সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ৪ জুলাই। ২০২৪। বিবেকানন্দের ১২২ তম মৃত্যুদিন। সেই প্রেক্ষিতে বিবেকানন্দের আন্তর্জাতিক খ্যাতি কিভাবে হল সেই নিয়ে প্রচলিত তথ্য, তিনি ধর্ম সন্মেলনে আমেরিকায় গিয়ে ব্রাদার অ্যান্ড সিস্টার্স বলে মার্কিন জনগণের মন জয় করেছিলেন। কিন্তু আসল ঘটনা কি ছিল? আমেরিকার ধর্ম সম্মেলনটি ছিল একটি বিশ্ব মেলার অংশ।কলম্বাস১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা আবিষ্কার করেন এমন বিতর্কিত বিষয়ের ৪০০ বছর উদযাপনের জন্য এই মেলা হয়। বিতর্কিত বলার কারণ কলম্বাসের আগেই আমেরিকা আবিষ্কার হয়ে যায়।যদিও আলোচনার বিষয় নয়, তাই সে প্রসঙ্গে অবতারণা এখানে প্রয়োজন নেই।১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে যখন এই অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা হয়, তখন মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মানুষের পার্থিব উন্নতি । অর্থাৎ শিল্প, কৃষি, কলা,সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে তোলা। ধর্ম তখনও এই অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেওয়ায় মানুষের দৃষ্টি ফেরাতেই ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মন্দার কারণে আমেরিকার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সংকট নেমে আসে। বেকারী যুবশক্তিকে হতাশাগ্রস্থ করে তোলে। স্বভাবতই জনগন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরূদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। কলকারখানায় ধর্মঘট শুরু হয়। রেল ও খনি শ্রমিকরা কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দেয়।শঙ্কিত আমেরিকার ধনীরা দেশবাসীর মনে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে উন্মাদনা সৃষ্টির উদ্যোগ নেন। রাস্তাঘাটে, বাজারে ধর্মীয় বক্তৃতার আয়োজন হয়। শিকাগোর ধর্ম মহাসভার সমিতি সভাপতি জন ব্যারজ স্বীকার করে বলেছিলেন,আমেরিকার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্মের পাঠ্যক্রম তৈরি করে নানা অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। বিশ্বমেলায় যুক্ত হয় ধর্ম সম্মেলন। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ৫০ টি জাতি যোগদান করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর এই ১৭দিন ধরে হল অফ কলম্বাস আর্ট প্যালেসে সম্মেলনটি চলে।
পুত্রসহ খেতরির মহারাজা অজিত সিং।
বিনা আমন্ত্রণে বিবিদিষানন্দ ওরফে সচ্চিদানন্দ ওরফে বিবেকানন্দ এই সম্মেলনে যোগ দেন। নরেন্দ্রনাথ যখন রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর পরিব্রাজক হয়ে ভারত ভ্রমণ করছিলেন,তখন যান গাজীপুরে।সেখানে দেখা পান পোহারিবাবার। যিনি নাকি বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকতেন। এই অলৌকিকতায় অভিভূত নরেন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নেন এঁর কাছেই দীক্ষা নেবেন।সেকথা জানিয়ে তিনি কলকাতায় চিঠি লেখেন প্রেমদাদাস মিত্রকে। এরপর নাকি স্বপ্নে পরপর ২১দিন প্রয়াত রামকৃষ্ণ তাঁকে দুঃখিত মনে দেখা দেন। মনোবিজ্ঞান বলে, নরেন্দ্রনাথের অবচেতন মনে দ্বিধা দেখা দিয়েছিল। রামকৃষ্ণের অনুগামী হয়ে অন্য কারো কাছে দীক্ষা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেই চিন্তায় স্বপ্নে রামকৃষ্ণ আসেন। এরপর নরেন্দ্রনাথ সিদ্বান্ত নেন তিনি দীক্ষা নেবেন না। নরেন্দ্রনাথ যে অস্থির চিত্তের মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে অনেক জায়গায়।
