শিব এলেন কোথা থেকে? পর্ব ৮

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: শিব প্রসঙ্গে গভীরে পৌঁছতে বাংলার আদি লৌকিক ধর্ম নাথ ধর্ম প্রসঙ্গে জানা দরকার।আগেই বলেছি,আর্য সংস্কৃতির ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পাশাপাশি বাংলায় সাধারণ জনসমাজে লৌকিক ধর্মের প্রাধান্য ছিল। যার অন্যতম ময়নামতীর গান। এই গান বাংলা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় গুজরাট, পাঞ্জাবে ও মহারাষ্ট্রেও। ময়নামতী একটি স্থানের নাম । বর্তমানে যা কুমিল্লা শহরের কাছে অবস্থিত। এখানকার রাজা ছিলেন মানিকচন্দ্র। অঞ্চলটির নামকরণ হয় রাজার স্ত্রী ময়নামতীর নামে। সূত্র বলে, এই রাজদম্পতির একমাত্র পুত্র গোপীচন্দ্র ওরফে গুপীচাঁদ সিংহাসন এবং দুই স্ত্রী অদুনা ও পদুনাকে ত্যাগ করে সহজিয়া গুরু হাড়িপারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। অবশ্য তাঁর এই সন্ন্যাসী হওয়ার পেছনে মা ময়নামতীর অবদান ছিল অনেকটাই। সুন্দরী ময়নামতী শৈশব থেকেই ছিলেন ধর্মপ্রাণা। জানতেন জ্যোতিষ বিদ্যা ও যোগা সাধনা। নিজের ভবিষ্যত গণনা করে দেখেছিলেন, তাঁর পুত্র ১৮ বছর বয়সে মারা যাবে। দেবতা স্বপ্ন দিয়ে শর্ত দেন,একমাত্র সন্তান যদি সন্ন্যাসী হয়,তাহলেই প্রাণ বাঁচবে। তাই ছোট থেকেই ধর্মশিক্ষা দিয়ে রাণী পুত্র গোপীচাঁদকে  সন্ন্যাস ধর্ম নিতে উৎসাহিত করেন। মায়ের কাছে পুত্রের প্রাণরক্ষাই তো প্রধান লক্ষ্য থাকে। গোপীচাঁদ ওরফে  চৌরঙ্গীনাথের এই হাড়িপা গুরু ছিলেন দেবী হাড়িঝি চণ্ডীদেবীর উপাসক। গোপীচাঁদের সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছাকে সমর্থন করেননি তাঁর দুই স্ত্রী। শ্বাশুড়ি নষ্ট চরিত্রের অভিযোগ তোলেন। রাজা মানিকচাঁদও  সন্তুষ্ট ছিলেন না স্ত্রীর ওপর। তাঁর ইচ্ছা, ছেলে রাজা হবে। কিন্তু ছেলের সন্ন্যাস গ্রহণের পিছনে স্ত্রীর সমর্থন তিনিও মেনে নিতে পারেন নি। তাই রাণীকে তিনি ফুটন্ত তেলের পাত্রে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু রাণী ঐশ্বরিক ক্ষমতায় প্রাণে বেঁচে যান। রাজা ও গোপীচাঁদ ওরফে চৌরঙ্গীনাথের  দুই স্ত্রী ক্ষমা চেয়ে নেন রাণীর কাছে । পুত্র গোপীচাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। গোপীচাঁদের দীক্ষাগুরু ছিলেন দেবী হাড়িঝি চণ্ডীদেবীর উপাসক। দেবী হাড়িঝি অনেকটাই চব্বিশ পরগণার ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের মত লৌকিক দেবতা। অনেক ঐতিহাসিকের বক্তব্য, বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা সিংহলে পৌঁছে স্থানীয় যে লৌকিক দেবীর সন্ধান পান সেই দেবীই বাংলায় স্বীকৃতি পান। আজও নাকি নাথদেবের মন্দির আছে সেখানে। নিত্য পুজোও হয়। তবে তা বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কোনো সম্পর্কহীন।

কুমিল্লায় ময়নামতি রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।

ময়নামতী ও তাঁর সন্তানের নাথধর্মের প্রতি অনুরাগ নিয়ে চর্যাপদের কবিতা গান হয়ে বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল সে কথা আগেই বলেছি।ড:অতুল সুরের মতে, নাথধর্ম শৈবধর্মের শাখা বিশেষ। তবে তা ছিল বৌদ্ধ ও তন্ত্রধর্মে প্রভাবিত। নাথধর্মের গুরুরা উপাধি হিসেবে নাথ শব্দটি ব্যবহার করেন। কলকাতার একটি অভিজাত এলাকা ধর্মতলা বা চৌরঙ্গী।অঞ্চলটি নাথধর্মের গুরু চৌরঙ্গীনাথের  নামে পরিচিত। কলকাতার কার্জন পার্কের সংলগ্ন ছিল একটি বিশাল বট গাছ। গাছের নিচে ছিল যোগী চৌরঙ্গীনাথের সাধনাস্থল। সময়টা ষোড়শ শতাব্দী।সেদিনের কলকাতা ছিল ঘন জঙ্গল। ছিল হিংস্র জন্তুর বাস। উপরন্তু ছিল কুখ্যাত ডাকাতদের ভয়। শোনা যায় , ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এই জঙ্গলে হাতির পিঠে চেপে বন্দুক নিয়ে বাঘ শিকারে বেরোতেন ওয়ারেন হেস্টিংস। কিছু আদিবাসী মানুষের বিক্ষিপ্ত জন বসতিও ছিল ধর্মতলায়। মারী নিয়ে ঘর করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বাঘ নিয়েও ঘর করত নিয়তির হাতে জীবনকে সঁপে দিয়ে।

বাংলাদেশের বাংলা ভাষার বিখ্যাত ভাষাবিদ গবেষক ড: শহীদুল্লাহ বলেছেন, চৌরঙ্গীনাথ ছিলেন পাল বংশীয় রাজপুত্র। উপাখ্যান বলে, পূর্বদেশ (কুমিল্লার শালবান) এর রাজার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর মহারাজ দ্বিতীয় বিবাহ করেন। নতুন রাণী  সৎ পুত্রকে নৌকা করে আজকের কলকাতার দক্ষিণাঞ্চল গোবিন্দপুরের বনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আসার নির্দেশ দেন। ঘাতকেরা চার হাত পায়ের কিছু অংশ কেটে ফেলে আসে। ওই পথে যাচ্ছিলেন গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ । তাঁর সঙ্গী শিষ্যরা আহত চৌরঙ্গী নাথকে শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন। চৌরঙ্গীনাথ গুরুদেবের শিষ্যত্ব গ্রহন করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর চার অঙ্গ আঘাত প্রাপ্ত হয় বলে নামকরণ হয় চৌরঙ্গীনাথ । তাঁর আর এক নাম ছিল গাভুর সিধাই। অর্থাৎ নবীন সাধক।

বিজ্ঞাপন

চৌরঙ্গিনাথ ও গোরক্ষনাথ

অন্য উপাখ্যান বলে,পুত্রের ধর্মীয় সাধনা দেখে চিন্তিত হন পিতা। কেননা ঘর ছেড়ে সাধনায় জঙ্গলে চলে যান চৌরঙ্গীনাথ। সেখানে পশুপাখি হয়ে যায় তাঁর বন্ধু। প্রমাদ  গুণে ছেলেকে সংসারী করতে বিয়ে দেন। কিন্তু চৌরঙ্গীনাথ স্ত্রীদের প্রতি ছিলেন অনাসক্ত। বরং তাঁর একটি পোষা হরিণের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রচণ্ড। চৌরঙ্গীনাথের স্ত্রী রাগে দুঃখে হরিণটিকে জঙ্গলে ছেড়ে আসেন তাঁর ভাইকে দিয়ে। হরিণটি হারিয়ে শোকে দুঃখে  ঘর ছেড়ে বাসস্থান হুগলি থেকে একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ভাগীরথীর পথে  চললেন দক্ষিণ পথে। পরিশ্রান্ত  হয়ে চৌরঙ্গী নাথ নৌকা নোঙর করেন আজকের ধর্মতলায়।নজরে পড়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া হরিণ শাবক।সেখানে বটগাছের নিচে আস্তানা গড়েন চৌরঙ্গীনাথ।শিকারের জন্য জঙ্গলে তখন ঘুরছিলেন আদিবাসীরা। তাঁরা চৌরঙ্গীনাথের দর্শন পান এক পর্ণ কুটিরে। তাঁরা মনে করেন, স্বয়ং মহাদেবের দেখা পেয়েছেন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সাধকের আগমনবার্তা। বাড়তে থাকে ভক্ত। পর্ণ কুটির পরিণত হয় আশ্রমে। প্রথমে চৌরঙ্গীনাথের পিতামহ বাংলাদেশের কুমিল্লার লালমাই পাহাড় অঞ্চলে থাকতেন। সেখান থেকে এপার বাংলার হুগলিতে আসেন। আবার ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, শালবান রাজার পুত্র গাভুর  সিদ্ধাই (চৌরঙ্গীনাথ) ত্রিপুরার লালমাই পাহাড়ের অধিবাসী ছিলেন। গাভুর সিদ্ধাই নামের অর্থ যুবক সিদ্ধ পুরুষ।সংসারে চৌরঙ্গীনাথের  নাম ছিল গোপীচাঁদ। গোপী চাঁদের বোনের নামে পাহাড়ের নামকরণ হয়েছিল লালমাই। রাজা মানসিংহ ছিলেন এই নাথ ধর্মে দীক্ষিত। কালীঘাট মন্দিরের  বিগ্রহ আদি গঙ্গাতীরে আবিষ্কার করেন এই চৌরঙ্গীনাথ। সে যুগে কলকাতা ছিল তান্ত্রিক ভূমি। কালীপীঠ। চৌরঙ্গীনাথের মা কালীকোট বা কৌণিক গ্রামে দূর্গ নির্মাণ করেন। রাণী ময়নামতীর উদ্দেশ্য ছিল, চাণক্য রাজ ও চন্দননগরের (চান্দর)এর রাজা বঙ্গদেব বর্মাকে বাংলা থেকে তাড়ানো । একবার ধর্মতলার  চৌরঙ্গীনাথের সেই আশ্রমে হানা দেয় এক পর্তুগিজ দস্যু। ইতিহাস বলছে, পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবার বন্দরে বসবাসকারী গুজরাটি বণিকদের সহয়তায় ভারতে ষোড়শ শতকে প্রথম আসে পর্তুগিজরা। মূলত কারণ ছিল তাঁদের গোলমরিচের পরিবর্তে ভারতের সূতি কাপড় ইন্দোনেশিয়ায় বিক্রি করা। বাংলায় পর্তুগিজরা প্রথম আসে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে সুন্দরবন হয়ে পর্তুগিজদের একটি দল কলকাতায় আসে। আর এক দল ব্যবসায়ী হুগলিতে আসে। এই পর্তুগিজদের একাংশ ডাকাতিতে নামে। আশ্রম আক্রান্ত হলে ভক্তরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে পরাজিত পর্তুগিজ দস্যু পালিয়ে যায়। সরলমতি কলকাতার আদিবাসীরা মনে করলেন, বাবাজির দৈব ক্ষমতায় দস্যুরা পালিয়ে গেছে।

কলকাতার নন্দন ও ময়দান থানার মধ্যবর্তী চৌরিঙ্গীনাথের সমাধি কেড়ে রামের মন্দির বানানো হল। বাংলা সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিতে?

অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক এই কাহিনী মানেন না। তাঁরা বলেন, চৌরঙ্গী অঞ্চলে এখন যেখানে রবীন্দ্রসদন ও ময়দান থানার মধ্যবর্তী স্থানে  চৌরঙ্গীনাথের সমাধিক্ষেত্র ঘিরে এক রাম মন্দির গড়ে উঠেছে।সাধক চৌরঙ্গীনাথ সম্পর্কে কথিত আছে, তিনিই  কলকাতা গ্রামে কালিকাদেবীর মূর্তি গোবিন্দপুরের মাটির নিচ থেকে নিচ থেকে উদ্ধার করেন। চৌরঙ্গীনাথের পিতামহ প্রথমে বসবাস করতেন অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লার লালমাই পাহাড় অঞ্চলে । পরে আসেন এপার বাংলার হুগলিতে। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, শালবান বাজার পুত্র গাভুর সিদ্ধাই ছিলেন ত্রিপুরার লালমাই পাহাড় অঞ্চলে। গাভুর সিদ্ধাই মানে যুবক সিদ্ধপুরুষ। সংসারে চৌরঙ্গীনাথের নাম ছিল গোপীচাঁদ ।  গোপীচাঁদের বোনের নামে পাহাড়ের নামকরণ হয় লালমাই। রাজা মানসিংহ ছিলেন এই নাথধর্মে দীক্ষিত। সে যুগে কলকাতা ছিল তান্ত্রিকভূমি।  চৌরঙ্গীনাথের মা ময়নামতীর  উদ্দেশ্য ছিল, চাণক্যরাজ ও  চন্দননগরের(চান্দর) এর রাজা ধঙ্গদেব বর্মাকে বাংলা থেকে তাড়ানো। কারণ অবশ্য অজানা। নাথ ধর্মের সময়কাল ছিল সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত।

বিজ্ঞাপন

আগামী পর্ব ৯ ও ১০ ,২০ এপ্রিল শনিবার ও ২১ এপ্রিল রবিবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *