
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: পর্ব ৯ এর শেষে জানিয়েছিলাম শৈবপন্থীদের চড়ক একটি লৌকিক প্রথা। আসলে যা জমিদারদের খাজনা না দেওয়ার শাস্তি। শাস্তি কি করে শৈব ধর্মের ঐতিহ্য হয়ে গেল? এ এক জটিল তত্ত্ব। প্রথমে প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়া যাক। ড,: সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে ( দি ইন্ডিয়ান থিয়োগণি , ব্রহ্মা , বিষ্ণু, অ্যান্ড শিব , পেঙ্গুইন বুকস , ইন্ডিয়া,২০০০) এ বলেছেন, হিন্দুদের তীর্থযাত্রা ছিল আদিতে যজ্ঞ। বৈদিক রীতির যজ্ঞ হিন্দু ধর্মে ঢুকে গেলেও যজ্ঞের হোতা ব্রাহ্মণ।সুকুমারী ভট্টাচার্যের গবেষণায় ভারতীয় দেবতাদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এক) শিব ও শিব সংশ্লিষ্ট দেবতামন্ডলী এবং বিষ্ণু ও বিষ্ণু সংশ্লিষ্ট দেবতামন্ডলী । শিব শিবিরে স্থান পেয়েছেন মাতৃদেবী সকল , যম – যমী, কার্তিক, গনেশ, রুদ্র শিব, উমা অদিতি, লক্ষ্মী। বিষ্ণু শিবিরে বৈদিক দেবতা সূর্য, সাবিত্রী, মিত্র, ভগ, অশ্বিন , ইন্দ্র ও কৃষ্ণ। সুকুমারী বলেছেন, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আধুনিক যুগে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মত জোট তৈরি হয়েছে। এই সমঝোতা ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে। শিব শিবিরের দেবতা দেশজ।বিষ্ণু শিবির বহিরাগত।বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিশরণ ধারণা বৌদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণম গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি আত্মসাৎ করা হিন্দুরা আত্মসাৎ করে ত্রিদেব ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবকে একাসনে বসিয়েছে। দক্ষ যজ্ঞের ঘটনা সবাই জানেন। পিতৃ পরিচয় না থাকায় শিব আমন্ত্রিত হননি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইতিহাস , বিশ্বভারতী,১৩৮৬, গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতবর্ষে সামাজিক মিলন ঘটে ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রিমূর্তি কল্পনায়। রবীন্দ্রনাথের কথায় শিব শিব রূপে থেকে গেছেন।কিন্তু বিষ্ণু জনপ্রিয় হলেন রাম ও কৃষ্ণ রূপে।এর থেকেই হরিহর আত্মা। অর্থাৎ কায়দা করে বিষ্ণু ও শিবকে একসঙ্গে রাখা হলো। তবে গুরুত্ব কিন্তু বিষ্ণুতেই রাখা হল। শতহলেও আর্য দেবতা। রাম চন্দ্র বিষ্ণুর অবতার। হনুমানকে বলা হয়েছে শিবের অবতার। প্রভু রাম । সেবক হনুমান। আধুনিক যুগে রামকৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। শিষ্য বিবেকানন্দ কে বলা হয় শিবের ও অবতার।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনা , রামকৃষ্ণ মঠ গ্রন্থে লিখেছেন , বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই পৌরহিত্য ও প্রতিমা পূজার সৃষ্টি।তিনি এও বলেছেন পুরীর জগন্নাথ মন্দির বৌদ্ধ মন্দির। যাঁরা বাংলাদেশে থাকেন তাঁরা জানেন ঢাকার স্বামীবাগের শিব মন্দির সহ অন্যান্য শিব মন্দিরকে ইসকন কৃষ্ণ মন্দিরে পরিণত করেছে। ঐতিহাসিক ও গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দুরা শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নষ্ট করেই ছাড়েননি তারা দুহাতে বৌদ্ধের ভাণ্ডার লুণ্ঠন করে সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের উপর নিজনিজ নামাংকের ছাপ দিয়ে সর্বতোভাবে নিজস্ব করেছেন। বৌদ্ধ ইতিহাস ব্রাহ্মণেরা স্বেচ্ছায় ও ঘোর শত্রুতা করে লুপ্ত করেছেন। তবে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম থেকে হিন্দু বানানোর পরিকল্পনা সহজে যেমন হয়নি তেমন সময়ও লেগেছে প্রচুর।বাঙালি বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তিতে নিরভর করেন লৌকিক দেবতা ধর্ম ঠাকুরের। ধর্ম ঠাকুরকে তাঁরা কল্পনা করেন বৌদ্ধ মতের স্তূপ ধারণা থেকে।রায় স্তূপ অনেকটাই কচ্ছপের পিঠের খোলার মত। অবশ্যই সেটি গড়া হত বট অশ্বত্থ গাছের নিচে। ধীরে ধীরে আর্যকরণ শুরু বাংলায়। পূর্ববঙ্গে ঢাকা জেলার সাভারের হরিশচন্দ্র রাজা ছিলেন বৌদ্ধ রাজা। তাঁকে পৌরাণিক গল্পে স্থান দিয়ে বানানো হল হিন্দু। বৌদ্ধ স্মৃতি মুছে দেওয়া হল।
বিজ্ঞাপন


দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে লিখেছেন কি ভীষণ অত্যাচারের সহিট ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ভারত হইতে নির্মূল করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন, টাহা শঙ্কর বিজয় নামক পুস্তকে লিখিত আছে।,( পৃষ্ঠা ৯) তিনি লিখেছেন , বৌদ্ধরাই নির্যাতিত হননি। হয়েছেন আরো অনেক শ্রেণীর নানা মতের লোক ছিলেন যাঁরা ছিলেন প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। তাহাদের কাতর প্রার্থনায় ধর্মের ( বুদ্ধের) আসন টলিল, তিনি তাহাদিগকে রক্ষা করিতে প্রস্তুত হইলেন। ধর্ম যবনরূপী হইয়া মাথা য় টুপি পরিয়া কামান হাতে লইলেন। দেবতাগণ ইজার পরিয়া ব্রাহ্মণদের বিরূদ্ধে অভিযান করিলেন। ব্রহ্মা মোহাম্মদ হইলেন, বিষ্ণু পয়গম্বর, এবং আদম শিব হইলেন। দীর্ঘ তালিকায় গণেশকে গাজী কার্তিককে কাজী, ঋষিগণকে ফকির এবং ইন্দ্রকে মৌলানা রূপে দেখিতে পাই ( পৃষ্ঠা ৯-১০/)

ধারাবাহিক এই প্রতিবেদনের ইতি টানব চড়ক আসলে জমিদারদের শাস্তি এই তথ্য দিয়ে। জমিদাররা চৈত্রের সংক্রান্তিতে প্রজাদের খাজনা জমা দেওয়ার শেষ দিন ধার্য করতেন । পূর্ববঙ্গে ফি বছর বন্যা খরা লেগে থাকত। থাকত ঘূর্ণিঝড়। খাজনা দিতে না পেরে বহু চাষী আত্মহত্যা করত। মহাজনরা পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে জোর করে আদায় করত খাজনা। জমি বসত বাড়ি কেড়ে নিত। লৌকিক চড়ক প্রথাকে ব্যবহার করে জমিদাররা চাষীর পিঠে বড়শি গেঁথে চড়কে ঘোরাত।১৮০০ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত এই শাস্তি দিত,। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ এই প্রথা বন্ধ করার প্রয়াস করেও ব্যর্থ হয়। রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর এই প্রথা প্রথম শুরু করেছিলেন। মজার কথা ভূমিপুত্র নিম্ন বর্ণের চাষীদের শাসন করতে সেই সম্প্রদায়ের মানুষকে লাঠিয়াল করে রাখতেন জমিদারেরা। চড়কে বড়শি গেঁথে খাজনা দিতে অপরগদের ঝুলিয়ে বাকি প্রজাদের বোঝানো হত খাজনা না দিলে কি হয়। লৌকিক দেবতা ধর্ম শিবে পরিণত মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়। আজও চড়কের প্রথা একদিকে যেমন লৌকিক প্রথা তেমন জমিদারদের নৃশংস শাস্তির বিধানকে স্মরণ করায়।( শেষ)

বিজ্ঞাপন
