ব্রাত্য রয়ে গেলেন ফাঁসি হওয়া প্রথম বাঙ্গলি মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামী আসফাকুল্লা খান

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ১২৫ বছর অতিক্রান্ত হল ২০২৪ সালে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন বিপ্লবী আসফাকুল্লা খান। কে এই বিপ্লবী? কি তাঁর পরিচয়? আলেকজান্ডার নাকি বলেছিলেন, সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! সত্যিই বিচিত্র। অখন্ড বাংলায় সবচেয়ে বেশি যে মুসলিম ধর্মাবলম্বী নাগরিক , তাঁদেরই একজন শহীদ আসফাকুল্লা খান ব্রিটিশের ফাঁসির দড়িতে জীবন দিলেন তিনি ইতিহাসে ব্রাত্য। শুধু হিন্দু উচ্চবর্ণের ঐতিহাসিকেরাই নন, বাঙালি মুসলিম সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায় পর্যন্ত উদাসীন। কেবল আসফাকুল্লা নন, বলতে গেলে তেমনভাবে কোনো মুসলিম স্বাধীনতা স্বাধীনতা সংগ্রামী ইতিহাসে স্থান পাননি। বর্ধমানের ভূমিপুত্র গবেষক গোলাম আহমাদ মোর্তজা বেশ কয়েকটি গ্রন্থে এইসব তথ্য লিখে গেছেন। মুসলিম বিপ্লবীদের সংখ্যা হিন্দু বিপ্লবীদের সংখ্যার চেয়ে কম নয়।

মুসলিম বিপ্লবীদের লড়াইয়ের বিবরণ মেলে উইলিয়াম হান্টারের লেখা ইন্ডিয়ান মুসলিমস্, অধ্যাপক এস রায়ের লেখা হিস্ট্রি অফ প্রেজেন্ট রিভোল্ট ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে। গবেষক গোলাম আহমাদ মোর্তজা তাঁর এ সত্য গোপন কেন ? বইয়ে লিখেছেন ,,,,,, মুসলিম পরিচালিত বিপ্লবগুলোকে দালাল ঐতিহাসিকেরা ইংরেজের ইঙ্গিতে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা বলে চালাতে চেয়েছেন। কারণ ইংরেজের পদলেহী জমিদার, তাদের সমর্থক ও সংরক্ষকদের ঐ বিপ্লবীরা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় বেশির ভাগ জমিদারই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতরাং জমিদার, রাজা, মহারাজা ও বাবু সমাজ এটাকে হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই বলে চালাতে চেয়েছিলেন। তথ্য: বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ: অমলেন্দু দে ।
( পৃষ্ঠা ১০/১১, প্রকাশক, বিশ্ববঙ্গীয়)

গবেষক গোলাম আহমাদ মোর্তজা।

একদিকে সিপাহী বিদ্রোহ ও সিধু কানুদের বিদ্রোহ যতটা প্রচার পেয়েছে, ততটাই চেপে রাখা হয়েছে , জনাব মুশা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, মহম্মদ শাহ, পেরাগুল শাহ, রমজানী শাহ, জহুর শাহ, সোবহান আলী শাহ, আহম্মদী শাহ, মতিউল্লাহ শাহ, নিগাহ শাহ, বুদুশাহ ইমাম শাহ প্রমুখ। এঁরা মিস্টার ম্যাকেনজির আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে সাময়িক পরাজিত করেছিলেন ১৭৬৯ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন মজনু শাহ। মুসলিম বিপ্লবীদের নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোনো এক পর্বে জানাবো।আপাতত ফিরে যাই আসফাকুল্লা খান সম্পর্কে।

২২ শে অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। সময়টা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ ২০২৪ সালে তাঁর জন্মের ১২৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কে এই আসফাকুল্লা? আসুন একটু প্রায়শ্চিত্ত করি তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান । পরিবারের অনেকেই ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে হিন্দু বন্ধুদের সান্নিধ্যে। শিশু থেকেই তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে।১৯২৯। আসফাকুল্লা যোগ দেন গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। কিন্তু মন সায় দেয় না।তিনি বুঝেছিলেন অহিংসার পথে স্বাধীনতা আসবে না। যোগ দিলেন সশস্ত্র সংগ্রামে। অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয় শাহাজানপুরের বিপ্লবী নেতা রামপ্রসাদ বিসমিলের সঙ্গে। তাঁর ওপর অর্পিত হল হাতিয়ার ও গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজ।

কিন্তু দরকার প্রচুর টাকা তাই সরকারি কোষাগার লুঠের ভার পড়ল। কাকরি স্টেশনে একটি ট্রেন দাঁড় করিয়ে অর্থিত লুঠ করলেন আসফাকুল্লা খান। পুলিসের টনক নড়ল। কে এই দুঃসাহসী যুবক? শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। বাধ্য হয়ে আত্মগোপন করেন আসফাকুল্লা। ইচ্ছে কাবুল হয়ে রাশিয়া যাওয়া। রাশিয়ার সাহায্য প্রার্থনা উদ্দেশ্য।পরিকল্পনার মত প্রথমে দিল্লি এলেন তিনি। সেখানে পরিচয় এক মুসলিম ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। কিন্তু বেইমানি সেযুগে যেমন অনেক বিপ্লবীকে পথভ্রষ্ট করেছিল , তেমনই ঘটল।ইঞ্জিনিয়র ব্রিটিশ পুলিশের জানিয়ে দিল আসফাকুল্লার গতিবিধি। গ্রেপ্তার হলেন আসফাকুল্লা খান।

ফাঁসিতে গিয়েও তিনি তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক রামপ্রসাদ বিসমিলের কোনো তথ্য ব্রিটিশ পুলিশকে দেননি।

বন্দী করে তাঁকে নিয়ে আসা হল দিল্লি থেকে লখনউ। ট্রেনে প্রহরায় ছিলেন এক মুসলিম ম্যাজিস্ট্রেট ও কয়েকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা। পথে বিনয়ের সঙ্গে সেই মুসলিম ম্যাজিস্ট্রেট আসফাকুল্লাকে বোঝালেন, আমরা মুসলমান। আপনি কেন হিন্দু বিপ্লবী রামপ্রসাদকে সাহায্যে করছেন? আসফাকুল্লা জবাব দেন আমার কাছে রামপ্রসাদের একটাই পরিচয় তি সাচ্চা বিপ্লবী। তিনি ফাঁসির শাস্তি ভয় পান না। উনি হিন্দু না মুসলিম সেটা পরিচয় নয়। পরিচয় আমরা দুজনেই বিপ্লবীর। লক্ষ্য স্বাধীনতা। বিচারে আসফাকুল্লার ফাঁসির হুকুম হয়।

উত্তরপ্রদেশের কাকরি ষড়যন্ত্রে দশির সাব্যস্ত হন আসফাকুল্লা। ফাঁসির অপেক্ষায় তিনি। জেলে বসে এক চিঠির লিখলেন বন্ধুকে। তিনি লেখেন, ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই এর উন্নতির জন্য দরকার কৃষকদের জীবনের মানোন্নয়ন।তাঁদের যেন হতাশ হতে না হয এলো সেই ট্র্যাজিক দিন।১৯ শে ডিসেম্বর। ফয়জাবাদ জেলের ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন আসফাকুল্লা খান। ফাঁসির দড়িতে একটা চুমু দিলেন। বললেন , ভারত স্বাধীন হোক, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে প্রথম মুসলমান হিসেবে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণে আমি অত্যন্ত গর্বিত।

*********

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *