পর্ব : ১
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ২০২৪ এ মহা শিবরাত্রি পালিত হতে চলেছে ৮ মার্চ পঞ্জিকানুসারে ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে। তিথি থাকছে ৯ মার্চ বিকেল পর্যন্ত। মহাদেবের সঙ্গে সহধর্মিণী পার্বতীও পূজিত হন এই দিনে। শিবভক্ত নারীপুরুষ এদিন নির্জলা উপবাস করে তিথি নির্দেশিত সময়ে বিগ্রহের মাথায় জল ও দুধ ঢেলে তৃপ্ত হন। তারপর থাকে রাত্রি জাগরণ। অবশ্য ধর্মীয় বিধানে বারো মাসে বারো শিবরাত্রির বিধান আছে। কিন্তু ফাল্গুন মাসে ভক্তরা বিশেষভাবে পালন করেন। এই মাসের বৈশিষ্ট্য কি? কৌতূহলী মনের প্রশ্নটা থেকেই যায়। পুরাণের গ্রন্থে অনেকগুলি কারণ বর্ণিত হয়েছে। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান এতই শুভ যে, আধ্যাত্মিক পূণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ তিথি। দুই, এই মাসেই পার্বতী শিবকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিন, এই মাসেই শিব সমুদ্র মন্থনে উত্থিত বিষ পান করে নীলকন্ঠ হন। চার, এই তিথিতেই স্বয়ং ব্রহ্ম ও বিষ্ণু শিবের শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে শিবের পুজো করেন।
এই বছর শাস্ত্রমতে ঘটল বিরল যোগ। যা ফিরল ৩০০ বছর পর। ফলে শিব ভক্তদের কাছে এবারের শিবরাত্রি বিশেষ তাৎপর্য নিয়েএসেছে। শাস্ত্র বলছে, এবারের মহা শিবরাত্রিতে সর্বার্থ সিদ্ধি যোগ, শিব যোগ ও সিদ্ধ যোগ ও শ্রাবণ নক্ষত্রের সংযোগ ঘটেছে। এছাড়াও মাসিক শিবরাত্রি ও প্রদোষ উপবাসের মিলন তিথি নির্ধারিত হয়েছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে , এবারের শুভ প্রভাবে চাকরি ব্যবসায় অর্থ লাভ, সুখ ও সমৃদ্ধি আসবে। শিব যোগ শুরু সূর্যোদয় থেকে বেলা ১২ টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত।৯ মার্চ পরের দিন সকাল ৬ টা ৩৮ থেকে বেলা ১০ টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত সর্বার্থ সিদ্ধি যোগ ছিল। ফলে এবারের পুজোর ফল দ্বিগুণ।
ধর্মীয় বিধান বলে, শিবের প্রিয় ফুল শ্বেত করবী, শেফালি,কুন্দ, মল্লিকা, নাগকেশর, মুচুকুন্দ, টগর, ধুতরো ইত্যাদি। তবে অনাথের নাথ শিব সামান্য তিনটি বেল পাতাতেও সন্তুষ্ট হন। তাই তাঁর আর এক নাম আশুতোষ। সারাদিন নির্জলা উপবাসে থেকে শিবলিঙ্গে কাঁচা দুধ আর গঙ্গাজলে স্নান করানো নিয়ম। মেয়েরা শিবের কাছে তাঁর মত স্বামী কামনা করে আরাধনা করেন। প্রশ্ন, হিন্দু ধর্মে প্রেমিক পুরুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ বন্দিত, লক্ষ্মীনারায়ণ যুগল মূর্তিরও পুজো হয়ে থাকে। তবু শ্মশানবাসী,বাঘের ছাল পরিহিত,সর্বাঙ্গে ছাই,গাঁজার ছিলিমে টান দিয়ে নেশা করেন, ভূত প্রেত নিয়ে ঘুরে বেড়ান,এমন পুরুষকে মেয়েরা আদর্শ স্বামী মনে করেন কেন?