একসময় বাবা বিশ্বনাথ দত্তের মত উকিল হতে চেয়েছিলেন। আত্মীয়রা তো দেখতে সুন্দর নয়,এমন এক ধনী কন্যার সঙ্গে নরেনের বিয়েও ঠিক করেছিলেন মোটা পণের বিনিময়ে।আপত্তি জানান নরেন। তিনি কেমন মেয়ে পছন্দ মাকে জানিয়েছিলেন। বেশ কিছু মেয়ে দেখা হয়। কিন্তু পাকা কথা হয় না । এদিকে নরেনের বিয়ের কথা চলছে শুনে প্রমাদ গোনেন রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ চাননি নরেন বিয়ে করে সংসারী হোক। তাহলে তাঁর প্রচার করবে কে? সেই সময় নরেন পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে অশান্তির জন্য সিমলে পাড়ার পাশেই মামার বাড়ি রামতনু বোস লেনে মাকে নিয়ে দিদিমার কাছে থাকতেন। রামকৃষ্ণ বেশ কয়েকবার দক্ষিণেশ্বর থেকে ছুটে আসেন নরেনের মামার বাড়িতে। প্রলোভন দেখান ব্রহ্মচর্য পালন করলে মেধানাড়ি উন্মোচন হবে। ঈশ্বর দর্শন হবে।( স্বামী সারদানন্দ লীলা প্রসঙ্গ প্রসঙ্গ ৫ ম খন্ড পৃষ্ঠা ৬৫/১২৮)।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত( শ্রী ম)কে স্কুলের চাকরি থেকে বহিষ্কার করেন বিদ্যাসাগর।
কিছুদিন আগেই নরেনের পিতার মৃত্যু হয়েছে।আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। নরেন উদভ্রান্ত। চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। নরেনের ঠাকুরদাদা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত ২৫বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে নিরুদ্দেশ হন।তাই নরেনের মা ভবতারিণী দেবীর ভয় ছিল ছেলে যেন সেপথে না যায়। তাই ছেলেকে সংসারী করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ১৮৮৬। রামকৃষ্ণের মৃত্যু। নরেনের চাকরি জোটেনি।চাকরি পাওয়া ছিল মুস্কিল। এফ্ এ পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ৪৬%শতাংশ নম্বর। বি এ তে ইংরেজিতে ৫৬% নম্বর।অন্য বিষয়ে ৩০/৪০ শতাংশ। লজিকে ১৭%। রামকৃষ্ণ তাঁর ভক্ত শ্রী ম কে দিয়ে বিদ্যাসাগরের বউবাজার মেট্রোপলিটন স্কুলে একটা চাকরি করে দেন। বার্ষিক পরীক্ষায় ছাত্রদের ফল খারাপ হওয়ায় বিদ্যাসাগর খবর নিয়ে জানেন,নরেন পাঠ্যপুস্তক না পড়িয়ে রামকৃষ্ণের গল্প করতেন।বিদ্যাসাগর নরেনকে বহিষ্কার করেন। পরে একই কারণে চাকরি যায় শ্রী’মর। ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণেরও মৃত্যু হয়।
সন্ন্যাস গ্রহণের পর আঁটপুরের গুরুভাই বাবুরামের বাড়িতে।
১৮৮৬ তে আঁটপুরের গুরুভাই বাবুরামের মায়ের আমন্ত্রণে সেখানে নরেন্দ্রনাথ কয়েকজন রামকৃষ্ণদেবের ভক্তদের নিয়ে যান। ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নেন সন্ন্যাস নেবেন।কয়েকজন অনুগামীকে নিয়ে সেখানেই বিরজা যজ্ঞ করে সন্ন্যাস নেন নরেন্দ্রনাথ। মনে রাখা দরকার, বৈদিক ধর্মে সন্ন্যাস নিলে গৃহস্থ নাম ত্যাগ করতে হয়। সেখানেই নাম নেন সচ্চিদানন্দ।
এরপর বিবিদিষানন্দ। কিন্তু বিবেকানন্দ নাম পেলেন কি করে? নামটা দেন খেতরীর মহারাজা অজিত সিং। তিনি শুনেছিলেন কৈশোরে যাত্রায় নরেন বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তাই তিনি নাম রাখেন বিবেকানন্দ। কিন্তু প্রশ্ন, সন্ন্যাস গ্রহণের মন্ত্রপূত নাম ত্যাগ করে রাজার দেওয়ার নাম গ্রহণ করা যায় কি?
উপায়ই বা কি।পরিব্রাজক হয়ে নরেন্দ্রনাথ যখন ঘুরছেন,তখন পত্র পত্রিকা মারফত আমেরিকার সম্মেলনের খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। কোনও এক রাজা পরামর্শ দেন বিদেশে প্রচার করার সুযোগ পেলে দেশেও স্বীকৃতি মিলবে। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার খরচ অনেক। কিছু টাকা যোগাড় হলেও ঘাটতি ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না নরেন। দক্ষিণের রাজারা ভেবেছিলেন,যাওয়ার টাকা হলেই সেখানে পৌঁছে কিছু ধনী মানুষের সাহায্য মিলবে। কিন্তু সেটা ছিল অনিশ্চিত। তাই সাহস পাচ্ছিলেন না নরেন। রাজারা আলাসিঙ্গার নেতৃত্বে একটা চাঁদা কমিটি গড়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা তুলতে শুরু করলেন। কিন্তু পাঁচশ টাকার বেশি চাঁদা উঠলো না। কিন্তু খরচ ছিল কমপক্ষে তিন হাজার টাকা। নরেন তাই হতাশ হয়ে সে টাকা গরিবদের মধ্যে বিলি করে দিতে বলেন।
চাঁদা দিতে ইচ্ছুকদের মধ্যে ছিলেন মহীশূরের রাজাও। কিন্তু তিনিও মোটা টাকা দিতে অপারগ হলেন। এদিকে মাদ্রাজের রাজাদের আশায় থেকে অনেকটা সময় চলে যায়। হঠাৎ একদিন খেতরীর মহারাজার দূত হিসেবে মুন্সী জগমোহন এলেন।নিঃসন্তান মহারাজার অনেকদিন পর ছেলে হয়।রাজার ধারণা হয়, নরেনের আশীর্বাদে রাজার ছেলে হয়েছে। কেননা কিছুদিন আগে নরেন্দ্রনাথ খেতরির মহারাজের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। শুনেছিলেন নিঃসন্তান রাজার দুঃখের কথা। নরেন্দ্রনাথ আশ্বাস দিয়েছিলেন রাজা একদিন সন্তান পাবেন। ফলে রাজার ভক্তিও শ্রদ্ধা নরেন্দ্রনাথের প্রতি বেড়ে যায়। বিবেকানন্দ জাহাজ ভাড়া ছাড়াও আরও তিন হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন রাজার কাছ থেকে। কিন্তু ছোট্ট রাজ্যের বাজেটের থেকে এত টাকা দিলে মন্ত্রিসভার থেকে আপত্তি উঠতে পারে। তাই নিজের সঞ্চয়ের থেকে টাকা দেবেন বলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল থেকে ১০ মে রাজার অতিথি হয়ে থেকে বিবেকানন্দ আমেরিকায় গেলেন। তাই কপর্দকহীন কথাটা খাটে না। (বিবেকানন্দ অন্য চোখে, নিরঞ্জন ধর, উৎস মানুষ সংকলন,পৃষ্ঠা৪৩/৪৫)।
রাজা অজিত সিং যাতে অসুবিধে না হয়,তাই বাড়তি তিন হাজার টাকা সর্কুলেটারি নোট রূপান্তরিত করে দেন। অবশ্য সেই টাকা আমেরিকা পৌঁছানোর পর হারিয়ে যায়। জনৈক মন্মথনাথ ভট্টাচার্য মারফৎ খবর পেয়ে রাজা অজিত সিং বোম্বাই এর টমাস কুক অ্যান্ড সন্স এর মাধ্যমে টেলিগ্রাম করে পাঁচশ টাকা আরও পাঠান। বলা হয়, আরও টাকার ব্যবস্থা তিনি করছেন। পরবর্তী সময়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নরেন্দ্রনাথ ১৮৯৮খ্রিস্টাব্দে ১ডিসেম্বর মহারাজাকে লেখেন, এই বিশ্বে আমি যতটুকু যা হতে পেরেছি তার প্রায় সবটাই আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে।আপনি এক ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলেন।আপনার জন্যই বিশ্বের সম্মুখীন হয়ে কিছু কাজ করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম অধিবেশনের প্রথম দিন ১১সেপ্টেম্বর আর শেষদিন ২৭সেপ্টেম্বর বিদায় ভাষণ ছাড়া মোট ৫ টি বক্তৃতা দেন। বিষয় ছিল, ভ্রাতৃভাব, হিন্দু ধর্ম, ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি , হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্ক ।এছাড়াও বিজ্ঞান বিভাগে আরও চারটি বক্তৃতা দেন।( চলবে)
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল