পর্ব:২
গণেশের মন্দির নেই। তাই পুজো কালী মন্দিরে।
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : পয়লা বৈশাখ হিন্দু ব্যবসায়ীদের হালখাতায় পুজো হয় গণেশ লক্ষ্মীর পুজো করে। ঝুড়িতে বসিয়ে এই দুই দেবতাদের নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা কালী মন্দিরে।সেখানে পুরোহিতেরা মন্ত্র পড়ে সেই ঝুড়ি ফিরিয়ে দেন ভক্তের হাতে।পুজো লক্ষ্মী গণেশের হলেও কলকাতায় কোনো বঙ্গ হিন্দু মন্দির নেই লক্ষ্মী গণেশের। না ভুল বললাম। লক্ষ্মীর একটা মন্দির আছে বটে ভবানীপুরে। অবশ্য ক’জন তার খোঁজ রাখেন? অন্তত জেলাতেও গণেশের মন্দির আছে কিনা সন্দেহ। সে যাই হোক, প্রশ্নটা অন্য। ব্যবসায়ীরা নববর্ষের গণেশের পুজো সেরে ব্যবসা স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন লক্ষ্মী গণেশ জুটিকে, দেয়ালে লেখেন সিঁদুর দিয়ে শুভ লাভ। কিন্তু শাস্ত্র পুরাণে কি গণেশ শুভ দেবতা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন?
মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে গণেশ শূদ্র। অশুভ দেবতা।
কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা যে মনুস্মৃতিতে বিশ্বাস রাখেন সেই মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, গণেশ শূদ্রদের দেবতা। যেসব পুরোহিত গণেশ পুজো করেন তাঁরা উচ্চবর্ণের শ্রাদ্ধের পৌরহিত্য তো দূরের কথা, বাড়িতে প্রবেশাধিকারের যোগ্য নন। খ্রিস্ট জন্মের ৪০০ বছরআগের শাস্ত্র হিসেবে দাবি করা হয় মানবগুহ্যসূত্র। সেখানেই নাকি প্রথম গণেশকে বিঘ্নকারক দেবতা বলা হয়েছে। গণেশের দৃষ্টিতে লোকের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। গণেশের দৃষ্টি পড়লে কুমারীর বিয়ে হয় না। বিবাহিতার সন্তান হয় না। সন্তানবতীর সন্তানের অকাল মৃত্যুর হয়। রাজা রাজ্য হারায়। ব্যবসা লাটে ওঠে। গোদা বাংলায় যাকে গণেশ ওল্টানো বলে।
মহামারী প্লেগের বাহক ইঁদুর। ভীতি থেকেই গণেশের বাহন।
গণেশের বাহন ইঁদুর। ইঁদুর মানেই চুরি। গোলার ধান নষ্ট করে। গৃহস্থের ঘরে উপদ্রবে নাজেহাল গৃহস্থ ইঁদুরের বিষ দিয়ে ইঁদুর হত্যা করে। আবার গণেশের পুজোয় ইঁদুরের পুজোও করে। ইঁদুর প্লেগ মহামারীর বাহক। গণেশের পুজোর ফল বা ভোগ প্রসাদ হিসেবে ভক্ত মাথায় ঠেকিয়ে গ্রহণ করে। কিন্তু জেনে বুঝে ইঁদুরের মুখ দেওয়া কোনো খাদ্যে গ্রহণ করে কি না জানা নেই। বাস্তবিক যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে যদি ব্যাখ্যা খুঁজি তবে দেখতে পাবো, পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির পর মানবগোষ্ঠী আগুন, জল আর বাতাসের তীব্রতায় ভীত হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। ভীত মানব প্রকৃতিকে অমঙ্গলসূচক কোনো অদৃশ্য শক্তি ভেবে বশ্যতা স্বীকার করে মাথা নত করে। শুরু হয় উপাসনা ধর্ম।
তামিলনাড়ুতে হাতি ভক্তি প্রধানমন্ত্রীর।
মনস্তাত্বিকরা বলেন, সহজাত প্রবৃত্তি যেমন হিংসা, খাদ্যের সন্ধানে শিকার বা আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ, তেমন আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ। মানুষ নিজেদের চেয়ে বড় আয়তনের প্রাণী হিসেবে ডায়নোসর পায়নি। কেননা তখন মানুষের সৃষ্টিই হয়নি। ফলে কোন ধর্মগ্রন্থেই ডায়নোসর জায়গা পায়নি। কিন্তু মানুষ দেখেছে হাতি। ফলে উপাসনায় স্থান পেল হাতি।
হাতির হানায় ফসল নষ্ট।
এরপর যখন মানুষ ফসল ফলানো শিখল , হাতি এসে ফসল খেত যতটা, তার চেয়ে নষ্ট করত বেশি। আজও করে। অরণ্য যত ধ্বংস হচ্ছে, হাতি হানা তত বাড়ছে। ফলে হাতিকে দেবতা হিসেবে পুজো শুরু। অর্থাৎ অশুভ দেবতাকে খুশি করতে জঙ্গলের গভীরে ফসলের একভাগ রেখে আসা শুরু করে। মানুষ যেহেতু নিজের আকারের দেবতা সৃষ্টি করেছে তেমনই মানুষের মত চেহারায় জুড়ে দিয়েছে হাতির মুখ। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে কিছু গপ্পো। কোথাও বলা হয়েছে, শনির দৃষ্টিতে গণেশের মুখ ছাই। কোথাও শিবের রোষানলে মস্তক ছেদন ত্রিশূলে।
আমরা ছেলেবেলায় যে ভুল করেছি, আজকের ছোটরাও সেই ভুল করে দুর্গাপুজোয় গণেশ মূর্তির পাশে রহস্যময়ী ঘোমটা দেওয়া কলাগাছকে গণেশের বউ বলে ভেবে। কিন্তু ধর্মীয় বিধান বলছে ,এই কলাগাছ নব পত্রিকার অন্যতম। স্বয়ং দুর্গা। আসলে আদিবাসী সংস্কৃতিতে গাছের পুজো হিন্দু সংস্কৃতিতে স্থান পেয়েছে। এই কথায় একচক্ষু হরিণের মোট কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা গোসেবকরা তেড়ে আসবেন। তাঁদের বলি এই মন্তব্যে আমার নয়। বলেছেন নবহিন্দুবাদের জনক বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর রচনাবলীর দেবতত্ত্ব ও হিন্দু ধর্ম প্রবন্ধে ৭১৩-৭১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন। বঙ্কিম লিখেছেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, দুর্গা, কালী, কার্তিক, গণেশ ইহারা কেহই বেদের দেবতা নন। বেদের দেবতা অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, মিত্র, বরুণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ,বৃহস্পতি, পূষাভগ, আদিত্য ও মরুদগণ। এঁরা হচ্ছেন বেদের দেবতা।
( চলবে)
শেষাংশ আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