প্রথমে যুক্তির নিরিখে দেখা যাক। শিবের অসামাজিক বেশভূষা, নেশাভাং যাই থাক, তিনি স্ত্রীকে ভালোবাসেন প্রাণের চেয়ে বেশি। পুরুষের মেল ইগো তিনি জয় করেছেন। নাহলে শ্বশুরমশাই দক্ষযজ্ঞতে কন্যা জামাতাকে নিমন্ত্রণ না করায় দুঃখিত হলেও মেনে নেন। শিব নিমন্ত্রিত নন কেন? কারণ তাঁর পিতৃ পরিচয় নেই। থাকবে কি করে? শিব তো অনার্য দেবতা। আর্য সম্প্রদায় যখন দখল করেন শিব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। যদিও পরবর্তী সময়ে বেদে রুদ্র কে শিব নামকরণ করে আর্য সংস্কৃতিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বেদে ১১ রুদ্রের কথা আছে। হর, বহুরূপ ত্রয়ম্বক, অপরাজিতা, বৃষ্যকোপি, শম্ভু, কর্পাদি, রেবাত, মৃগব্যাধ, সাধা, পালী। রুদ্রকে অনার্য দেবতা শিবে রূপান্তর অনেকটাই অবশ্য বাধ্য হয়েই। অনার্য সংস্কৃতি গ্রাস করতে কিছুটা সমঝোতা।
ফিরে আসি পুরাণের গল্পে। নিমন্ত্রণ না থাকলেও দক্ষকন্যা সতী বায়না করেন বাপের বাড়ি যেতে।শিব আপত্তি জানালেও সতী মানেন না। শিব বহুবার তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেও বাধ্য হন অনুমতি দিতে। এরপর কি পরিণতি হয়েছিল সবাই আমরা জেনেছি পুরাণের কাহিনীতে। মৃত স্ত্রী পার্বতীর দেহ কাঁধে নিয়ে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের কথাও আমরা জানি। স্ত্রী বিরহে শিব শোকে অঝোরে কাঁদেন। তাঁর চোখের জলেই যমপুরীর পাশে বয়ে যাওয়া বৈতরণী নদীর সৃষ্টি হয়। স্ত্রী কালীরূপে যখন বিশ্ব সংহার করছেন প্রচণ্ড ক্রোধে, তখন স্ত্রীর রুদ্র রূপ সংযত করতে নিজে বুক পেতে দেন। স্বামীর বুকে পা তুলে জিভ কেটে সংযত হন দেবী। কাশীর অন্নপূর্ণার মন্দিরে দেখি স্ত্রীর কাছে অন্ন ভিক্ষা করছেন শিব।মেল ইগো জয় করেই শিব মেয়েদের আদর্শ স্বামী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন।সেক্ষেত্রে বিষ্ণুকে আমরা দেখি ক্ষীর সমুদ্রে অনন্ত শয্যায় স্ত্রী লক্ষ্মীকে দিয়ে পা টেপাচ্ছেন।যা মালিক সুলভ আচরণের নমুনা।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা দেশের প্রাচীন সভ্যতা। আর্য তখনও ভারতে প্রবেশ করেনি। এই অঞ্চলে তখন মাতৃ আরাধনার চল। প্রকৃতিই ছিল উপাস্য। পুরুষ প্রতিনিধি পশুপতি ছিলেন পুরোহিত। পশুদের তিনি সম্মোহিত করে রাখেন নিজের অধীনে। এমন ধারণা থেকেই পশুপতিরূপ পরিকল্পনা। বাহন তাঁর ষাঁড়, মহিষ, বাঘ । ষাঁড় ও পশুপতি সীল এখন রক্ষিত আছে পাকিস্থানের মিউজিয়ামে। পশুপতির মাথায় মুকুট মহিষের। অন্যদিকে পুরুষ যৌনাঙ্গের পুজোও হত। আর্য শাস্ত্র ঋগবেদে তাই লিঙ্গ অর্থাৎ শিশ্ন উপাসকদের নিন্দা বর্ণিত হয়েছে। এই উপাসকরা সম্ভবত দ্রাবিড় গোষ্ঠী। আজও তাই দক্ষিণ ভারতে শৈব ধর্মে রূপান্তরিত হন। শিবের পুজো শুধু ভারতে নয়,নেপালেও হয়। সেখানে পশুপতিনাথ হিসেবে পুজিত। অর্থাৎ পশুদেরও তিনি দেবতা।
বাংলায় শিবের পুজোর প্রচলনের এক ঐতিহাসিক তথ্য আছে। বৃহত্তর বাংলা একদিন ছিল দুই বাংলা,বিহার,ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, ও ওড়িশা এবং আসামের বেশকিছু অংশ নিয়ে। বাংলার আদি সমাজ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও লৌকিক নাথ ধর্মের অনুসারী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেনঃ ,,,,,,বাংলায় ধর্ম ঠাকুরের পূজাই হয়তো বৌদ্ধ ধর্মের শেষকথা। ধর্ম ঠাকুর শিব, বিষ্ণুর, ব্রহ্মা কোনোটাই নন। ধর্ম ঠাকুরের মূর্তি কচ্ছপের খোলার মত একটি স্তূপ। ফলে এই প্রভাবেই বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ প্রাধান্য পায় সংঘ নির্মাণে। বাংলায় আর্য প্রাধান্যের শুরুতে হিন্দু ধর্মের প্রবক্তারা শঙ্কিত ছিলেন বৌদ্ধদের নিয়ে। ফলে বৈদিক ছদ্মবেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করতে বছরের দুটি দিন চড়ক ও শিবরাত্রিকে মান্যতা দেওয়া হয়। নাথ ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন মৎসেন্দ্রনাথ। শিষ্য গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গী নাথ।কলকাতার ধর্মতলা ও চৌরঙ্গী অঞ্চল এই নাথ ধর্মের সাধনাস্থল থাকার সুবাদে নামকরণ চৌরঙ্গী হয়। নন্দন চত্বরের পাশে চৌরঙ্গী নাথের সমাধি অবাঙালিদের হাতে পড়ে রাম মন্দির হয়ে গেছে।
বাংলায় শিবের পুজো শুরুর ইতিহাসে চোখ রাখুন যাক।। বৌদ্ধধর্মের বিদায় পর্ব সেনবংশের আমলেই পরিণতি পায়। সেনবংশের আরাধ্য দেবতা ছিলেন শিব। দক্ষিণ ভারতে অনার্য সংস্কৃতিতে শৈবপন্থীদের ছিল প্রভাব। সেনবংশের রাজা বল্লালসেন ও লক্ষণসেনও ছিলেন শৈবপন্থী। পরে লক্ষণসেন বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো। এখন দেখবো সেনবংশের শাসনে শৈবধর্মের বিকাশ।
আগেই বলেছি,বৈদিক ধর্মে কিন্তু এই অনার্যদেবতা শিব অর্থাৎ লিঙ্গ পূজাকে ইতর রীতি বলা হয়েছে। আছে নিন্দাসূচক বিশেষণ। অনার্য এই দেবতাকে হিন্দু ধর্মে বলা হয় তামসিক দেবতা। গাঁজাসেবনকারী ভূত _প্রেত যাঁর সহচর, অর্ধনগ্ন দেবতা,অশুভ। কিন্তু যত হিন্দুধর্মের প্রসার বেড়েছে তত আর্যগোষ্ঠী বোঝে,ভূমিপুত্রদের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে হিন্দু আধিপত্য বিস্তার সম্ভব নয়। দলে সমঝোতার পথে যেতে শিবকে বৈদিক দেবতা রুদ্রের স্থান দেওয়া হয়। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু দেবতার পাশে স্থান দিয়ে ত্রিদেব তত্ব প্রচার শুরু হয়।
শিব শব্দের উৎপত্তি শী ধাতু (শয়ন) থেকে। সবার মধ্যে যিনি শায়িত। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল। যা কিছু মঙ্গলময় তাই শিবস্বরূপ। শিবের আরেক নাম শম্ভু।শম্ভু মানে কল্যাণ। যিনি কল্যাণকর তিনি শিব শম্ভু।শিবকে বলা হয় যিনি নিজে নিজেকে সৃষ্টি করেন।তাই তাঁকে বলা হয় স্বয়ম্ভু । ভারতের নানা প্রান্তে শিব নানানামে পরিচিত। বিহারে শিব বৈদ্যনাথ নামে পরিচিত। সুস্থ দেহে ও মনে জীবনধারণের রহস্য যাঁর করায়ত্ত,তিনি বৈদ্যনাথ। শিবের মূর্তি পরিকল্পনাতে ও আছে বিভিন্ন অর্থের রূপক। অনার্য ভারতের ভূমিপুত্রদের দলপতি হিসেবে শিব প্রতিষ্ঠিত।
