পর্ব :৪
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: এবারের পর্ব শুরু করছি , রাজেশ দত্ত সম্পাদিত রামকৃষ্ণ -বিবেকানন্দ : মুক্ত মনের আলোয় বইতে ভারতের মানবতাবাদী সমিতির একটি চিঠি স্থান পেয়েছে। চিঠিটি সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় আজকাল দৈনিক পত্রিকায় দিয়েছিলেন ১৯ মে ১৯৯৪ সালে। সেই চিঠি অবশ্য প্রকাশিত হয়নি। সুতপা বন্দোপাধ্যায় লেখেনগত ১২ মে,১৯৯৪ প্রকাশিত আজকাল পত্রিকায় পত্রলেখক শিবশঙ্কর বিশ্বাস জানিয়েছেন যে, তাঁর মতে, স্মরণাতীতকাল থেকে একজনই জন্মেছিলেন যিনি মনেপ্রাণে শতকরা একশভাগই ভারতীয়, তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। একথা সর্বৈব সত্য – তবে কিনা তিনি ছিলেন এমন একজন ভারতীয় , যিনি হিন্দুত্ব ও ভারতীযত্বকে সমার্থক বলে মনে করতেন এবং সর্বান্তকরণে একথা বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুজাতি সমগ্র জগৎ জয় করিবে ( বাণী ও রচনা,৫/১৩১)। মহাসভার মঞ্চে স্বামী বিবেকানন্দ একমাত্র ভারতবাসী এমনকি একমাত্র বাঙালি ছিলেন না বটে , তথাপি সমগ্র হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন একমাত্র তিনিই। হিন্দুধর্মকে বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে উন্নীত করার বাসনাতেই তিনি সন্ন্যাসীর টাকার কথা ভাবা ও টাকা পাওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার সামিল।( ১০/২২৮), একথা মেনেও খেতরির মহারাজের কাছ থেকে প্রভূত অর্থ সংগ্রহ করে শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দেন এবং সারা জীবন তিনি অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন হিন্দু ধর্মের প্রচারের স্বার্থে। শিকাগো থেকে প্রত্যাবর্তনের পর দূর্ভিক্ষপীড়িত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিপুল অর্থব্যয়ে তিনি যে সংবর্ধনা পেয়েছিলেন এবং পেতে চেয়েছিলেন তাও বিদেশের মাটিতে হিন্দুধর্মের প্রচারকার্যের সাফল্যের জন্যই। প্রসঙ্গত ১৮৯৭/৯৭ সালে রাজস্থানে, বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল , বোম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ, বিশেষত মধ্যপ্রদেশে দূর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৬.৯ লক্ষ এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫১.৫ লক্ষ।
লেখিকা লিখেছেন আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে স্বামীজী সব ধর্মের প্রতি সহনাভূতির কথা বললেও তাঁর , মনে ছিল ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির বীজ। তিনি বলেছিলেন কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হইতে পারে আর কোনো ধর্মই নয়। সুতপা লিখেছেন, স্বামীজী কোনোদিনই ইংরেজ শাসনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যেতে চাননি। ব্রিটিশ শাসককে তোষামোদ করতে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি _ সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে – ইংরেজ আমদের দাও। বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়েছে , তারের খবর দিয়েছে , রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়েছে, ডাকাতের দল তাড়িয়েছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে। আবার কদেবে? নি:স্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি বাপু, ওরা তো এত দিয়েছে তোরা কি দিয়েছিস? ( ৯/২৫৩) খেতরির মহারাজাসহ যে সব দেশীয় রাজাদের পৃষ্টপোষকতায় ও অর্থ সাহায্যে স্বামীজী দেশ- বিদেশে হিন্দুধর্ম প্রচার করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন ব্রিটিশ- অনুগত । তাই হিন্দুধর্ম প্রচারে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্খাতেই ইংরেজ শাসকের প্রতি এই বদান্যতা। হিন্দুরাজের ছত্রছায়ায় থেকে তিনি সদর্পে ঘোষণা করেছেন _ সমগ্র ভারত আর্যময়, এখানে অপর কোন জাতি নাই ( ৫/১৪৫),।
লেখিকা স্বামীজীর আমেরিকা ভ্রমণের সময় গৈরিক পোশাক সম্পর্কে লেখেন , শিকাগো ধ র্মসভায় হিন্দু ধর্মের প্রচারকালে তাঁর সঙ্গে ছিল হিন্দসন্ন্যাসীর গৈরিকবসন। জনৈক ভক্তকে আশা প্রকাশ করে তিনি লিখেছিলেন , প্রভুর ইচ্ছা হলে এখানে ( আমেরিকা ) ও ইংল্যান্ডে গৈরিক পরিহিত সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যাবে।( পত্রাবলী, পত্র নং ২৭২,০ পৃষ্ঠা ৪৪৪)। উপনিষদের ধর্মেই ইউরোপকে রক্ষা করবে , এই ছিল তাঁর মত। বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেএমনই মোহ ছিল ,যে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মকেও হিন্দু ধর্ম থেকে উৎপত্তি মনে করতেন। আবার তিনিই ডেটট্রয়ের ভাষণে বলেছিলেন, শুনতে হয়ত ভাল লাগবে না কিন্তু জেনে রেখ, এই যে খৃষ্টনীতি , ক্যাথলিক চার্চ সবই বৌদ্ধ ধর্ম থেকে নেওয়া। ( ২১ ফেব্রুয়ারি,১৮৯৪) । হিন্দুত্ববাদীদের যে গৈরিক পোশাক বা পতাকার কথা বলা হয় , এমনকি বিবেকানন্দ যে গৈরিক বস্ত্র পরে আমেরিকা যান সেই গৈরিক রং অবশ্যই ত্যাগের প্রতীক। সেই ত্যাগ তো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। বলতে গেলে গৈরিক বৌদ্ধ ধর্মীয় রং।( চলবে)
পরবর্তী পর্ব চোখ রাখুন দিগদর্শন পোর্টালে।