বিষ্ণু উপাসকদের আগ্রাসনে পিছু হটলেন শিব - পর্ব: ৬

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আর্য দেবতা বিষ্ণুর উপাসকদের আগ্রাসনে অনার্য দেবতা শিব পিছু হটলেন কিভাবে সেই বিষয়টি দেখা যাক। পার্বত্য উপজাতির দেবতা শিব । তাই তাঁর বাসস্থান হবে হিমালয়ে, এটাই স্বাভাবিক।বলা হয় কেদারে তাঁর বাসস্থান। একসময় বলা হত শিবের বাস বৈদ্যনাথে। একবার নাকি শিব সেখানে ধ্যানমগ্ন হন। বিষ্ণু ছোট্ট ছেলের রূপ ধরে এসে শিব পার্বতীকে প্রশ্ন করেন তোমরা এখানে কি করছ? শিব জবাব দেন আমরা ধ্যান করছি। বালক ছদ্মবেশে বিষ্ণু বলেন, এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের। শিব অন্তর্যামী। বুঝলেন বিষ্ণুর ইচ্ছা। তিনি পার্বতীকে নিয়ে চলে গেলেন কেদারে। অনেকেই মনে করেন কেদার শিবেরই এক নাম। কিন্তু পুরাণ বলছে, রাজা কেদার ছিলেন সপ্তদ্বীপের রাজা। প্রজাবৎসল রাজা পুত্রদের হাতে রাজ্যের ভার দিয়ে চলে যান এক পর্বতে ধ্যান করতে। সেই পর্বতের নাম হয় কেদার। এই কেদার পর্বতেই আছে শিবের পঞ্চ মন্দির। পঞ্চ কেদার। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পঞ্চ পাণ্ডব শিবকে খুঁজতে কেদার এলেন পাপ স্খলনের জন্য। শিব পাপের ভাগী না হওয়ার জন্য লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু নারদ শিব কোথায় লুকিয়ে পঞ্চ পাণ্ডবকে বলে দেন। শিব নারদকে শাপ দিয়ে পাথর বানালেন। সেই পাথর গড়িয়ে পর্বত থেকে গড়িয়ে নিচে পড়তেই জলাশয়ে পরিণত হল। শিব এবার যে স্থানে আত্মগোপন করেন সেই স্থানের নাম হয় গুপ্ত কাশী। এখানে শিব মহিষ রূপে বিচরণ করলেও ভীম। বুঝতে পেরে পিছু নিলেন। শিব পর্বতের পাঁচটি গুহায় লুকিয়ে ভীমের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করলেন। সেই পাঁচ স্থান কেদার, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ , রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর। এই পাঁচ স্থানে পুরাণের বর্ণনানুযায়ী পড়ে মহিষের পাঁচটি অংশ। কেদারে মহিষের পশ্চাৎ অংশ, মদ মহেশ্বরে নাভি, তুঙ্গনাথে বাহু, রুদ্রনাথে মুখ ও কল্পেশ্বরে জটা। সেই মহিষের সামনের অংশ নেপালের পশুপতিনাথে। সেই কেদারের মন্দিরের অস্তিত্ব এখন নেই। কিন্তু আদি শঙ্করাচার্য পুরাণের মিথ বাঁচিয়ে রাখতে কেদারে এখনকার মন্দির নির্মাণ করেন।

আগেই বলেছি সেন সাম্রাজ্যের শুরু থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বাংলায় হ্রাস পেতে থাকে। অস্বীকার করার উপায় নেই শঙ্করাচার্যের আগ্রাসন অন্যতম কারণ। প্রমথ চৌধুরী ( প্রত্নতত্ত্বের পারস্য উপন্যাস প্রবন্ধ সংগ্রহ, বিশ্ব ভারতী ১৯৯৩ ) লিখেছেন,,,,,,, যাকে আমরা হিন্দু সভ্যতা বলি সেটি একটি অবার্চিন পদার্থ: বৌদ্ধ সভ্যতার পাকা বুনিয়াদের ওপর তা প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্ব নিম্নস্তরে যা পাওয়া যায় সে হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম।,,,,,,, তাই প্রত্মতত্ত্ববিদদের মতে পাটলিপুত্রই ( বর্তমান পাটনা) হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের কেন্দ্রস্থল।,,,, একাধারে জন্মভূমি এবং পীঠস্থান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গৌতম বুদ্ধকে সর্ব শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে ভুয়সী প্রশংসা করে, শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদ বৌদ্ধ দর্শনের সহায়তায় পরিপুষ্টি লাভ করেছে। এই অদ্বৈতবাদ ধারণাটি হচ্ছে একের মধ্যে বহু, বহুর মধ্যে এক। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, যে বৈষ্ণব ধর্ম একসময়ে বাংলায় গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল তাও বৌদ্ধধর্ম দ্বারা সঞ্জীবিত।,,, বৈষ্ণবদের রথযাত্রা,( জগন্নাথ, বলরাম, ও সুভদ্রা) উৎসবটিও বৌদ্ধ উৎসব। তাই বৌদ্ধ ধর্ম পতনের পর বৌদ্ধ মন্দিরই বৈষ্ণব দেবতার মন্দিরে পরিণত হয়। সাথে সাথে বুদ্ধের পদচিহ্নও বিষ্ণুর পদচিহ্নে রূপান্তরিত হয়।( বুদ্ধদেব: বিশ্বভারতী: ১৪০০)

ফিরে যাই বৌদ্ধ পতনের কারণ অনুসন্ধানে । শুধু শঙ্করাচার্যের আগ্রাসন নয়, বৌদ্ধ ধর্মের হীনযান, মহাযান বিভাজন, ইসলামের আগমন, সংঘের বিলুপ্তি, ভজন পূজনের অভাব, তন্ত্রের উত্থান, ভিক্ষু ভিক্ষুনী সমস্যা, নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এই প্রেক্ষাপটেই আর্যধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সফল হয়নি। অবশেষে সমঝোতা করতে হয় শৈব ধর্ম ( প্রাক আর্য) ও বৌদ্ধধর্মের ( আর্য পরবর্তী) সাথে। এ পর্যায়ে মহাদেব পুনরায় বুদ্ধের স্থান দখল করে নেন। বৌদ্ধ ধর্মটি পেছনে পড়ে যায়। হিন্দু ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই কথাটি এই প্রতিবেদকের নয়, বলেছেন অধ্যাপক ও বাংলার গবেষক ড: আর এম দেবনাথ তাঁর সিন্ধু থেকে হিন্দু।( পৃষ্ঠা ৮০) দেবনাথ লিখেছেন, পৌরাণিক আমলে ধীরে ধীরে মহাদেব তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে হিন্দুর মনে বদ্ধমূল হয়ে বসেন। তিনি হন কমপ্লিট গড। তাঁর সাথে যুক্ত হয় পার্বতী, উমা, গঙ্গা, দুর্গা, কালী। এঁরা কল্পিত হন শিবের স্ত্রী হিসেবে। সাথে যুক্ত হয় গনেশ ও কার্তিক। এঁরা শিবের পুত্র। কন্যাদের মধ্যে রয়েছেন মনসা ও লক্ষ্মী ইত্যাদি। শুধু এঁরাই নন শিবের পরিবারের সাথে পরবর্তীকালে যুক্ত হয় আরওঅসংখ্য লোকায়ত দেবদেবী। অবশ্য পাশাপশি গড়ে ওঠে আর এক ধারা। এই ধারা বিষ্ণুর ধারা আমরা জানি, আর্যদের দেবতা বিষ্ণুকে ভূমিপুত্রগ্রহণ করেনি। গত্যন্তর না দেখে তারা বৌদ্ধদের অবতারবাদের আশ্রয় নেয়। অবতার বাদের মাধ্যমে সৃষ্ট হয় কৃষ্ণ ও রাম। আমরা জানি রাম ও কৃষ্ণ উভয়ই বিষ্ণুর অবতার। তাদের ধারাই বর্তমানকালের বৈষ্ণব ধারা। নিরোদ চৌধুরীর মতে, এ ধারা উত্তর ভারতে শিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ধারা। মঙ্গলের ঈশ্বর হিসেবে শিব অবশ্য সেখানেও পূজিত। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে শিবই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা বা ঈশ্বর। আজকের দিনে সর্বশেষ অবস্থা কী? নানা সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে হিন্দুর প্রধান এ দুটো ধারা অর্থাৎ শৈব ও বৈষ্ণব ধারার মধ্যে পার্থক্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। এর অনুকরণে অন্যান্য অপ্রধান ধারা অর্থাৎ শাক্ত, গাণপত্য ও সৌর ইত্যাদি ধারার প্রভাবও হ্রাস পাচ্ছে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর ঐতিহ্য যেখানে সকল হিন্দু মিলেমিশে একাকার।( চলবে)

পর্ব ৬ /৭ আগামী শনিবার ১৩ এপ্রিল ও রবিবার ১৪ এপ্রিল ২০২৪ রাত ১১ টায়।