আদিম জনগোষ্ঠীর দেবতা। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার ভূমি খনন করে প্রতত্নবিদেরা কিছু সিলমোহর আবিষ্কার করেছেন। যেখানে জন্তুবিশেষ পরিবেষ্টিত যোগাসনে উপবিষ্ট কিছু প্রতিকৃতি মেলে যাকে আদি শিব বা পশুপতি বলা হয়েছে। আর্য আগ্রাসনে সিন্ধুতট ছেড়ে অনার্য ভূমিপুত্ররা ক্রমশ দক্ষিণ প্রান্তে অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ভারতে বসতি নির্মাণ করেন। সিন্ধু উপত্যকায় অনার্যদের উপাস্য দেবতারা ছিলেন মূলত নারীনির্ভর। পুরুষ দেবতা একমাত্র শিব। পশুপতি হিসেবে পরিচিত এই দেবতার সহচর হাতি, বাঘ, গন্ডার ও মহিষ। তাই বোধহয় অনার্য মহীশূরের মহিষাসুরের সঙ্গে মহিষের এক সম্পর্ক থেকে গেছে। অনার্য বাঙালির পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে বধ করছেন আর্য দেবতা দুর্গা। সে দুর্গার উপাসনায় বাঙালি। এও কি বাঙালির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত? তাই বুঝি ভারত জুড়ে অনার্য অসুর সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা শিব। থাক এই প্রসঙ্গ। ফিরে যাই দক্ষিণ ভারত থেকে আগত লক্ষণসেনের শৈবধর্মে বিশ্বাস প্রসঙ্গে।
অনার্য সমাজে শিবের উৎপত্তি মূলত পশুপালনের দেবতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে খান্ডবা নামে এক স্থানীয় দেবতার কথা। যাঁর রূপ পরিকল্পনাঅনেকটাই শিবের মত। শিবের বাহন ষাঁড়। এই পশুটি শক্তি,আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ষাঁড়মূর্তি প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু হিসেবে মিলেছে। শিব কৈলাশপর্বতনিবাসী।গ্রীক দেবতা দেবরাজ জিয়াস অলিম্পাসপর্বতনিবাসী। মহাদেবের কন্যা মনসা , তেমন জিয়াস কন্যার এথেনা।
প্রশ্ন উঠতে পারে , পাশুপত তথা শৈব ধর্ম আগে না বৌদ্ধ ধর্ম?, উত্তর মিলবে মহাভারতের রচনাকাল ধরলে। মহাভারত রচিত আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত। মহাভারতের শান্তি পর্ব লিখিত হয়েছে বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েকশো বছর পর। ফলে পাশুপত ধর্মে বুদ্ধের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সেনবংশের আগমন কর্ণাটক থেকে । দক্ষিণ ভারতে আদি পাশুপত ধর্ম বিবর্তনে অনেকগুলি শৈব ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। যেমন নায়নার, শৈব সিদ্ধান্ত, আগমান্ত, বীর শৈব বা লিঙ্গায়েত গোষ্ঠী।
বাংলাতেও হীনযান বৌদ্ধদের প্রভাবে বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবী হিন্দু ধর্মে কালী দেবী এবং দক্ষিণী হিন্দু প্রভাবে শিব স্বামী স্ত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ঈশ্বরবিরোধী বৌদ্ধধর্ম কালের স্রোতে মূর্তি বিশ্বাসী দেবী উপাসক সহজিয়া বৌদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গদেশে নিজস্ব একটি ধারা তৈরি হয়ে যায় পাল বংশের আমলেই । এরপর বৌদ্ধধর্ম যত অস্তমিত হয়েছে তত বঙ্গদেশে শিব ও কালী তন্ত্রমতে প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে লক্ষণসেন বৈষ্ণব হয়েছেন স্বাভাবিক বৈষ্ণবতন্ত্রের আগ্রাসনে। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বুদ্ধদেবের ছায়ায় শিব প্রতিষ্ঠিত হলেন বাংলায়। বাংলায় শিবরাত্রি অর্থাৎ শিব চতুর্দশী এবং চৈত্র সংক্রান্তির গাজন শৈবধর্মের প্রধান উৎসব জনপ্রিয়।
