থ্রি ইডিওটসের নায়ক রিয়েল লাইফের পরিবেশকর্মী অনশনে কেন? মোদীর ফেক গ্যারেন্টি?

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: দেশ জুড়ে এখন লোকসভা নির্বাচনের দামামা বাজছে। রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন ভোট দিয়ে যা আয় ভোটাররা রা, ধান ভাঙলে কুড়ো দেব, মাছ কাটলে মুড়ো । সংখ্যাবিদরা চুল চেরা বিশ্লেষণ করছেন আব কি বার চারশ পার কতটা সত্যি কতটা জুমলা। জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার আবার একটা সুযোগ পেতে চলেছেন। স্বাধীনতার (?)৭৬ বছর পর আজও লোকসভার নির্বাচনে দাবি, পানীয় জল। রাজা বলেন অনুদান দেব, রাণী বলেন শ্রী দেব। আমরা ভোটরঙ্গে এতই মজে যে দেশের আরেক প্রান্তে পরিবেশ নিয়ে কি ঘটছে জানার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। বলিউডে ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুপার হিট আমীর খান অভিনীত থ্রি ইডিয়টস ছবির কথা মনে আছে? রাঞ্চো চরিত্রে ছিলেন আমীর। বাস্তবে পরিবেশবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক সোনম ওয়াংচুকের জীবনী অবলম্বনে।

বিজ্ঞাপন

    শুধু নুন জল পান করে ২১ দিন ধরে অনশন করলেন তিনি। অনশন শুরু করেছিলেন ৬০০ মানুষকে সঙ্গী করে। এরপর তার সঙ্গে যোগ দেন লাদাখের প্রায় ৬ হাজার মানুষ। মাইনাস ৪ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ১৫ ডিগ্রির শৈত্য প্রবাহে খোলা আকাশের নিচে অনশনে থেকে ওয়াংচুক লাদাখবাসীকে বলেছেন, দেশের স্বার্থে বিবেচনা করে ভোট দিন। কিসের বিবেচনা? ওয়াংচুক ও লাদাখবাসীদের ক্ষোভ গত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মোদী লাদাখবাসীদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন , সেটা রাখেননি। মোদী সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। লাদাখকে দেওয়া হবে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা। কেউ কথা রাখেনি। মোদী সরকারও কথা রাখেনি। সুতরাং এবারের ভোটে মোদীর পরিবার জনগণের পরিবার দাবি করে যে গ্যারেন্টি দেওয়ার কথা মোদী বলছেন সেটি অমিত শাহের ভাষায় জুমলা নয় তো ? ওয়াংচুক অনশন ভঙ্গের ২১ তম দিনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা এক বার্তায় লিখেছেন, মোদীজি আপনি রাম ভক্ত। তাই তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা উচিৎ নয়। প্রাণ যায় পর বচন না যায় রাম চরিত মানসে লেখা কথাগুলি বিজেপিকে মনে করিয়ে দিতে চাই। মোদীজি আপনি ও অমিত শাহ শুধু রাজনৈতিক নেতা নন। আপনাদের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে ভাবতে চাই। এরজন্য আপনাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা হওয়া দরকার।

             ওয়াংচুকের স্পষ্ট বক্তব্য লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত করে রাখায় দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ছে। লাদাখের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাব লাদাখবাসীদের অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনছে। কি সেই সংকট? খতিয়ে দেখা যাক। নবম শতাব্দীর আগে লাদাখের সঠিক ইতিহাস জানা যায় না।৯৫০ খ্রিস্টাব্দের সময তিব্বতীয় সাম্রাজ্যের পতনের পরে সীমান্ত অঞ্চলগুলি স্বাধীন রাজ্য হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ তিব্বত রাজ্য পরিবারের বংশ থেকে। এরপর কেটেছে কয়েকশ শতাব্দী। উনিশ শতকের শুরুতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে শিখ শাসন । জম্মুর ডোগ্রা অঞ্চল থাকে রাজপুত শাসকদের অধীনে। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের ডোগ্রা শাসক হরি সিং অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে শর্ত সাপেক্ষে সই করায় কাশ্মীরের কিছু অংশ পাকিস্থানের দখল মুক্ত হয়।১৯৭০ থেকে লাদাখের মানুষ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দাবি করে।১৯৮৯ সালে লাদাখের বৌদ্ধ ও মুসলমানদের হিংসাত্মক দাঙ্গা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে লাদাখ স্বায়ত্বশাসিত পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদ তৈরি। এলাকার বৌদ্ধরা বিজেপি কে সমর্থন করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের সুবিধে পেতে চান।৩১ অক্টোবর ২০১৯ একটি আইন মোতাবেক জম্মু কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাদাখ আলাদা একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়। অঞ্চল শাসনের অধিকার বর্তায় এক লেফট্যানেন্ট গভর্নরের ওপর।

বিজ্ঞাপন

           কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর লাদাখের জনগণ মনে করেন তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়েছে। এমনিতেই চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে লাদাখের মানুষের জীবনে।৩৭০ ধারা বিলোপে লাদাখের স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার খর্ব হওয়ায় কার্গিলের সিয়া মুসলমানরা প্রতিবাদ করলে বৌদ্ধরা সমর্থন করেন। সংসদে এখন একজন প্রতিনিধি। ফলে এলাকায় ব্যাপক বেকারত্ব সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষার কোনো আইন না থাকায় মুসলমান ও বৌদ্ধ দুই সম্প্রদায় তাদের জীবনযাত্রার মান পুনরুদ্ধারের জন্য ও বিশেষ সুরক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে।২০১৯ এর নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি ষষ্ঠ তফসিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও জেতার পর ভুলে যায়। ইতিমধ্যেই ভারতে বেকার স্নাতকের সংখ্যায় লাদাখ গত দুই আর্থিক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। লাদাখে বসবাসকারী নটি উপজাতি। বাল্টি, বেদা, বট, ব্রপকা, দর্দশিন, চাংপা, গারা, সোম ও পুরিগপা। তাঁরা লাদাখি, উর্দু, পুরগি ব্রোকস্কাট , বাল্টি, পুরগি, শিনা জানা স্কারি ভাষায় কথা বলেন। বৌদ্ধরাও এখন আর কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল চাননা। চান স্বায়ত্ত শাসন। লাদাখে এখন মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় হাত মিলিয়ে লাদাখে গণতন্ত্র চাইছেন।

বিজ্ঞাপন

      লাদাখের মানুষ ক্রুদ্ধ অমিত শাহের ওপর। কেননা তিনি স্পস্ট জানিয়ে দিয়েছেন লাদাখের রাজ্য মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ষষ্ঠ তফসিলের দাবি মানা। কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বানিয়ে ভুল হয়েছে। এরপরই আন্দোলনের নেতা সাজ্জাদ কারগিলির নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন সমর্থন করে ২১ দিনের অনশন করলেন পরিবেশবিদ ও শিক্ষাবিদ ওয়াংচু। লাদাখ বাসীদের ষষ্ঠ তফসিল দাবির কারণ মিজোরাম মেঘালয় ত্রিপুরা ও অসমে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী জাতিসত্তা সাংস্কৃতিক পরিচয় ও পরিবেশ রক্ষার জন্য ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা পায় । কিন্তু লাদাখের ৯৫ শতাংশ উপজাতি হওয়া সত্বেও সেই দাবি মানা হচ্ছে না। বহিরাগতরা এসে যত্রতত্র শিল্পায়নের নামে লাদাখের পরিবেশ দূষণ করছে। জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশন ষষ্ঠ তফসিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করলেও কথা দিয়েও বিজেপি শাসক এখন অস্বীকার করছেন কেন, কি রহস্য সেটাই জানতে চায় লাদাখবাসী।
ইতিমধ্যেই কলকাতার পর্বতরোহী ওপরিবেশ কর্মীরা কলকাতায় ওয়াংচুকের সমর্থনে অনশন করেনঃ ১৯ দিন ধরে। নদী বাঁচাও , জীবন বাঁচাও সংগঠনের আহ্বায়ক তাপস দাস বলেছেন, বাস্তুশাস্ত্র জীবনের জন্য অপরিহার্য। লাদাখে হিমবাহ ধ্বংস হলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হলে বাংলাতেও তার প্রভাব পড়বে। যোশী মঠের বিপর্যয কি আমরা ভুলে গেছি?

     সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় , বাংলার রাজনৈতিক নেতারা ভোট ভিক্ষায় ব্যস্ত। মিডিয়া ভোট নিয়ে মেতে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার এইআন্দোলন নিয়ে উদাসীন। এই মূহূর্তে মোদীজি বলেছেন ভারত আমার পরিবার । মোদী কি গ্যারান্টির কথা বলছেন। কিন্তু ২০১৯ এর নির্বাচনে লাদাখের মানুষের কাছে যে গ্যারেন্টি দিয়েছিলেন সেই গ্যারেন্টি কোথায় এই নিয়ে বিরোধীদের কোনো মন্তব্য নেই। একি অজ্ঞতা নাকি লাদাখের চেয়ে নির্বাচনে ক্ষমতা লাভ তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সত্য সেলুকাস ! কি বিচিত্র এই দেশ। জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রের প্রহসন চলছে। এর মধ্যে আশার কথা গায়ক রুপম এবং অরিজিৎ সিং বলেছেন,আমাদের আদর্শ শিক্ষাকর্মী ও পরিবেশকর্মী ওয়াংচুক । তাঁর আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *