যোগে রোগ সারে কতটা সত্যি ?

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: অনুরোধটা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।২০১৪সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী২১জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস ঘোষণার অনুরোধ জানান রাষ্ট্রসংঘের কাছে। মাত্র ছ মাসের মধ্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ঘোষণা করে ২০১৫ থেকে প্রতি বছর ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস পালিত হবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলে, বিশ্ববাসীর জীবনে মানসিক শান্তি আর শারীরিক সুস্থতা গড়ে তুলতে যোগা(ইয়াগা)একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই প্রস্তাব সমর্থন করেন রাষ্ট্রসংঘের ১৯৩জন সদস্য ও ১৭৭টি দেশ।২০১৫সালের ২১ জুন দিল্লির রাজপথে দেশের দি মিনিস্ট্রি অফ আয়ুশ আয়োজন করে এক গণ যোগাভ্যাস অনুষ্ঠান। যোগ দেন প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্বীকৃতি দিয়ে জানায়, এটি বিশ্বের সর্বাধিক মানুষের যোগাভ্যাস ।

২০১৭ সালে এই অনুষ্ঠান হয় লখনউ এর রমাবাঈ আম্বেদকর স্টেডিয়ামে। বৃষ্টি মাথায় করে সেদিন স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন ৫০ হাজার মানুষ।মুখ্যমন্ত্রী যোগিজীর পাশে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবনে যোগার গুরুত্ব অনেকটাই নুনের মত। যোগা জীবনের নতুন মাত্রা যোগ করে।যোগা হলো বিনামূল্যের স্বাস্থ্যবীমা। আজ ইয়াগা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ইয়াগার সামগ্রী বিক্রি হয়।সেখানে যোগাভ্যাস করেন দেড় কোটি মানুষ।আমাদের দেশেও ইয়াগা স্টুডিও ও ফিটনেস মডেল মডার্ন ইয়াগা কোর্স করানো হচ্ছে ২০হাজার থেকে ৫০হাজার টাকায়। ইয়াগা শিখে দেশের বেকার জনতা কামাচ্ছে ৩০হাজার থেকে ১ লাখ। যাঁর জমক যত , তার তত দর। আধ্যাত্মিক গুরুদেরও রমরমা।কলকাতার এক ব্যান্ড গায়ক একটি দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীর সম্পাদক। তাঁর সাময়িকীর ২০১৫ এর ৫ জুলাই সংখ্যায় প্রতিবেদক অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় লেখেন, বিভিন্ন গুরুরা খুলে বসলেন আর্ট অফ লিভিং – এর স্কুল । কিছুটা যোগ ধ্যান ,কিছুটা মনস্তত্ত্ব,কিছুটা জ্ঞানগর্ভ বাণী মিলিয়ে তৈরি একদম নতুন লাইফস্টাইল। স্ট্যাটাস সিম্বল।,,,,,, শিল্পা শেঠির সিনেমা ফ্লপ, কিন্তু তাঁর যোগাসনের সিডির প্রদর্শনী হইহই হাউসফুল।

শিল্পা শেঠির সিনেমা ফ্লপ কিন্তু যোগা জমে ক্ষীর।

তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল প্রায় ৯ হাজার মানুষকে শ্রীনগরের শের ই কাশ্মীর ইন্টারন্যেশেনাল কনভেনশনাল সেন্টারের বাইরে যোগাসনে নির্ধারিত আসনে বহু আগে থেকে বসিয়ে রাখা হয় ।অনুষ্ঠান শুরুর সময় ছিল সকাল সাড়ে ছ়টায়। উপস্থিত কেউ জানতেন না তাঁরা যোগা করবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। যথা সময়ে পৌঁছে যান প্রধানমন্ত্রী যোগাসনের পোশাক পরে। বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠান অবশ্য কনভেনশনাল হলের ভেতর অনুষ্টিত হয়।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত ,প্রধানমন্ত্রী আসন্ন কাশ্মীরের নির্বাচনকে মাথায় রেখেই এক ঢিলেদুই পাখি মারলেন। যোগা করে সেলফি তুললেন কাশ্মীরের মানুষে সাথে। রাজনীতির আশ্বাস দিলেন মোদী কি গ্যারেন্টি বললেন । বিজেপি কেন্দ্রীয় স্তরের ও রাজ্য স্তরের নেতারাও দেশ জুড়ে যোগা করলেন।