শিবরাত্রির ব্রত প্রধানত বাংলার মেয়েরা করে আসছে। ব্রত শব্দটি ব্রাত্য থেকে এসেছে। ব্রাত্য জনের উপাসনা। সে যুগে মেয়েরা সমাজের ব্রাত্য ছিল। আর্য সমাজেও শিব ছিলেন অনার্য ব্রাত্য দেবতা। লক্ষণসেনের শৈব ধর্ম ছেড়ে বৈষ্ণব হওয়ার ক্ষেত্রে নতুনত্ব কিছু ছিল না। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস(আদি পর্ব) গ্রন্থে বলেছেন, বাংলাদেশে সর্বতোভাবে আর্যিকরণ আরম্ভ হয়েছিল গুপ্তপর্বেই। ভারতের ইতিহাসে আমরা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তার পরবর্তীকালের বহু রাজাই বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। শৈব ধর্ম প্রভাবিত দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটে।
এডওয়ার্ড ওয়াসবার্ন হপকিন্স তাঁর ‘দ্য রিলিজিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, বৈষ্ণব ধর্মের বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। কৃষ্ণ ধর্মের উৎপত্তি অনেক পরে। প্রথমে যা ব্রাহ্মণ্য সমাজে স্বীকৃতি পায়নি। পরে বিষ্ণুদেবের অবতার হিসেবে কৃষ্ণকে যুক্ত করে নেওয়া হয়। প্রধান কারণ, দেশের সর্বত্র ব্রাহ্মণ সমাজে যাতে স্বীকৃতি মেলে। রামায়ণ আর মহা ভারতে রামচন্দ্র ও কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই আর্য আগ্রাসন আরও সাফল্য পায়।বাংলায় কিন্তু তখনও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে শাক্ত ধর্ম প্রধান ধর্ম।কৃষ্ণস্তুতি বঙ্গে অনেক পরে চৈতন্যদেবের প্রচারে জনপ্রিয়তা পায়। সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো।বাংলায় দ্রাবিড়যোগে সৃষ্টি হওয়া অবৈদিক ব্রাহ্মণদের মধ্যে শাক্ত ধর্ম একদিকে যেমন প্রভাবিত তেমন সাধারণ বাঙালিদের মধ্যেও শাক্ত ধর্ম প্রভাবিত হতে থাকে।
অনার্য ভারতে শক্তি পূজা মোটামুটি তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল।১) কাশ্মিরী সম্প্রদায়,২)দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রদায় ৩)বঙ্গীয় বা গৌড়ীয় সম্প্রদায়। কাশ্মিরী তন্ত্রে দেবী সারদা, দক্ষিণ ভারতে পূজিতা শ্রীবিদ্যা , লোলিতাদেবী,বঙ্গীয় সম্প্রদায় দশ মহাবিদ্যাতন্ত্র নির্ভর। শাক্তমতের তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু যৌনউদ্দীপক আচার আচরণের দোহাই দিয়ে শাক্ত ব্রাহ্মণরা ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়ে সমাজকে কিভাবে কলুষিত করতে থাকে এবং সেই সময়ে চৈতন্যদেবের উত্থান কি ভাবে হয়,তিনি কিভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন সেই প্রসঙ্গে আর কয়েক পর্ব পরে আলোচনা করবো। এই পর্বে আমরা দেখবো শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পাশাপাশি লোকায়ত বিশ্বাসগুলিও সাধারণ মানুষের মধ্যে একাত্ম হয়েছিল।এই লোকায়ত বিশ্বাস কিন্তু মোঘল যুগ পেরিয়ে ব্রিটিশ যুগেও ছিল।
ব্রাহ্মণ্য শ্রেণী শাসককূলের অনুগ্রহ পেতেন। কিন্তু লোকায়ত ধর্মের জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করার সাহস ব্রাহ্মণ বা শাসকদের ছিল না। তাই লোকায়ত দেবতারা শৈবধর্মে সুকৌশলে ব্রাহ্মণদের চাতুর্যে মিশে গেল।ফলে সমাজের ওপর স্তরে যেমন বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণ ও গীতা , বেদ আধিপত্য বিস্তার করেছিল তেমন সমাজের মধ্যবর্ণ ও নিম্নবর্ণমহলে শিব প্রতিষ্ঠিত হন। ধীরে ধীরে বাংলায় পূজার সঙ্গে হাজার আচার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয় । আহ্নিক, প্রার্থনা ও পূজার পাশাপাশি দশ সংস্কার যেমন_ নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ অর্থাৎ মাথা ন্যাড়া,কান ফুঁটো করা , উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, পুংসবন (গর্ভ ধারণের তৃতীয় মাস অনুষ্ঠান), সীমন্তন্নয়ন (চতুর্থ, ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসেরগর্ভধারণের অনুষ্ঠান ) ও জাতকর্ম অর্থাৎ পুত্র জন্মের অনুষ্ঠে়য় কর্ম প্রভৃতি।
এছাড়াও বাঙালি অঞ্চলভেদে আরও কিছু ঐচ্ছিক অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হয়। যেমন বিভিন্ন ব্রত, নববর্ষ উৎসব, জামাইষষ্ঠী, রথযাত্রা, অম্বুবাচী, ঝুলনযাত্রা, রাখিবন্ধন, নষ্টচন্দ্র, হোলি ও দোলযাত্রা, চড়ক পূজা প্রভৃতি। এছাড়া আরও প্রায় ১০১ টি আচার অনুষ্ঠান বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত হয়। যেমন, অধিবাস, অন্ত্যেষ্টি, অশৌচ,আকাশ_প্রদীপ, একাদশী, কালবেলা, জপ, তর্পণ, দক্ষিণা, দীক্ষা, নবান্ন, প্রায়শ্চিত্ত, মহালয়া, রাসযাত্রা, সংক্রান্তি, হবিষ্য ও হাতেখড়ি প্রভৃতি। বাঙালি হিন্দুরা এই আচার প্রথাকে ধর্ম হিসেবেই মানে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,(কালান্তর: বিশ্বভারতী: কলকাতা ১৪০০)এই গোঁড়ামির শুরু হিন্দু যুগে। হিন্দু যুগ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার যুগ। কারণ এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল।,,,,,( সিন্ধু থেকে হিন্দু, ড: আর এম দেবনাথ, প্রকাশক রিডার্স ওয়েজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৭২)। আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জাতিভেদ প্রথাও ক্রমশ বেড়ে ওঠে।
গ্রিক পুরাণের গ্রন্থেও আমরা শিবের মত এক দেবতার বর্ণনা পাই। নাম দিওনুসস। বৃষ যাঁর বাহন। তিনি নৃত্য গীতের দেবতা। শিবকেও বলা হয় নটরাজ। নৃত্য ও গীতের দেবতা। ড:সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর দি ইন্ডিয়ান থিয়োগনি; ব্রহ্মা, বিষ্ণুর অ্যান্ড শিবা (পেঙ্গুইন বুকস,ইন্ডিয়া ২০০০) গ্রন্থে বলেছেন , আর্য দেবতা বিষ্ণু ও অনার্য দেবতা শিবকে হিন্দু ধর্মে মেলাতে দুটি দেবতাদের মন্ডলী সৃষ্টি করা হয়। বিষ্ণু ও বিষ্ণু সংশ্লিষ্টগোষ্ঠীতে আছেন – সূর্য, সাবিত্রী, মিত্র, ভগ, অশ্বিন, ইন্দ্র ও কৃষ্ণ। আর শৈবগোষ্ঠীতে স্থান পেয়েছেন_ মাতৃদেবীগণ, যমযমী, কার্তিক, গণেশ, রুদ্র শিব, উমা, অদিতি ও লক্ষ্মী। সে অর্থে শিব দেশজ। বিষ্ণু বাংলার বাইরের আর্য দেবতা।
দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেনঃ বুদ্ধ ও শিবের মূর্তি ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে জনগণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য ছিলেন। বুদ্ধ, মহাবীর ও দ্রাবিড় প্রভাব থেকেই বাঙালি শিব উপাসক হন। কর্ণাটক থেকে আগত বাংলায় সেনবংশের আমলেই বৌদ্ধ ধর্মের বিদায়ের পালা সূচিত হয়। সেনবংশের আরাধ্য দেবতা ছিলেন শিব। দক্ষিণ ভারতে তখন শৈব প্রভাব বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেনবংশের লক্ষণ সেন এরপর বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। বৈদিক ধর্মে আর্য দেবতা শিব অর্থাৎ লিঙ্গপুজাকে ইতর রীতি বলা হয়েছে।
বেদে আছে নিন্দাসূচক শ্লোক। কিন্তু অনার্যভূমিতে আর্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতেই হয়। সেই সূত্রেই ব্রহ্মা বিষ্ণুর সঙ্গে শিবকে স্বীকৃতি দিয়ে ত্রিদেব তত্ত্ব প্রচার করা হয়। তারই প্রতীক তিনটি বেলপাতা। লক্ষ্য করার বিষয়, বৌদ্ধ ধর্মেও আছে ত্রিশরণ ধারণা। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি , সংঘং শরণং গচ্ছামি।বুদ্ধদেব হিন্দু প্রভাবে যেমন স্থান হারাতে লাগলেন বঙ্গে,তেমন নাথ ধর্মে হিন্দু সংস্কৃতি মিশে শিব পরিচিত হলেন ভোলানাথ, তারকনাথ, বৈদ্যনাথ, কেদারনাথ,অমরনাথ নামে।
শিব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন দেখা যাক।
তিনি তাঁর কালান্তর(বিশ্বভারতী,১৪০০) রচনায় লেখেন, বৌদ্ধ ধর্ম (মধ্য যুগে) তখন জীর্ণ। স্বপ্নে যেমন এক থেকে আর হয়, তেমনি করেই বুদ্ধ তখন শিব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব ত্যাগী, শিব ভিক্ষু, শিব বেদ বিরুদ্ধ, শিব সর্বসাধারণের। বৈদিক দক্ষের সঙ্গে এই শিবের বিরোধের কথা কবিকঙ্কন এবং অন্নদা মঙ্গলের গোড়াতেই প্রকাশিত আছে। শিবও দেখি বুদ্ধের মতো নির্বাণ মুক্তির পক্ষে, প্রলয়েই তার আনন্দ। কিন্তু স্বস্তির দেবতা,ত্যাগের দেবতা টিকল না। পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০। ক্ষিতি মোহন সেন তাঁর হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ (বিশ্বভারতী,১৩৮৭) গ্রন্থে লিখেছেন, শিবপূজা একসময়ে ব্রাহ্মণের ও বৈদিকাচারে যে বর্জনীয় ছিল, তাহা আমি জাতিভেদ নামক পুস্তকে আলোচনা করিয়াছি।
বৈদিকাচারযুক্ত আর্যেরা চারিদিকে অনার্যের প্রভাবের মধ্যে পড়িয়া শিবপূজা গণপতি পূজা দেবীপূজা প্রভৃতি গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়।পৃষ্ঠা_৮-১২। আর্য সংস্কৃতিতে পুরাণের সূত্র মিশিয়ে রামভক্ত হনুমানকে বানানো হয়েছে শিবের অবতার। অর্থাৎ প্রভু বিষ্ণু, পদপ্রান্তে শিব।সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।আধুনিক যুগে রামকৃষ্ণদেবকে বলা হয়েছে বিষ্ণুর অবতার।বিবেকানন্দকে বলা হয় শিবের অবতার।অর্থাৎ আর্য দেবতা প্রধান। অনার্য দেবতা তাঁর অধীন। শ্রাবণ মাসে দেশ জুড়ে শৈব সম্প্রদায় বিভিন্ন শিব মন্দিরে আরাধনা করবেন।দেশ তথা বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু পুরুষ মহিলা অন্তরের ভক্তি দিয়ে বাঁক নিয়ে শিবের মন্দিরে শিব লিঙ্গে মাথায় জল ঢালবেন।তবে শিবের ঠান্ডা লেগে সর্দি কাশি হবে কিনা সেটা বলা সম্ভব নয়।