ত ব্যানার্জি এমনই এক বিষয় বেছে নেন যেখানে কেন্দ্রবিন্দু বুদ্ধদেবের দাঁত। বুদ্ধদেবের দর্শন ও মৃত্যু নিয়েও যেমন এক রহস্য থেকে গেছে, তেমনই তাঁর দেহের হাড়, চুল সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও দাঁত নিয়েও এক রহস্যের জাল ছড়িয়ে আছে। বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা মনে করেন, নেপাল ও ভারত জুড়ে থাকা স্তুপে বুদ্ধের দাহকৃত দেহাবশেষের প্রামাণিক টুকরো ছড়িয়ে আছে। কেউ বলেন কাঠমাণ্ডুর স্বয়ম্ভুনাথ স্তুপে তাঁর কিছু অস্থি সমাহিত আছে। বিশ্বাস -মায়নমার , চিন , জাপান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকাতেও আছে বুদ্ধের দেহাবশেষ। রয়েছে তাঁর ভিক্ষাপাত্র। ল্যাটিন একটি শব্দ আছে ন্যুমিয়াস। যা ন্যুমেন থেকে এসেছে। জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক রুডলফ অটো ১৯১৭; সালে তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা দি আইডিয়া অফ দি হোলি বইটিতে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ন্যুমিনিয়াস অর্থ ধর্মীয় আবেগ জড়ানো রহস্যময় বা বিস্ময়কর।

ওড়িশায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ওড়িশা জুড়ে আর্কিওলোজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রত্নগিরি, উদয়গিরি ও ললিতগিরি বৌদ্ধ স্থাপনাগুলির বিস্ময়কর আবিষ্কারের ফলে নতুন করে কৌতূহল ও রহস্য দানা বাঁধে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দীর বৌদ্ধ জাতক কাহিনীতে কলিঙ্গ রাজ্যের উল্লেখ আছে। কলিঙ্গের রাজধানী দন্তপুরা। যেখানেএক ইউ আকৃতির চৈত্য গৃহে কয়েকটি ছোট স্তূপ মেলে, যেখান থেকে উদ্ধার হয় বুদ্ধের একটি দাঁত। যা শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওড়িশা প্রশাসনের দাবি, বুদ্ধের একটি দাঁত ১৯৮৫ সালে ললিতগিরিতে খনন চলার সময়ে মেলে যা ওড়িশার পর্যটন বিভাগ প্রথম এক প্রদর্শনীতে উন্মুখ করে ২০১৩ সালে।

সে যাই হোক। পরিচালক সুদীপ্ত ব্যানার্জি সাংবাদিক সম্মেলনে ছবির যে ট্রেলার দেখান, সেটি হতাশ করল। গ্রন্থে মলাট যেমন গ্রন্থের ললাট, তেমন চলচ্চিত্রের ট্রেলার অনেকটা সিঁদুরে মেঘের মত। যা ঈশান কোণে দেখলে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফিল্ম সম্পাদনার গুরু দায়িত্ত্ব থাকে ছবির পরিচালকের ত্রুটি ঢেকে দর্শকদের কাছে ছবিটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা। রহস্যধর্মী ছবিতে গানের সিচুয়েশন খোঁজা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতই। তাই নিজের প্রথম রহস্যধর্মী ছবি কুহেলি বানাতে গিয়ে পরিচালক নিজের নাম গোপন রেখে অভিমন্যু পরিচয় দেন। ছবিতে বেশ কয়েকটি গান হেমন্ত মুখার্জি সুর দেন । ছবির সঙ্গে যা প্রাসঙ্গিক শুধু নয়, রীতিমত জনপ্রিয় হয়। ছবির নেপথ্য সঙ্গীতেও সুর এক বড় ভূমিকা নেয়। রহস্যধর্মী পরিবেশ রচনায় কোমল ও কড়ি স্বরের অধিক ব্যাবহার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সৈকত মিত্রের গলায় সঙ্গীত পরিচালক যে থিম সং ব্যবহার করেছে তাতে আবেগ আছে, রহস্যের অনুভূতি আসে নি। সম্পদক কিছু দৃশ্য জুড়েছেন ট্রেলারে, সেটি ছবি সম্পর্কে আগাম আগ্রহ গড়ে তুলতে পারেনি। ছবিতে কয়েকজন পেশাদার অভিনেতা আছেন ঠিকই, কিন্ত তাঁরা চিত্রনাট্যের দাবি মিটিয়েছেন মাত্র। চলচ্চিত্র নির্মাণে সবচেয়ে বেশি শক্ত কমেডি ও সাসপেন্স ছবি নির্মাণ। বুদ্ধদেবের যে দাঁত নিয়ে গল্পের বুনন , ট্রেলারে সেই দাঁতের রহস্যের ইঙ্গিত পেলাম না। তবে প্রয়াত অভিনেতা পরিচালক কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার এই কলমচিকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, কোয়ান্টিটির মধ্যেই কোয়ালিটি লুকিয়ে থাকে। সেটাই স্বান্তনা। বাংলা ছবি তৈরি আর বিপণন এখন বৃহৎ পুঁজির হাতে। সেখানে অসম লড়াইতে অস্তিত্ব জানান দেওয়া ছোট নির্মাণকারীদের পক্ষে সাহসী পদক্ষেপ। তাই নির্মাণে একটু সচেতন থাকা দরকার নিজ স্বার্থেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *