বেশ্যার বারোমাস্যা

পর্ব: ১০

সমুদ্রমন্থনে প্রাপ্ত অপ্সরা

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বৈদিক যুগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গণিকা কন্যার গণিকা হওয়া ছাড়া পথ ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা স্বয়ংবরা অর্থাৎ পিতা বা মাতার ঘর ছেড়ে স্বাধীনভাবে নিজের ঘর বানিয়ে গণিকাবৃত্তি করত। হেমচন্দ্রের অভিধান চিন্তমণিতে আর একটি শব্দ পাওয়া গেছে। পণপণ্যাঙ্গনা। অর্থাৎ যাকে পণের জন্য বা বাজি রেখে সম্ভোগ করা হয়। ভূজিয্যা শব্দে বোঝায় পরিচালিকা, ক্রীতদাসী, বেশ্যা। এখানে হয়ত রক্ষিতা ক্রীতদাসীকে বোঝানো হয়েছে। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত ও দাসীর গর্ভজাত সন্তান ছিল যুযুৎসু । যিনি পরে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন অবহেলা আর অপমানের বদলা নিতে। চতুর্থ শতকে অমরকোষ এ বারস্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে নারী রাজা বা দেবতার সেবায় পালাক্রমে কাজ করে। গণিকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, গণঃ পেটাকো হস্তি অস্যাঃগণয়তীশ্বরাণীশ্বরেই বা পেটক শব্দের অর্থ বাক্স বা থলি। বার নারীরা গয়নার বাক্স নিয়ে চলাফেরা করতেন বলেই গণিকা বলা হত।

অনেকে বলেন , গণ অর্থে বহুভোগ্য, তাই গণিকা। বেশ্যাদের কুট্টনীত্ত বলা হয়েছে। কুট্টয়তি কুট্টনী। কুট্ট ধাতুর অর্থ হল পিষে ফেলা। এর থেকে বাংলা শব্দ কোটা। মাছ কোটা, কুটনো কোটা। এখানে যে অর্থ করা হয়েছে, এই মেয়েরা যার ঘাড়ে চাপে তাকে কুটনো কোটা করে দেয়। অর্থাৎ তিলে তিলে শেষ করা। সম্ভলী শব্দের অর্থ বলা হয়েছে, শংশ্রেয়ো ভালয়ত শং ভং শ্রেয়ো যুক্তংলেতি ‘বা। যে নারী মঙ্গল বা শুভঙ্কর সব কিছু নষ্ট করে। অর্থাৎ দেহদানের মধ্য দিয়ে পুরুষের কৌমার্য হরণ করে। বীর্যশক্তিকে শোষণ করে। কামপ্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এই কাম প্রবৃত্তি যখন সংযম চুর্ণ করে তখন হয় ব্যভিচার। আর এই ব্যভিচার মানুষ শুধু নয়, দেবতারাও করেছেন। প্রজাপতি কন্যা সরস্বতীর প্রতি, আত্মজা ইলার প্রতি মনু, দুহিতা জাহ্নবীর প্রতি পিতা জুহুর কামাবেগের কথা পুরাণে আছে। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবেরও ধ্যানভঙ্গ হয়েছিল পঞ্চশ্বরে বিদ্ধ হয়ে।
ঋকবেদে দেবতার কাম প্রবৃত্তির কথা আছে। ঋকবেদে (১০/১০) যমুনা তার নিজের সহোদর ভাই যমের কাছে রতি প্রার্থনা করেন। সূর্যের সঙ্গে উষার সম্পর্ক উল্লেখ আছে। সে যুগের স্বর্গের অপ্সরারা মূলত দেনভোগ্যাই ছিলেন। অপ্সরা মেনকার গর্ভে জন্ম শকুন্তলার। শকুন্তলা পুত্র ভরত। অন্যদিকে বাল্মীকি রামায়ণ বলছে, রাজা দশরথের পিতা অজ। অজের স্ত্রী অর্থাৎ রাম চন্দ্রের ঠাকুমা ইন্দুমতি ছিলেন অপ্সরা। অপ্সরার পরিচয় দেখা যাক। সংস্কৃত শব্দ অপ্। অর্থাৎ জল। জল থেকে উৎপত্তি। লৌকিক গল্পে জলপরী শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এঁরা নাচে গানে পারদর্শী। এঁদের অধিপতি যৌনতার দেবতা কামদেব। অপ্সরার সংখ্যা বলা হয়েছিল ৬০ কোটি। অর্থাৎ যে সময়ের রচনা বলা হচ্ছে তখন ভারতে ৬ কোটি মানুষ ছিল কিনা সন্দেহ। দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনে এঁরা সমুদ্র থেকে উঠে আসেন। কিন্তু কোনো দানব তাঁদের গ্রহণ করেনি। তাঁরা অরক্ষনীয়া হয়ে থাকেন। দেবতারাও অপ্সরাদের পানি গ্রহণে রাজি হয় না। মনু সংহিতায় বলা হয়েছে সাতজন মনুর ঔরসে অপ্সরার জন্ম। পুরাণে অপ্সরাদের দু শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। লৌকিক ও দৈবিক। অপ্সরারা মায়াবিনী।ইচ্ছে মত রূপ ধারণ করতে পারতেন। অথর্ব বেদ বলছে অপ্সরারা পাশা খেলায় দক্ষ ছিলেন।

চিনের পাহাড়ের গুহায় অপ্সরাদের গুহাচিত্র মিলেছে

কম্বোডিয়ায় একটি বিখ্যাত নৃত্যকলা আছে। যা অপ্সরা ড্যান্স নামে বিশ্বে পরিচিত। চিনের বিখ্যাত বৌদ্ধ গুহাগুলি যেমন মোগাও, কেভ, ইউলিন কেভ ইত্যাদি বহু গুহায় দেয়ালে অপ্সরাদের চিত্র অঙ্কিত আছে। পুরাণে বেশ কিছু অপ্সরাদের নাম আমরা জানি। যেমন উর্বশী, মেনকা রম্ভা। এছাড়াও উল্লেখ আছে ঘৃতাচি, অলম্বুশা, মিশ্রকেষী, জানপদী ও বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা , পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী , পূর্বাচিত্তি , প্রম্নচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতি, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্ধুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমিচী, চারুনেত্রা , পুঞ্জিকস্থলা , শুচিস্মিতা, বিশালনয়না প্রমুখ। দেবরাজ ইন্দ্র নিজের আসন নিরাপদ রাখতে বহু ঋষি, দেবতা, অসুরের ধ্যান ভঙ্গ করতে অপ্সরাদের ব্যবহার করতেন।( চলবে)

পরবর্তী পর্ব : ১১ , আগামী সোমবার ১৩ মে,২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *