পর্ব : ১
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কালী পুজো অমাবস্যায়। পরের দিন পঞ্জিকা মতে প্রতিপদ। এদিন পূর্ব বঙ্গীয় হিন্দু বাঙালিরা ভাইফোঁটা পালন করেন । এদেশীয় হিন্দু বাঙালিরা ভাইফোঁটার উৎসব পালন করেন পরেরদিন ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায়। দিদি , বোন ভাই বা দাদার শতবর্ষের আয়ু কামনা করে উপোষ করে ফোঁটা দেন। পরিবর্তে ভাই বা দাদা দিদির আশীর্বাদ নেন, বোনদের আশীর্বাদ করেন। উপহার দেওয়া নেওয়া করেন। ভাইবোনের সম্পর্কের এক মধুর বন্ধনের ছবি ফুটে ওঠে । আবার এটাও ঠিক, বিয়ের পর পিতার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে বিবাদের ফলে ভাই ফোঁটা দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে, এমন ঘটনাও বিরল নয়। স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে গেছে শৈশবের স্মৃতি। যে কোনো সামাজিক উৎসব বা অনুষ্ঠানের পেছনে কার্যকারণ থাকে। সেটাই স্বাভাবিক।
প্রায়শই শোনা যায় , রাখী বন্ধন ও ভাইফোঁটা সংসারের পুরুষ সদস্যের মঙ্গল কামনায়। পরিবারের পুরুষরা কি কোনো মহিলা সদস্যদের মঙ্গল কামনায় উৎসব করেন? কেন নেই বোনফোঁটা? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। আসলে প্রাচীন সমাজে পুরুষরা বেশি বয়সেও অনেক বিয়ে করতেন। সন্তান ছোট থাকতেই অনেক পিতা মারা যেতেন । ছোট বোন বা দিদির দায়িত্ব বর্তাতো ভাই বা দাদার ওপর। সুতরাং সেযুগের নারীর অভিভাবকত্ব পিতার অবর্তমানে ভাই বা দাদার হওয়ায় মেয়েরা দাদা বা ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করতো নিজেদেরই নিরাপত্তার খাতিরে। বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয় যাঁরা এখনও শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া উপন্যাসটি পড়ে দেখেন।
নারীর অভিভাবকত্ব যেহেতু পুরুষের হাতে ন্যস্ত, সেহেতু নারীর অস্তিত্ব ক্রমশ পুরুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তার প্রভাবেই সামাজিক বা ধর্মীয়অনুষ্ঠানগুলি পুরুষকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।বিদেশের কথা বা অন্য ধর্মে পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব সরিয়ে আমাদের দেশেই তাকানো যাক। মনু তো স্পষ্ট বলেছেন, নারী সন্তান উৎপাদনের হাতিয়ার মাত্র। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন,,,,,, বেদেই আমরা দেখি নারী পণ্যবস্তু। বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, যজ্ঞে, এমনকি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও নারীকে দান করা হচ্ছে বহুমূল্য অন্য সব বস্তুর সঙ্গে।,,,,
শরশয্যায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন,পূর্বজন্মের পাপে মানুষ নারী হয়ে জন্মায়।
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তাঁরা তখন নারীর সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করার জন্য।( পৃষ্ঠা:১১৮) মহাভারতের ভীষ্মপর্বে ৬/৩৩/৩২ ভীষ্ম বলেছেন, পূর্বজন্মের পাপের ফলে নারী হয়ে জন্মাতে হয়।
আজকের মেয়েরা কি অস্বীকার করতে পারেন, সেযুগের কোনো প্রথা আজও কেন মেনে চলবেন, এমন প্রশ্ন তুলেছেন? হ্যাঁ। কয়েকজন নারী প্রশ্ন তুলেছেন বটে কেন বিবাহে বা পুজোয় নারী পুরোহিত হবে না? কেন জামাইষষ্ঠীর মত বৌমা ষষ্ঠী হবে না? কিন্তু ভাইফোঁটার পাশাপাশি কেন বোন ফোঁটা হবে না এই প্রশ্ন তোলেননি। ভাইয়ের আয়ু কামনা যদি বোন করে থাকেন, ভাইয়েরা কেন বোনের আয়ু কামনা করে বোন বা দিদিকে ফোঁটা দেবেন না? সে প্রশ্ন আজকের শিক্ষিত মহিলা সমাজ তোলেন না। তাঁদের সান্ত্বনা দেবী পুজোর মধ্যেই। অথচ সে দেবীর পুজোর অধিকার নেই। পুরোহিতের আসনে পুরুষ। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে দেশের উত্তরাঞ্চলে,পশ্চিমাঞ্চলে পালিত হয় করওয়া চৌথ। এই বছর ২০ অক্টোবর পালিত হয়েছে। ভোররাতে সারগি খাবার খেয়ে সারাদিন উপোষ থেকে রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে চন্দ্রদেবকে পুজো দিয়ে ছাঁকনিতে স্বামীর মুখ দেখে তাঁকে কপালে টিকা পড়িয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ব্রত সম্পন্ন করতে হয়। এখানেও স্বামীর মঙ্গল কামনা ও দীর্ঘায়ূ কামনা করেন স্ত্রীরা। এই ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে গর্ব অনুভব করেন মেয়েরা। বাংলায় এই ব্রত পালনের চল ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরুও করে দিয়েছে।
উত্তর -পশ্চিম ভারতে বিবাহিতা মেয়েরা স্বামীর মঙ্গলকামনা করেন করোয়া চৌথ ব্রত পালন করে।
পরিবারে সাধারণ পিতার মৃত্যুর হলে কিংবা পিতা অসুস্থ থাকলে , উপার্জনহীন কিংবা নিখোঁজ হলে ভাইদের দায়িত্ব পড়ে অসহায় বোন বা দিদির। হবে নাই বা কেন? মৈত্রায়ণী সংহিতায় বহুবার বলা হয়েছে নারী শরীর নিজের নয় , তাই যৌন নিপীড়ন থেকে তাঁর নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ নেই।৩/৬/৩;/৪/৬/৭;৪/৭/৪;১০/১০ ১১ নারী সমাজে সেযুগে যে নিরাপদহীনতা এমন অবস্থায় ছিল যে পরিবারে পিতা বা ভাইয়ের আশ্রয় না মিললে তাঁকে তো অরক্ষণীয়া বলা হয়ে থাকে। আজও ছবিটা বিশেষ পাল্টায়নি।
পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবে রবীন্দ্রনাথের নারী মূল্যায়ন
ফিরে যাই ভাইফোঁটা প্রসঙ্গে। অনেকে ভাইফোঁটা নাম হলেও বিষয়টিকে লঘু করতে বলেন, এই সামাজিক উৎসব আসলে ভাইবোনের দুজনেরই মঙ্গল কামনায় উৎসব। মেয়েরা যেমন ফোঁটা দেন, বড় ভাইয়েরা তেমন আশীর্বাদ করেন। ছোট ভাইরা কি করেন? দিদিকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেন। এই আবেগীয় কথায় আসলে পুরুষতান্ত্রিক ধারা তাঁরা নিরাপদ করেন। বিবাহ প্রসঙ্গে গ্রন্থে সুকুমারী ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, আমরা শাস্ত্রের দোহাই পাড়ি তখনই, যখন সে শাস্ত্র আমাদের অভীষ্টের অনুকূল। প্রতিকূল হলে বেমালুম চেপে যাই সে শাস্ত্র।,,,,,,রবীন্দ্রনাথ নারীর মূল্যায়ন সম্পর্কে লিখেছেন, ,,,,,,,, তার ( নারীর) বুদ্ধি, তার সংস্কার, তার আচরণ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার দ্বারা বহু যুগ থেকে প্রভাবান্বিত। তার শিক্ষা, তার বিশ্বাস বাহিরের বৃহৎ অভিজ্ঞতার মধ্যে সত্যতা লাভ করবার সুযোগ পায়নি। এইজন্য নির্বিচারে সকল অপদেবতাকেই সে অমূলক ভয় ও অযোগ্য অর্থ দিয়ে আসছে। সমগ্র দেশ জুড়ে যদি দেখতে পাই তবে দেখা যাবে এই মোহমুগ্ধতার ক্ষতি কত সর্বনেশে, এর বিপুল ভার বহন করে উন্নতির দুর্গম পথে এগিয়ে চলা কত দুঃসাধ্য।,,,,,,চিত্তের বন্দিদশা এমনি করে দেশে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে এবং প্রতিদিন তার ভিত্তি হয়ে উঠেছে।( প্রবন্ধ নারী, রবীন্দ্র রচনাবলী,১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬২১
( আগামীকাল শনিবার ২ নভেম্বর ২০২৪ শেষাংশ)