কাশ্মীরে যোগা শিবির করে ভোটের আগে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন মোদীজি।

যোগে রোগ সারে। এই ধারণা নতুন করে মানুষ বুঝতে শিখল।যদিও আমেরিকায় ১৯৬৮ সালে মহেশ যোগী ইয়াগা প্রচার করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত মিউজিক ব্যান্ড বিটিলস। তারও আগে আমেরিকায় যোগার প্রচার করেছিলেন বিবেকানন্দ। এখন ইয়াগার দুটি ব্র্যান্ড শিখরে। এক) রামদেব বাবা,দুই ) রবিশঙ্করজী। তিনি বলেন, যোগাভ্যাসের প্রথম ধাপ নির্দিষ্ট আসন রপ্ত করা। দ্বিতীয় ধাপে যোগাভ্যাসের সময় নিজের ভুরুর মাঝখানে দুই চোখের দৃষ্টি এক করা। এরফলে মন হবে স্থির।নিজের দীক্ষা মন্ত্র উচ্চারণ করলে মনে শান্তি আসবে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাসে প্রাণায়াম করার সময় ওং মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। যোগাভ্যাসের স্থান নির্জন হতে হবে। আগের দিন রাতে একা ঘুমাতে হবে। বিবাহিতা স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে শয্যাসঙ্গী করা যাবে না। সহবাসের পরেপরেই যোগাভ্যাস করা যাবে না। অন্য কারোর মুখের খাবার খাওয়া যাবে না। প্রথম প্রথম পনেরো মিনিট । পরে চার ঘণ্টা যোগা করা অভ্যাস হয়ে যাবে।
রামদেব বাবা তো বিস্ফোরক দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন , মানুষের অঙ্গপ্রতঙ্গ এমনভাবে তৈরি যে সংযমী জীবন যাপন করলে ৪০০ বছর বাঁচতে পারে। দরকার ছঘণ্টা ঘুম আর এক ঘন্টা যোগা। রবিজীর চার ঘণ্টার বিধান , রামদেব বাবাজীর এক ঘন্টা।সিদ্ধান্ত আপনার।

বিদেশে স্বাস্থ্যরক্ষায় যোগের ভূমিকা ও আসন শিখিয়ে বাজার মাতিয়েছেন প্রথম মহেশ যোগী

সম্প্রতি রামদেব বাবা আবার বোমা ফাটিয়েছেন।বলেছেন, নাকে সর্ষের তেল দিয়ে উজ্জয়ী নামের এক প্রাণায়াম করলে করোনা পালিয়ে যাবে। আপনি ভাবছেন,তাহলে আর ভ্যাকসিন কি দরকার?ঠিকই ভাবছেন। ভারতের গুরুর কদর এখনও বিজ্ঞান দিতে শিখল না।ইদানিং আর এক সৎগুরু এসেছেন। অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের মত দেখতে। টিভিতে প্রায়ই দেখা যায়। তিনি বলছেন, ইদানিং মানুষ বোঝেন,কিছু নির্দিষ্ট পোশাক পরে ব্যায়াম করা। সকলেই আমাকে প্রশ্ন করে, আমি রোজ কতক্ষন যোগা করি? উত্তরে আমি বলি , ২০ সেকেন্ড। ২০ সেকেন্ডই আমার যথেষ্ট।আমি প্রতিদিন নিজের ও অন্যের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজি। এটাই যোগ।

সৎ গুরু বলেছেন, তিনি যোগা করেন ২০ সেকেন্ড মাত্র।

যোগ নিয়ে এত কথা। আসলে যোগ কি?যোগ শব্দটি সংস্কৃত। যার মানে একত্রিত। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ। ঋষি পতঞ্জলির কথায় যোগ মানে মনকে নিয়ন্ত্রন করা। যোগাসনের শুরু সিন্ধু সভ্যতায়। বৈদিক ও বুদ্ধবাদে যোগাসনের উল্লেখ আছে। তার সাথে পতঞ্জলির ভাষ্যে মিল আছে। ঋষি পতঞ্জলির যোগ দর্শনে আটটি শাখা আছে। ইয়ম(সামাজিক বিধি), নিয়ম (ব্যক্তিগত বিধি), আসন (শারীরিক বিধি), প্রাণায়াম (শ্বাস প্রশ্বাসের বিধি), প্রত্যাহার (চেতনায় নির্লিপ্ত), ধারণ (মনঃসংযোগ), ধ্যান ও সমাধি।অথচ যোগার নামে ধর্মীয় অনুভূতি তৈরির চেষ্টা হলেও যোগা আসনই বিষয়। মূলত যা মন সংযমের জন্য দরকার। গতিশীল দুনিয়ায় ইঁদুর দৌড়ে মানুষ বিপথে চালিত হচ্ছে। আত্মহত্যা করছে।

পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত অর্থোপেডিক শল্য চিকিৎসক অশোক রাজাগোপাল বলেছেন, যোগে যদি রোগ সারে তাহলে বাবাজিরা আমাকে দিয়ে অপারেশন করান কেন?

অবশ্য ক্যান্সার ডাইবেটিস ইত্যাদি কঠিন রোগে সারানোর দাবি যা করা হয় তা আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র কি মেনে নিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর অধরা থেকে গেলো। বেশ কিছুদিন আগে গুরেগাঁও এর পদ্মশ্রী প্রাপ্ত এক অর্থোপেডিক সার্জন রাজগোপাল বলেছেন,যোগ ধর্মীয় সাধনার জন্য ভালো হলেও হাঁটু আর গোড়ালির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তিনি নিজেই অনেক যোগগুরুর হাঁটু অপারেশন করেছেন । উদাহরণ হিসেবে তিনি বজ্রাসনা আসনটির কথা বলেছেন।ইংরেজিতে যাকে বলে থান্ডারবোল্ট। এই আসনে নিতম্বের নিচে দুই পায়ের গোড়ালিকে আটকে রাখা হয়।যার ফলে আক্রান্ত হচ্ছেন যোগ গুরুরা নিজেরাই।

এই বজ্রাসন করে ধর্মীয়গুরুরা নিজের হাঁটু নষ্ট করে আমার কাছে আসছেন। দাবি, ডা: রাজাগোপালের।

তবে যোগাসনের উপযোগিতা বোঝাতে দক্ষিণের টি কৃষ্ণামাচারি তিন ছাত্রকে তৈরি করেন। বি কে এস আয়াঙ্গার, পট্টভি জায়েস ও টি ভি কে দেশিকাচার ছিলেন সেই তিন ছাত্র। টি কৃষ্ণামাচার্য শিখেছিলেন হিমালয়ের গুহায় সাত বছর রামমোহন ব্রহ্মচারীর কাছে থেকে। বিদেশে যোগাসনের ব্যাপ্তি এরাই ঘটান। দেশে এদের কেউ চেনেন না। প্রচার ছাড়া প্রসার হয় ক্যামনে? আবার এলো আন্তর্জাতিক যোগ দিবস । মানুষ যোগ থুড়ি ইয়াগায় মেতে উঠলেন নতুন করে । হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রাক মুহুর্তে বাজারে যোগ থুড়ি ইয়াগাকে হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার কেমন জমে সেটাই দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *