আমেরিকার মানুষ সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন কেন?

পর্ব: ২

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমেরিকার ধর্মসভায় বিবেকানন্দের ভগ্নী ও ভ্রাতাগণ সম্বোধনে মার্কিন জনগসম্মোহিত হলেন কেন এটাই নিবন্ধের বিষয়। আচ্ছা, সত্যিই কি চিকাগো শহরে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি ধর্মসভা ছিল? আমেরিকায় বিবেকানন্দের উপস্থিতি কি ধর্ম প্রচারের কারণে ? কোন ধর্ম প্রচার? হিন্দু নাকি বৈদান্তিক ধর্ম? দুটো ধর্মই কি এক ? আমেরিকা যাওয়ার টাকা তো প্রথমে কলকাতার সুবর্ণ বণিক সমাজের দেওয়ার কথা হয়েছিল। তাঁরা পিছিয়ে গেলেন কেন? রাজস্থানের খেতরির মহারাজার দেওয়া অর্থের জন্যই কি বিবেকানন্দের আমেরিকা হয়েছিল?যাওয়া সম্ভব হয়েছিল? এসবেরই উত্তর খুঁজব এই পর্বে।

চিকাগোর বিশ্বমেলা ছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।

প্রথমে দেখা যাক চিকাগোতে কি ধর্মসভার আয়োজন হয়েছিল? ইতিহাসের তথ্য বলছে ,১৮৯৩ সালে শিকাগোতে কোনো ধর্মসভার আয়োজন ছিল না। কলম্বাস ১৪৯৪ সালে আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশ্বমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার নাগরিকদের পার্থিব উন্নতির অংশ হিসেবে শিল্প, কৃষি , কলার বিকাশকে তুলে ধরা। ধর্ম এই মেলায় বিষয় ছিল না। এই সম্পর্কে নিরঞ্জন ধর তাঁর উৎসর মানুষ সংকলন প্রকাশিত বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে চিকাগো ধর্ম মহাসভায় শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন,১৯ শতাব্দীর শেষভাগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি যখন আধুনিক রূপ নিতে শুরু করেছিল তখন অনেক ছোটো ছোটো কারখানা মিশে গিয়ে কতিপয় বড় বড় কারখানার জন্ম দিচ্ছিল। কিন্তু ঐ শতাব্দীর শেষ দশকের গোড়াতেই আমেরিকার অর্থনীতি এক ভয়াবহ মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরে এত বড় মন্দা আর সে দেশে দেখা যায়নি বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।( পৃষ্ঠা ৪০)

বিবেকানন্দের অনুগামী মাদ্রাজের আলাসিঙ্গা পেরুমলের বিবেকানন্দের আমেরিকা যাত্রার খরচ চাঁদা তুলে জোগাড় করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার। আদায় হয় মাত্র পাঁচশ টাকা

নিরঞ্জন ধর যা লিখেছেন তার সারমর্ম , অর্থনীতির মন্দায় আমেরিকার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিরও ভুক্তভোগী হয়। কল কারখানায় ধর্মঘট শুরু হয়। লক্ষ লক্ষ রেল ও খনি শ্রমিকরা এসে কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সেই মারমুখী শ্রমিকদের সংগঠনের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে থাকে।নিরিঞ্জন্ট ধরে লেখেন,,,,,, জে এল এবং বারবারা হ্যামন্ড রচিত টাউন লেবারার ১৭৬০-১৮৩২ গ্রন্থটি থেকে আমরা জানতে পারি যে পার্লামেন্ট এইসময় জনসাধারণকে উচ্চতর শক্তির কাছে বশ্যতা শেখাবার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন গীর্জা নির্মাণের জন্য একলক্ষ পাউন্ড মঞ্জুর করেছিল এবং হাউস অফ লর্ডস – এ লর্ড লিভারপুল সদ্য শিক্ষিত লোকেদের মতামত পরিচালিত করার সামাজিক প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বক্তৃতা করেছিলেন। কিন্তু বিত্তশালী ব্যক্তিরা অচিরে বুঝতে পারলেন যে জনগণকে ঐভাবে পরিচালিত করা অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য হবে যদি তাঁরা নিজেরাই জনগণের সামনে অনুসরণ করার মত একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।,,,,( পৃষ্ঠা ৪১)

অর্থাৎ রবিবারের ধর্মীয বিধান চার্চে মনসংযোগের জন্য গীর্জা নির্মাণ শুরু হলো। পাশাপাশি রাস্তাঘাটে মন্দা সময় কাটাতে মানুষকে ঈশ্বরের কাছে মুক্তির পথ প্রমাণ করার ধর্মীয় উন্মাদনতৈরির সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গৃহীত হলো। রাস্তাঘাটে ছোট ছোট সমাবেশের করে ধর্মীয় আলোচনা শুরু হলো। এমনকি আমেরিকার প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার অধ্যাপক সৃষ্টি করা হতে লাগল। এই ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি করে জনগণের ক্ষোভ দমনের জন্য বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে চিকাগো শহরে জড় করা হলো। আধ্যাত্মিক উন্নতিকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বমেলায় ধর্মকে সংযুক্ত করা হলো কায়দা করে।১৮৯১ সালের ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর হল অফ কলম্বাস আর্ট প্যালেসে সম্মেলন চলে সতেরো দিন ধরে।

খবরটা ভারতের স্বাধীন রাজাদের কাছেও পৌঁছেছিল। দেশ চেনার নামে তখন সন্ন্যাসীদের ভরণপোষণের খরচ তুলতে ভারতের স্বাধীন রাজাদের দরজায় দরজায় ঘুরছেন বিবেকানন্দ। কিছু রাজ্যের রাজা ও দেওয়ানরা বিবেকানন্দকে জানান দেশে তেমন যখন আর্থিক সাহায্য মিলছে না, সেক্ষেত্রে বিবেকানন্দ আমেরিকায় গিয়ে মেলায় যোগ দিয়ে ভারতীয় ধর্ম প্রচার করলে সুরাহা কিছু হতে পারে। বিবেকানন্দ সেই পরামর্শ যুক্তিযুক্ত মনে করলেও যখন যাতায়াতের খরচের কথা উঠল দেখার গেল রাজারা যে সাহায্য দিতে চাইছেন তা খুবই সীমিত। ওই অল্প পয়সায় ভরসা করে বিদেশে যাওয়া নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। কিন্তু তাঁর এক অনুগামী আলাসিঙ্গা পেরুমলের নেতৃত্বে ভক্তরা একটি চাঁদা কমিটি গঠন করে মাদ্রাজে ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন।কিন্তু পাঁচশ টাকার বেশি সংগ্রহ হয় না। দক্ষিণ ভারতের ওপর বিবেকানন্দের আস্থা কমতে শুরু করে।

নিরঞ্জন ধর তাঁর বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে লিখেছেন,,,, এই যাত্রা বাবদ যাতায়াত বাদে স্বামীজীআনুমানিক ন্যূনতম ব্যয় হাজার তিনেক টাকা ধরেছিলেন। কিন্তু পাঁচশ টাকা সংগ্রহ হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে আলাসিঙ্গাকে সংতবে তিনজাগৃহীত অর্থ গরীব দুঃখীদের বিলিয়ে দিতে বললেন।,,,, আর তাঁর পক্ষে উত্তরের কোন রাজপুত নৃপতির কাছে সাহায্যপ্রার্থীহওয়া সম্ভব ছিল না।, কারণ একদিকে তখন সেখানে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছিল, অপরদিকে আবার তেমন ছিল তাঁর সময়ের অভাব। মাদ্রাজি ভক্তদের স্টোকবাক্যে ভুলে বিবেকানন্দ মাদ্রাজে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলেছিলেন।( পৃষ্ঠা ৪৩)

রাজস্থানের খেতরির রাজা অজিত সিং বিবেকানন্দের আশীর্বাদে পুত্রসন্তান হওয়ায় আমেরিকা যাওয়ার খরচ দিতে সম্মত হন।

এরপরেই খেতরির রাজপুত মহারাজা অজিত সিং কর্তৃক প্রেরিত হয়ে তাঁর মুন্সী জগমোহন বিবেকানন্দের কাছে এসে বলেন স্বামীজির আশীর্বাদে রাজারপুত্রলাভ হয়েছে। তাই সেই পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে তিনি এসেছেন বিবেকানন্দকে নিয়ে যেতে। এমনকি রাজা তাঁকে যাতায়াত বাদে আরও তিনহাজার টাকার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এই টাকা করদ রাজ্যের বাজেট থেকে দিলে মন্ত্রিসভার আপত্তি উঠতে পারে তাই রাজা অজিত সিং নিজের কোষাগার থেকে এই টাকায মঞ্জুর করেন। স্বামীজী ১৮৯৩ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১০ মে খেতরিতে রাজার অতিথি হিসেবে থেকে আমেরিকা যাত্রা করেন। রাজা জয়পুর পর্যন্ত এলেন।

বোম্বাই থেকে পেনিনসুলার জাহাজে বিবেকানন্দ আমেরিকা গেলেন।

বোম্বাই গিয়ে জাহাজে তুলে দেন রাজার মুন্সী জগমোহন। পেনিনসুলার জাহাজে প্রথম শ্রেণীর একটি টিকিট ও তিনহাজার টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া আরও কিছু টুকিটাকি জিনিষ স্বামীজীর সঙ্গে দেওয়া হয়। তবে তিনহাজার টাকা সার্কুলারি নোটে রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়। কিন্তুআমেরিকা পৌঁছানোর আগেই সেই নোট খোয়া যায়। ফলে আমেরিকায় পৌঁছেও নিদারুণ আর্থিক অসুবিধায় পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত সেই বিপদ কি ভাবে সামলালেন বিবেকানন্দ? ( চলবে)

পরবর্তী পর্ব আগামীকাল ১৪ সেপ্টেম্বর ,২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *