শোভাবাজারের বনেদি অমৃত লাল দাঁ ট্রাস্টের উদ্যোগে ১৭৮ তম বর্ষের জগদ্ধাত্রী পুজো হলো সাড়ম্বরে

******

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : দুর্গাপুজো , কালী পুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই জগদ্ধাত্রী পুজোর আবাহন মুহূর্ত এসে যায়। ১৪ শতকের প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র স্রষ্টা শূলপাণি তাঁর ব্রতকাল বিবেক গ্রন্থে দেবী জগদ্ধাত্রী সম্পর্কে শ্লোক রচনা করেন, কার্তিকে মল পক্ষস্য বেতাদৌ নবমেহমি,পুজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহ পৃষ্ঠে নিষেছষীম। অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর ধারা পূর্ব নির্দেশিত।১৫ ও ১৬ শতাব্দীতে বৃহস্পতি রায় মুকুটের স্মৃতি রত্নহার ও শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণির কৃতান্তষবার্ণব গ্রন্থে ওই একই পক্ষ, মাস ও তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ মেলে। পণ্ডিত শরণদেব ১১৭২ বঙ্গাব্দে যে চণ্ডীটিকা লেখেন, সেখানেও জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ আছে। তবে জগদ্ধাত্রী যে শুধু হিন্দু দেবী, তা নয়। বৌদ্ধতন্ত্রেও জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ আছে। সকালে সাত্ত্বিকী, মধ্যাহ্নে রাজসিকী ও সন্ধ্যায় তামসিকী জগদ্ধাত্রী পুজো পদ্ধতি বৌদ্ধ আচার ।

উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে আসা অবাঙালি ব্রাহ্মণ ক্ষিতীশ পুত্র ভট্ট নারায়ণেরদ্বাদশ পুত্র কামদেবের চতুর্থ পুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর রুদ্র রায়ের পুত্র কৃষ্ণনগরের নৃপতি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নদীয়ায় যে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন শুরু, আজ জমিদার,ব্যাবসায়ী বণিকদের ঘরে সেই দেবী পূজিতা হচ্ছেন ভক্তির উন্মাদনায়। বারোয়ারী প্রবণতাও দেবীর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তবে সিংহবাহিনী যে দেবীর প্রচলন, আদপেও তা আগে ছিল না। বাঙালি সিংহ চোখেই দেখেনি, তো সিংহ রূপ পরিকল্পনা করবে কি করে? তাই বাঘের মত দেহ আর ঘোড়ার মত মুখ জুড়েই বাহন রূপ নিবেদন করত। কিন্তু নরসিংহ বলার কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো শাস্ত্রে বলা হয়, মহিষাসুর যখন হস্তীরূপ ধারণ করেন, দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে বধ করেন। কোনো শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মহিষাসুর বধের পর দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে মহিষাসুর পুত্রকে বধ করেন। আবার মার্কন্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে অসুর সেনাদের বধ করেন। পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় যতই মতানৈক্য থাকুক , ভক্তদের ভক্তির অভাব হয়নি। আবার যুক্তিবাদের নিরিখে বলা হয়, দুর্গা বা জগদ্ধাত্রী আসলে আর্য সংস্কৃতির ধারক। হস্তীরূপী অসুর বাংলার অনার্য জাতির প্রতীক। ব্রাহ্মণী হিসেবে দেবীর পুজো ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচারের অঙ্গ। আর্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে অনার্য সংহার। কূর্মপুরাণে ঐরাবতের উত্থান সমুদ্র মন্থন থেকে বললেও মাতঙ্গলীলা গ্রন্থে বলা হয়েছে, হিরণ্যগর্ভ থেকে ব্রহ্ম অন্ড ভেঙ্গে জগৎ সৃষ্টি করেন। সেই অন্ডের দক্ষিণ ভাগ থেকে নির্গত হয় পুরুষ হাতি ঐরাবত, পুণ্ডরিক, বামন, কুমুদ, অঞ্জন পুষ্পদন্ত, সার্বভৌম ও সুপ্রতীক। অন্ডের বাম অংশ থেকে উৎপন্ন হয় আটটি নারী হস্তী- অভ্রামু, কপিল, পিঙ্গল, অনুপমা, তাম্রকর্ণা, শুভ্রদন্তী, অঙ্গন ও অঞ্জনাবতী। এঁরা দেবরাজ ইন্দ্রের পূর্ব, অগ্নির দক্ষিণপূর্ব, সূর্যের দক্ষিণ পশ্চিম বা নৈঋত, বরুণের পশ্চিম বায়ুর উত্তর পশ্চিম কুবেরের উত্তর ও চন্দ্রের উত্তর পূর্ব বা ঈশানকোণের দ্বাররক্ষক। এহেন জগদ্ধাত্রী পুজো আজও বনেদি বাড়ির ঐতিহ্য। বনেদী বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে জগদ্ধাত্রী আজ বারোয়ারি হয়ে উঠেছেন বণিকের হাত ধরেই।। চন্দননগরের চালপট্টির পূজোই যে সর্বপ্রথম তার প্রমাণ দাবি করে।

দাঁ বাড়ির দালানে ভক্তদের দেবীদর্শন।

বনেদি কলকাতার সুতানুটি শোভাবাজারের এক আলাদা ঐতিহ্য আছে।এমনই এক পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো শোভাবাজার বি কে পাল এভিনিউ সংযোগস্থলে অমৃত লাল দাঁ ট্রাস্টির বাড়িতে। প্রাচীন বনেদিয়ানা বজায় রেখে বাড়ি নিয়মিত সংস্কার করে এবারেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫৮ তম বর্ষের দুর্গাপুজো। একইভাবে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে এস ওয়াজেদ আলীর শব্দগুচ্ছের মর্যাদা দিয়ে। দাঁ বাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৭৮ বছরের জগদ্ধাত্রী পট্রাস্টির প্রধান সদস্য অমরনাথ দাঁ জানান,, এই বাড়িতে দুর্গাপুজো, লক্ষ্মী পুজো,কালীপুজোও হয়। তাই দেবী আরাধনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই ।

দাঁ পদবীর এক ইতিহাস আছে। বাড়ির পূর্বপুরুষ অমৃতলাল দাঁর আদি নিবাস ছিল কোতলপুর। ছিল কিছু চাষের জমি। বর্গি হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে ভাগ্যের সন্ধানে প্রথমে আসেন ডোমজুড়ে গুরুগৃহে। এরপর উত্তর কলকাতায় এসে দুয়ারে দুয়ারে কেরোসিন তেল বিক্রি। শোনা যায় কেরোসিন তেলের অন্যতম ক্রেতা ছিলেন স্বয়ং ছোট লাট। নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় আয় বাড়ল। স্বচ্ছলতার মুখ দেখল অমৃত দাঁ পরিবার। ইতিহাস বলে, ষষ্ঠ শতক থেকে রাঢ়বঙ্গে গন্ধবণিক সমাজের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান , হুগলির বহু গ্রামে দাঁ পরিবারের বসতি ছিল। কবি মুকুন্দরামের সময় থেকে অর্থাৎ ১৬ শ শতক থেকে দাঁ উপাধিধারী গন্ধবণিকেরা নানা শাখা প্রশাখায় কলকাতা সহ বাংলা ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার প্রাচীন এক পদবি দাম। যা গ্রীক শব্দ দ্রাম্ম থেকে উৎপত্তি। এই শব্দের অর্থ মুদ্রা বা পয়সা।

আর জি কর কান্ডে পারিবারিক প্রতিবাদ দাঁ বাড়ির।

ইতিহাসবিদের ধারণা, প্রাচীন যুগে ব্যাক্ট্রিয়ান গ্রিকরা যখন গান্ধারপ্রদেশে পদার্পণ করে, তখন কোনো মুদ্রা নির্মাণের কারখানা ছিল না এদেশে। এরপর সিন্ধু নদ পেরিয়ে ভারত তথা বাংলায় আসে গ্রিকরা। স্থানীয় ব্যাবসায়ী গোষ্ঠী ও রাজাদের দায়িত্ব দেয় মুদ্রা নির্মাণের। বাঙালি রাজা ও মুসলিম নবাবরা স্থানীয় একদল কুশলীদের ধাতু পিটিয়ে মুদ্রা নির্মাণের দায়িত্ব দেন। পরবর্তীকালে কুশলী মুদ্রা নির্মাণকারী হিসেবে এঁরা উপাধি পান দাম।দামের অপভ্রংশ দাঁ। এই তথ্যের আভাস মেলে যখন এই পরিবারের মূর্তি পরিকল্পনায় দেখা যায় দেবীর দুই পুরুষ প্রতিহারী জুতো পায়ে। অর্থাৎ হিন্দুত্বের অধীন বিদেশি ভৃত্য। পদবীর উৎপত্তি যেভাবেই হোক, এই দাঁ পরিবারের বর্তমান অগ্রজ পুরুষ অমর নাথ দাঁ এখনও পরিবারের শরিকি সহযোগিতায় বনেদিয়ানা বজায় রেখে যেভাবে পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে উৎসব পার্বণ পালন করে আসছেন, সেটা শুধু ঐতিহ্য রক্ষা নয় ,– বলা যায় ঐতিহাসিক সংরক্ষণ। এস ওয়াজেদ আলীর ভাষায় বলাই যায়,, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *