শিব এলেন কোথা থেকে? পর্ব : ৭

পর্ব: ৭

বারাণসীতে বুদ্ধের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বারাণসী বা কাশী শিবধাম। রাম মন্দিরের পর এখন কাশীর মসজিদ ভাঙার তোড়জোড় চলছে। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার দাবি পূরণের চেয়ে চাহিদার উৎসমুখ ঘুরিয়ে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মভীরু মানুষকে ভিন্নপথে চালিত করা সোজা। কিন্তু শিবধামের আসল ইতিহাস কি? চোখ রাখা যাক বঙ্গদেশে ধর্মীয় সমাজ ইতিহাস ও বিবর্তন গ্রন্থে। লেখক ড,: আর এন দেবনাথ লিখেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি ইংরেজি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এর নাম বৌদ্ধইজম ইন বেঙ্গল সিন্স দি মুহামেডান কনকুয়েস্ট। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাংলা থেকে বৌদ্ধধর্মকে বিতাড়িত করা হয় অগ্নি ও তরবারির সাহায্যে। কুশিনগর এবং বারাণসীর প্রত্ন গবেষণায় তথ্য জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, সেখানে অর্ধরন্ধনকৃত অন্ন পাওয়া গিয়েছে। এর অর্থ ভিক্ষুরা ভাত রান্না করার সময়ও পাননি, পালাতে হয়েছে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ভয়ে। বখতিয়ার খিলজি বৌদ্ধ রাজধানী বিহারে মাথা নেড়া বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখে তাদের ব্রাহ্মণ ভেবে ভুল করেছিলেন, এবং তরবারি ব্যবহার করেছিলেন।

    বৌদ্ধদের নির্মূল প্রক্রিয়ায় বখতিয়ার খিলজি যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন ব্রাহ্মণরা তা করেননি। তাঁদের নির্যাতন প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন ধরণের। শাস্ত্রী বলেছেন, সেন রাজারা ব্রাহ্মণদের জমি দান করত বুদ্ধদেব বিহারের লাগোয়া স্থানে যাতে স্থায়ী ঝগড়া লেগে থাকে।বৌদ্ধদের নিন্দা করা ছিল আরেকটি পন্থা যা ব্রাহ্মণরা ব্যবহার করত! ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ছিল ব্যবহার ও আচরণগত। এটা ছিল দৈনন্দিন ক্রিয়া । বই লিখে নিন্দাবাদ করাও ছিল তাদের কাজ। এসবের পাশাপাশি, শাস্ত্রী বলছেন, বুদ্ধকে ব্রাহ্মণরা বিষ্ণুর অবতার বলে গ্রহণ করেন ( পৃষ্ঠা ২০২-২০৮)। এছাড়া যে পন্থাটি তারা গ্রহণ করে তা হচ্ছে আত্মস্থ করা। বৌদ্ধদের আচার অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণরা গ্রহণ করে নেন। বৌদ্ধদের তারা দেবী রথযাত্রা তাদের মঠ ও মন্দির ইত্যাদি ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আত্মসাৎ করে নেন। বস্তুত পক্ষে মহাযানী বৌদ্ধদের সবকিছুই আত্মসাৎ করে নেয় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম । যে মহাদেবকে ( শিব,) কেন্দ্র করে নাথ ধর্মটি প্রতিষ্ঠা হয় সেই শিবকেও তারা আত্মসাৎ করেন। তাঁকে দেবাদিদেব সম্মান দেওয়া হয়।( পৃষ্ঠা ৪৯)।

বখতিয়ার খিলজি হিন্দু ভেবে মুন্ডিতমস্তক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্য করেন।

বিজ্ঞাপন

বোঝার সুবিধের জন্য একটা উপমা টানা যাক। দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পান রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের পতি। পতি শব্দের অর্থ মালিক। কিন্তু সংসদীয় গনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শেষ কথা। তাঁর ইচ্ছাতেই সম্মতির সাক্ষরটুকু করবেন রাষ্ট্রপতি। সম্প্রতি একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতি। যাক। ফিরে আসি শিব প্রসঙ্গে। আজ বাদে কাল চড়ক। গাজন। আজ নীল ষষ্ঠী। নীলের পুজোর উপোষ করবেন মায়েরা সন্তান কামনায়। সন্তানের মাথায় বিশেষ করে পুরুষ সন্তানের মাথায় তালপাখার বাতাস করে ধান দূর্বা দিয়ে আশির্বাদ করেন। মজার কথা এই ধান -দূর্বা কিন্তু হিন্দু উপাচার নয়। আদিবাসী উপাচার। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব গ্রন্থে লেখক লিখেছেন,,, একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যায় এই সব ধারণা, বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান আদিম কৃষি ও গ্রামীণ সমাজের গাছ পাথর পূজা প্রজনন শক্তির পূজা, পশুপক্ষীর পূজা প্রভৃতির স্মৃতি বহন করে।,,,,, আমাদের নানা আচার অনুষ্ঠানে ধর্ম সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান ও ধানের গুচ্ছ ধান দুর্বার আশীর্বাদ কলা হলুদ সুপারি, পান, নারিকেল, সিঁদুর, কলাগাছ, ঘট, ঘটের ওপর আঁকা প্রতীক চিন্হ, নানা প্রকার আলপনা গোবর , কড়ি প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে।( পৃষ্ঠা ৪৭৯)।

গাজন উৎসব শিবের ব্রত হিসেবে পরিচিত হলেও ব্রাত্য লৌকিক অহিন্দু উৎসব ঐতিহাসিক সত্য।

নীহাররঞ্জন রায় শিব সম্পর্কে লিখেছেন শ্মশান প্রান্তর পর্বতের রক্ত দেবতা একান্তই দ্রাবিড় ভাষীদের শিবন যাহার অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র ,ইনী ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্য দেবতা রুদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান। পরে শিবন, শিব শেম্বু শিব রুদ্র শিব ও মহাদেবে রূপান্তর লাভ করেন। এবার গাজন ও চড়ক উৎসবে ফিরে আসি। চক্ষু চড়ক গাছ হলেও কিছু করার নেই। চড়ক বা গাজন না শিবের উৎসব না হিন্দু উৎসব। ইতিহাস তাই বলছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক হলেও প্রথমে গাজন । আবার গাজন বলার আগে বলতে হয় নীল ষষ্ঠী। পুরাণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞে পতির অপমানে দেহত্যাগ করেন পার্বতী সতী। জন্মান্তরকে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয় পার্বতী জন্ম নেন বিল্ব বনে নীলধ্বজ রাজার কন্যা হয়ে। শিবভক্ত কন্যা নীলাবতী বিয়ে দেন রাজা নীলকণ্ঠ শিবের সঙ্গে। এই দিনে শিব ও নীলাবতীর বিয়ে হয়। প্রশ্ন করতে পারেন চৈত্র মাসে হিন্দু বিয়ে? আগেই বলেছি শিব বা পাহাড়ের মানুষদের হিন্দু বলার ঐতিহাসিক তথ্য নেই। শোল মাছ পুড়িয়ে শিব ভক্তরা অষ্টক গান ( মহাদেব নীলাবতীর বিয়ের গান) করেন বাসরঘরে নীলাবতী মহাদেবকে মোহিত করে তাঁর তাণ্ডব নৃত্যকে রূদ্ধ করেন। শিবের রোষ থেকে বাঁচতে মৌমাছি রূপ ধরে ফুলের রেণু পায়ে মেখে জলে নেমে ডুবে মারা যান। সেই নীলাবতীর ও শিবের আরাধনা করে সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করে মায়েরা ব্রত পালন করেন। এতো হিন্দু পুরাণ। ইতিহাস কি বলছে? (চলবে)

বিজ্ঞাপন

পর্ব : ৮ আগামীকাল রবিবার ১৪ এপ্রিল , রাত এগারোটায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *