আমেরিকার ধর্ম সম্মেলন ও বিবেকানন্দ আসল ঘটনা কি?

পর্ব: ৩

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : রাজস্থানের খেতরির মহারাজা অজিত সিংয়ের সাহায্য ছাড়া বিবেকনন্দের আমেরিকা যাত্রা সম্ভব ছিল না। কেননা কেউ কথা রাখেনি।আগেই বলেছি বাংলা থেকে আর্থিক চাঁদা আদায় যে হয়নি সেকথা অতি বড় বিবেকানন্দ ভক্তও স্বীকার করবেন। বলতে পারেন বাঙালি বরাবর ঘরের হীরে চিনতে ভুল করে। কিন্তু প্রশ্ন কলকাতার উচ্চ বর্ণের ধনী সম্প্রদায় ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিবেকানন্দের বা রামকৃষ্ণের তেমন যোগাযোগ কি সত্যিই ছিল? হুগলির আঁটপুরের এক গুরুভাই বাবুরামের বাড়িতে ২৫ শে ডিসেম্বরের ছুটি কাটাতে যান। ২৪ ডিসেম্বর তাঁর ইচ্ছে হয় তাঁরা সন্ন্যাস নেবেন। বিরজা ব্রত করে এর আগে অবশ্য রামকৃষ্ণপরমহংসের মৃত্যুর আগেই গুরুভাই গোপালচন্দ্র ঘোষ গঙ্গাসাগর মেলায় আসা সাধুদের দেওয়ার জন্য বারোটি সাদা কাপড় কিনে গেরি মাটির জলে চুবিয়ে গৈরিক করেন। গোপাল ছিলেন বিবেকানন্দের চেয়ে বয়সে বড়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একাকীত্ব ভুলতে রামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে আসেন। রামকৃষ্ণদেব সেই গেরুয়া বিস্তর ও রুদ্রাক্ষের মালা মন্ত্রপূত করে দেন। নরেন, কালী, শশী, শরৎ, নিরঞ্জন , বাবুরাম প্রমুখ b১১ জন শিষ্য সেই গেরুয়া বস্ত্র গ্রহণ করেন। আরেকটি বিস্তর দেওয়া হয় গিরিশচন্দ্রকে। গিরিশচন্দ্র অবশ্য গৃহী সন্ন্যাসী। তিনি গেরুয়া কোনোদিন পরেন নি।

বিবেকানন্দের গুরু ভাই কালী ওরফে স্বামী অভেদানন্দ

প্রথামত বলতে গেলে কেউ তখনও শাস্ত্রমতে সন্ন্যাসী নন। রামকৃষ্ণদেব জীবিত থাকাকালীন বুদ্ধগয়া চলে যান নরেন সঙ্গীদের নিয়ে। বাড়ি ফেরার টাকা না থাকায় সেবার কি বিপদে পড়েন এবং কে তাঁকে উদ্ধার করেন সে কথায় পরে আসছি। বুদ্ধগয়া থেকে ফেরার পথে গয়ায় গিয়েছিলেন শিষ্য কালীপ্রসাদ। সেখানে এক দশনামী সন্ন্যাসীর কাছ থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার মন্ত্র ও টুকিটাকি সংস্কার খাতায় টুকে আনেন।২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণের পাদুকার সামনে বসে মন্ত্র পড়ে দীক্ষিত হলেন সন্ন্যাসী হিসেবে। কালী হলেন অভেদানন্দ , নরেন হলেন বিবিদিষানন্দ। যার অর্থ জ্ঞানপিপাসু যিনি।এছাড়াও নরেন পরিচিত ছিলেন সচ্চিদানন্দ নামে। যিনি চেতনাকে উপলব্ধি করেছেন তিনিই সচ্চিদানন্দ। নামটি নিজের তিনিই রেখেছিলেন। অবশ্য তাঁর প্রথম ইচ্ছে ছিল রামকৃষ্ণানন্দ নামটি। কিন্তু শশী মহারাজ তাঁর চেয়ে প্রবীণ। তাই তাঁকে সেই নাম গ্রহণ করতে বলেন। মার্গারেট নোবেলের নাম নিবেদিতা তিনিই রাখেন। আবার বিখ্যাত জাপানি শিল্পী ওকাকুরা কাকুজো কে তিনি নাম রাখেন অক্রুর খুড়ো।

নাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , নামে কি এসে যায়। আবার জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, নামের একটা মহিমা ও মাধুর্য আছে বৈকি। রবীন্দ্রনাথের নাম যদি হলুইদাস পতিতুন্ডি আর আমার নাম যদি গদাধর তলাপাত্র হত, তাহলে কেমন শোনাতো? আবার সেই রবীন্দ্রনাথ কাব্যে উপেক্ষিতা প্রবন্ধে লিখেছেন, নামকে যাঁহারা নামমাত্র মনে করেন, আমি তাঁহাদের দলে নই। শেক্সপিয়র বলেছেন গোলাপকে যে কোনো নামে ডাকো গোলাপের মাধুর্য বদলায় না। কিন্তু প্রশ্ন, তাহলে বিলে ওরফে বীরেশ্বর ওরফে নরেন ওরফে সচ্চিদানন্দ ওরফে বিবিদিষানন্দ ছেড়ে বিবেকানন্দ নামটি বেছে নিলেন সেকি উচ্চারণের সুবিধার জন্য নাকি স্পন্সর মহারাজা অজিত সিংকে খুশি করার জন্য?

বিদেশযাত্রার আগে স্বামীজী কে এই পোশাকে সজ্জিত করেন মহারাজা অজিত সিং।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ৪ ঠা জুন মাউন্ট আবুতে অপুত্রক অজিত সিংয়ের সঙ্গে বিবিদিষানন্দের পরিচয়। সেখানে তিনি ছ মাস ছিলেন। আমেরিকা যাত্রার আগে অজিত সিং পুত্রলাভ করেন। যুক্তিবাদীরা বলেন ঝড়ে বক মরে। ফকিরের কেরামতি বাড়ে। যাইহোক আমেরিক যাওয়ার খরচবাবদ তিন হাজার টাকা দেন। দেন গৈরিক বসন। রাজস্থানী পাগড়ি অজিত সিং নিজের হাতে ধরে শিখিয়ে দেন পাগড়ি পরা। বঙ্গসন্তান আমেরিকা চললেন রাজস্থানী পোশাকে।এবার অজিত সিংয়ের একটু পরিচয় দেওয়া যাক। রাজেশ দত্তের সম্পাদনায় রামকৃষ্ণ_ বিবেকানন্দ: মুক্ত মনের আলোয় বইতে স্বামীজী ও রাজন্যবর্গ প্রবন্ধে আছে ,,,,,,, ভিক্টোরিয়ার হীরক জয়ন্তী উৎসবে মহারাণীর পদলেহন করার জন্য এই অজিত সিংহ লন্ডনের রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন।,,,,, বিবেকানন্দ আমেরিকায় কি রামকৃষ্ণের হিন্দুত্বের বাণী প্রচার করেছিলেন? তথ্য বলছে, তিনি বেদান্ত প্রচার করেছিলেন। সেকথা শুনে কলকাতায় তাঁর গুরুভাইদের একাংশ ক্ষুব্ধ হন। এই সম্পর্কে বিবেকানন্দ অন্য চোখে গ্রন্থে নিরঞ্জন ধর চিকাগো ধর্মসভায় শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন,,,,,,, বাবুরাম মহারাজের নেতৃত্বে গুরুভাইদের একাংশ বিবেকানন্দের প্রতি নিতান্ত বিরূপ ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে মহারাজা অজিত সিংকে চিঠি লিখে বলেন, আপনি একমাত্র আমার বন্ধু।

স্বামীজীর মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত স্বয়ং ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন তা এখানে উদ্ধৃত করা গেল_ অল্পদিনের মধ্যেই parlament – এ প্রদত্ত স্বামীজীর বক্তৃতা কলিকাতায় আসিল। তাহাতে বেদান্তের ভাব আছে এবং অহং বা আমিশব্দ ব্যবহৃত হইয়াছিল। কিন্তু শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের উল্লেখ ছিল না। বাবুরাম মহারাজ এই জন্য বিশেষ ক্রুদ্ধ হইলেন। তিনি একেবারে ভূতগ্রস্থ পাগলের মত হইয়া উঠিলেন এবং সর্বত্র স্বামীজীর নিন্দা_ গালাগালি ও কুৎসা রটনা করিতে লাগিলেন। নিজের মতের অনুযায়ী একটি দল গঠন করিয়া আলমবাজারের মঠ হইতে কলিকাতার নানা স্থানে তাঁহার দলের লোকের মধ্যে স্বামীজীর নিন্দা রটাইতে লাগিলেন।( পৃষ্ঠা৪৭/ উৎস মানুষ প্রকাশন)

বিবেকানন্দের গুরুভাই বাবুরাম মহারাজ ওরফে স্বামী প্রেমানন্দ বিবেকানন্দের বিরোধী হয়ে কুৎসা শুরু করেছিলেন

পর্ব : ৪ আগামীকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *