সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: সম্প্রতি বাংলায় পালিত হয়েছে গাজনের একমাসব্যাপী ব্রত ও চড়ক। দুটি আলাদা বিষয়। গাজন ব্রত তিনটি পর্বে। ঘাট সন্ন্যাস , নীল ব্রত ও চড়ক। গাজন শব্দের উৎপত্তি গ্রাম জন থেকে। অর্থাৎ গাঁয়ের জন। শৈবপন্থীরা শিবকে বলেন সূর্যের প্রতীক। পৃথিবী পার্বতীর প্রতীক। গাজন বাংলার ভূমিপুত্রদের ব্রত। তাই প্রচলন গ্রাম বাংলাতেই। বেশি প্রচলন মেদিনীপুরের দুই জেলায়। কোথাও আবার বৈশাখেও পালিত হয়। পুরুলিয়ায় গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লেই নাকি সজনে ডাঁটা ফাটতে শুরু করে। এই জেলায় রোদ যত চড়ে, গাজনের মেলা তত জমে। চড়কের আগের দিন নীল ষষ্ঠী। শিবের মাথায় ১০৮ ঘড়া জল ঢালা হয়। বিয়ে হয় নীলাবতীর সঙ্গে। পার্বতীর দেহত্যাগের পর পরজন্মে তিনি নীলাবতী হয়ে জন্মান। এমনটাই পুরাণের গল্প।
বিজ্ঞাপন
এই পূজোয় নেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত। সারাদিন ভিক্ষা করে চাল ডাল সংগ্রহ করে রাতে মাতির মালসায় রান্না করে হবিষ্যান্ন গ্রহণ। মাটিতে শয়ন। কৃচ্ছসাধন পর্ব। সংক্রান্তির সকালে কিম্বা সন্ধায় বাণফোঁড়া। সে এক নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর প্রথা। সংক্রান্তির মন্ত্র শিব বেটা বোয়ো , বউয়ের পাতে ভাত খেয়েছে পেট করেছে লেও। অর্থাৎ ভুঁড়ি বাগিয়েছে। চড়ক সংক্রান্তির সন্ধ্যায় পিঠে বড়শি গেঁথে চরকি দেওয়া। গাজনের উৎস সন্ধানে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস আদি পর্বে লিখেছেন, ধর্মপুজা সম্বন্ধে যাহা সত্য নীল বা চড়ক পূজা সম্বন্ধেও তাই। এই চড়ক পূজা এখন শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িত। ঐতিহাসিক বারীদ বরণ ঘোষ সংকলিত বুদ্ধ ও বৌদ্ধ গ্রন্থে বলেছেন , সামাজিক জনতত্ত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক পূজা দুইই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ব্রত দুধরণের। শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় লৌকিক। শাস্ত্রীয় বিধান উচ্চবর্ণের। লৌকিক বিধান নিম্নবর্ণের । তাই বাঙালি উচ্চবর্ণের মানুষ শিবের আরাধনা করলেও গাজনের ব্রতে থাকেন না। মানব জীবনে সন্তান বাকি জীবের মতোই কাম্য। তাই সন্তানের দেবী হিসেবে ষষ্ঠীর সৃষ্টি বৈদিকদেবতা নন। বুদ্ধের মৃত্যুর পর একদল মহাযান হয়ে হিন্দুদের ছাতার নিচে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। সৃষ্টি করে নানা দেবতা। এমনই এক দেবী হারিতী। পুরাণে আবার তিনি স্বীকৃত যক্ষিনী হিসেবে। অবনিন্দ্র নাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল অনেকেই পড়েছেন। দেবীর বাহন বেড়াল। বেড়াল বহু শাবকের জন্ম দেয়। মানুষ যেহেতু বছর ভর সন্তান প্রসব করে তাই ষষ্ঠীও বারোটি। জৈষ্ঠ্য মাসে জামাইষষ্ঠী। অর্থাৎ জামাইকে খাইয়ে বীর্যশালী করে মেয়ের মা মেয়েকে সন্তানবতী দেখতে চান। ভীতি মেয়ে যে বাঁজা নয় তার প্রমাণ জামাইকে দেওয়া। চৈত্র মাসে নীলষষ্ঠী। এদিন সন্তানের মাথায় ধান দুব্বা , আর করমচা দিয়ে তাল পাখার বাতাস করেন মায়েরা। কিন্তু চড়ক বিষয়টি কি? চড়ক আসলে খাজনা না দিতে পারলে রাজা জমিদারেরা মধ্য যুগে বাঁশের মাথায় বেঁধে চরকি দিয়ে শাস্তি দেওয়া হত। সেকথাই বলব রবিবার শিব এল কোথা থেকে প্রতিবেদনের, ১০ ও শেষ পর্বে।
বিজ্ঞাপন