পর্ব: ৩ শৈব অঘোর যোগীরা দোল খেলেন মানুষের চিতা ভস্ম মেখে, কি সেই অঘোর রহস্য?
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : এই পর্বের বিষয়ে জানার আগে শিবের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে নেওয়াটা দরকার। প্রথমে চলুন প্রয়াত যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ প্রবীর ঘোষ শিব সম্পর্কে তাঁর অলৌকিক নয় লৌকিক গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে শৈব ধর্ম ও তন্ত্র শিরোনামে কি লিখেছেন। বৌদ্ধ ধর্ম আগে এসেছিল, না পাশুপত ধর্ম? উত্তর খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে মহাভারতের রচনাকালী দিকে। মহাভারতের আনুমানিক রচনাকাল খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক। শান্তিপর্বে লেখা হয়েছে বুদ্ধের মৃত্যুরও কয়েকশ বছর পরে। ফলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, পাশুপত ধর্মে বুদ্ধের প্রভাব ছিল। পাশুপত ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের যেমন মিল আছে ,অমিল তেমন আছে। বৌদ্ধ ধর্ম নৈতিক অনুশাসনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। পাশুপত ধর্ম যোগ ও তন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। বৌদ্ধ ধর্ নিরীশ্বরবাদী। পাশুপত ধর্মে ঈশ্বর আছেন। সেই ঈশ্বর হলেন শিব।,,,,,, এখনও মন্দিরে মন্দিরে যোনি ও লিঙ্গের যুগল মূর্তিতে পুজো করা হয়। প্রাক আর্য যুগ থেকে গুপ্ত সম্রাটদের যুগের ( ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) শিব লিঙ্গের সঙ্গে যোনি যুক্ত ছিল না। লিঙ্গ ও যোনি পৃথক পৃথক মূর্তিতেই পুজো হত। শিব পুজোর বা লিঙ্গ পুজোর সঙ্গে তন্ত্র জড়িত হওয়ারই ফল হিসেবেই যোনি মধ্যে লিঙ্গ যুক্ত করে পুজোর শুরু। ঋক বেদে শিব নেই। আছে লিঙ্গ পুজোর নিন্দে। যজুর্বেদেও শিব অনুপস্থিত। অথর্ববেদে পশুপতি ও মহাদেব নামের দুই দেবতাকে আমরা পেলাম। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আমরা শিব নামটিই পেলাম, তবে রুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করে।( পৃষ্ঠা ২১৩,২১৪)
বিজ্ঞাপন
প্রবীর ঘোষ এই প্রসঙ্গে আরও লিখেছেন, মহাভারতের শান্তি পর্বে আমরা শিবের নাম পাচ্ছি, যিনি পাশুপত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশুপতধর্মের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হল _ কার্য, কারণ, যোগ, বিধি ও দুঃখান্ত। পাশুপতপন্থীরা কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন যোগ সাধনায়, নিয়ম বিধি পালনে। বিশ্বাস করেন দুঃখ আছে, তার নিবৃত্তির উপায়ও আছে। পাশুপত ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের একটি মিল দুই ধর্মেই জাত পাতের ভেদ নেই। পাশুপত ধর্ম অনুসারে দুঃখের নিবৃত্তি করা যায় দুটি পথে।১) ২) বিধি। বিধি বলতে বলা হয়েছে শরীরে ছাই মাখবে, ছাইয়ের গাদায় শোবে, হাসবে, গাইবে, নাচবে, জেগে থেকে ঘুমোবার ভান করবে, শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গকে কাঁপাবে, মেয়েদের দেখলে আদিরসাত্মক শারীরিক ভঙ্গি প্রদর্শন করবে । এমন সব আচরণ করবে, যায় সাধারণ মানুষ পাগল বলে মনে করে। এঁদের আমরা দেখতে পাই কুম্ভমেলায় নাগা ( নাঙ্গা) সন্ন্যাসীরূপে ।( পৃষ্ঠা ২১৪)
নাগা সন্ন্যাসী সম্পর্কে প্রবীর ঘোষের বয়ান বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্যে শিব সম্পর্কে কিছু কিছু কথা লেখা আছে। এসব পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না নিম্নবর্গের মানুষদের দেবতা শিবের প্রতি তাদের বিরূপতা ছিল স্পষ্ট। ভাগবত পুরাণে শিবকে তমোগুণের আধার, উন্মাদ ও উন্মাদদের প্রিয়, স্মশানচারী, বাঁদরের মত চোখ, কাজকর্মহীন, দিগম্বর, জটাধারী, চিতা ভস্মে স্নানকারী, মুন্ডুমালা ধারণকারী, অমঙ্গলকারী ইত্যাদি বলে ধিক্কার জানানো হয়েছে। ঋকবেদের কেশীসূক্তে বলা হয়েছে শিব পূজকরা ধুলো ছাই মাখা মলিন বস্ত্রধারী, দীর্ঘকেশধারী উন্মত্তপ্রায় এক শ্রেণীর মুনি। এই শিব পূজকরাই আজকের নাগা সন্ন্যাসী। কুম্ভমেলা থেকে সাগরমেলা সর্বত্রই এরা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। এরা মেলায় ভি আই পি। অসাধারণ এদের দাপট। নগ্ন শরীরে ছাই মাখা। মাথার জটা ধরা দীর্ঘ চুল। চোখ সবসময়ই নেশায় টকটকে লাল। এরা দামী এসি লাগানো তাঁবুতে থাকে। কানে ওয়াকম্যান। দামী মোটর বাইকে ছুটে বেড়ায়। সুন্দরী তরুণী দেখলে লিঙ্গ প্রদর্শন করে প্রকাশ্যে অশ্লীল আহ্বান জানায়। স্নানের যোগে বা মূহুর্তে এদের স্নানের অধিকার সবার আগে। অশ্লীল বেপরোয়া এইসব মানুষগুলোকে দেখে ভক্তি গদগদ হন মন্ত্রী থেকে আমলা ও তাদের পরিবারের লোকজন।
বিজ্ঞাপন
এদের পাবলিক নুইসেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ধরার কেউ নেই। আসলে ধর্মের নামে যে কোনো আইনই বোধহয় এদেশে ভাঙা যায়। শিবঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে।, (পৃষ্ঠা ২১৭) অঘোরপন্থী শৈব সাধক প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর প্রকাশিত হয় এই সময় দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রতে। লেখক পিনাকী সেন। তিনি লিখেছেন অঘরিদে সাধন পথ তান্ত্রিক, কাপালিকদের মতোই। তাঁদের কাছে পৃথিবীর কোনও কিছুই অপবিত্র নয়। এই অঘরিরা যে জীবনযাপন করে, সেটা হয়তো আমাদের কাছে খুব অপবিত্র। কিন্তু সেটা তাঁরা করে থাকেন খুব সচেতনভাবেই। বস্তু জগতের কোনো কিছুর প্রতিই তাঁদের মায়া বা মোহ নেই। নিজেদের মলমূত্র তাঁরা যেমন খেতে পারেন, তেমনই পারেন শবদেহ থেকে মাংস খেয়ে নিতে। ভালো মন্দ সবকিছুতেই তাঁরা ঈশ্বর দেখতে পান। অঘরিরা আসলে শৈব। শিবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেন কালী। কালীই শক্তির উৎস। একটি মত অনুযায়ী কালী থেকে উৎসারিত এই শক্তি থেকেই বিশ্বের সব কিছুর উৎপত্তি। আর শক্তির মধ্যে তো একযোগে মিলে থাকে ভালো আর মন্দ। শিব কালীর এই যুগলবন্দী তাই পরিপূরক। একই সঙ্গে লালন আর বিনাশ, সদয় আর নির্মম। জীবন আর মৃত্যু সবই একক, ভৈরব আর কালীর সংযোগ।
পিনাকী সেন লিখেছেন প্রতিটি অঘরিই তাঁর সাধন ক্রিয়ার জন্য বেছে নেন গভীর রাত। অন্ধকার যখন চরাচর ঢেকেদেয় , কোলাহল স্তব্ধ করে প্রতিটি প্রাণী যখন নিদ্রামগ্ন, তখন শুরু হয় তাঁদের সাধনা। এঁদের সাধনপীঠ হয় শবদেহ। যার ওপর বসেই এঁদের ধ্যান শুরু হয়। সামনের জ্বলন্ত চিতা আর উড়তে থাকা ছাই প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় শেষপর্যন্ত কোন গন্তব্যে পৌঁছোতে চলেছে। কিন্তু শবদেহ ভক্ষণ বা মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গমের কি কোনও অর্থ আছে?
পিনাকী সেন আর কি লিখেছেন , সেই প্রসঙ্গে বলার আগে দেখব মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সঙ্গম সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলছে। অঘরি তন্ত্রে মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সঙ্গম একটি তন্ত্রাচার বলা হয়। যা সাধন মার্গের একটি পথ। বিজ্ঞান বলছে মৃতদেহের সঙ্গে যৌনতা একটি মানসিক বিকৃতি। এই রোগটির নাম নেক্রোফেলিয়া। গ্রিক শব্দ নেক্রো মানে মৃতদেহ। ফেলিয়া শব্দের অর্থ সম্মোহিত। মনস্তত্ত্ব বিভাগের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী জোনাথন পি রসম্যান এবং ফিলিপ যে রেসনিক বিশ্ব সাহিত্যের কিছু কাহিনী ও ৩৪: টি অপ্রকাশিত কেস পর্যালোচনা করে নাইক্রোফিলিক ক্রিয়াকর্ম ও অলীক কল্পনার উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেন। বিজ্ঞানীর এই অসুখের তিনটি ধরণ চিহ্নিত করেছেন। নেক্রোফিলিক, হোমিসাইড, রেগুলার নেক্রোফেলিয়া। এই দুই বিজ্ঞানীর সূত্র, এ ধরনের আচরণের শিকার যারা তারা মৃতদেহের কাছাকাছিথাকতে পছন্দ করে। এমন কিছু পেশা নেয়, যা মৃতদেহের সঙ্গে সম্পর্ক। সমীক্ষা বলছে সাধারণত মর্গে যারা কাজ করেন এমন পুরুষদের একাংশ মর্গে থাকা কোনো সুন্দরী মহিলার মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হয়। অতিরিক্ত মদ্য বা মাদকে আসক্ত থাকায় এই মানসিক বিকৃতির মানুষেরা এমন এক ঘোরে থাকে যে মৃতদেহের সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের দেশের তান্ত্রিক অঘরিরাও শ্মশানে সাধনা করেন। অনেক সময় গরীব পরিবার মৃতদেহ শ্বশানে নিয়ে এসে অঘরিদের কাছে বিক্রি করে দেন। অঘরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার পর সেই মৃতদেহের মাংস দেশি বা বিদেশি মদের সঙ্গে খায় তৃপ্তি করে।
অধ্যাত্মবাদে সাধনায় দরকার মনঃসংযোগ। সেটা আনতে মাদক। বিশেষত গাঁজা। হিন্দু শাস্ত্রে শিব তাই গাঁজায় আসক্ত। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে থেকেই গাঁজার চাষ হচ্ছে। বেদে পুরাণে বলা হয়েছে, সমুদ্র মন্থনে অমৃত থেকে গাঁজার উৎপত্তি। হিন্দু পুজার দ্রব্যে থাকে সিদ্ধি। গাঁজা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম canabis sa tiva linn, ক্যানাবিস শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ কন্না বিস থেকে। গাঁজা গাছের স্ত্রী ফুল থেকেই গাঁজা, ভাং বা চরস মেলে। পুরুষ গাছের কোনো মাদক ক্ষমতা নেই। গাঁজায় ইন্দ্রিয় উত্তেজিত হয়। তাই গাঁজার অরেক নাম হরিষিণী। স্ত্রী গাছের শুকনো পাতাই ভাং। বিজয়া বা শিবরাত্রিতে সিদ্ধির শরবত খেয়ে থাকেন শিবভক্তেরা। নাগা সন্ন্যাসীরা দোলের দিন তাই গাঁজা সেবন করে ব্যোম ভোলে ডাক দিয়ে। তারপর চিতার ছাই মাখেন নগ্ন শরীরে। যুক্তি, চিতার ছাই জীবনের অন্তিম অবস্থা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বিবাহের পর কাশী তে এসে রঙ্গভরী একাদশীতে পার্বতীর সঙ্গে হোলি খেলেছিলেন মহাদেব। তারপর কাশীর শ্মশানে নিজের অনুচরদের সঙ্গে চিতার ছাই মেখে হোলি খেলেন। সেই তন্ত্র বিধি নাগা সন্ন্যাসীরা আজও মেনে চলেন কাশীতে। আগামিকাল জানব তন্ত্র কি? শৈবরা আবার বিভিন্ গোষ্ঠীতে বিভক্ত। অর্থাৎ লবিবাজি নতুন নয় । আজও আছে। সেদিনও ছিল।